কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে ঘিরে কিছু প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণ
- ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
- প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩১ PM , আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৩২ PM
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন আপনাদের সুপরিচিত। কোন পত্রিকায় গল্প পড়িয়া তাহাকে চিনিয়াছিলাম তাহা নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারিব না। অন্য এক দিনের কথা প্রত্যক্ষ স্মরণ হয়। ১৯৭৬ বা ৭৭ হইবে। একদিন পূর্বদেশ অফিসে গিয়াছি। সেইখানে দেখি বিখ্যাত অভিনেতা আফজাল হোসেন ভাইয়ের টেবিলের সামনে বসিয়া একজন অনতিতরুণ ভদ্রমানুষ এক বস্তা নিউজপ্রিন্ট লইয়া নিবিষ্টমনে কিছু লিখিতেছেন। আমি তাহার পাশের খালি চেয়াটি দখল করিলাম। চাঁদের হাটের কর্মী বলিয়া আফজাল ভাই সুপরিচিত। আফজাল ভাই কি যেন কাকের-ঠ্যাং বকের-ঠ্যাং পত্রিকার জন্য একটি অলংকরণ করিতেছিলেন, উল্টাপাশ হইতে বোঝা যাইতেছিল না। আমার মুখপানে দৃষ্টিপাত করিয়া ঠোঁটের দুই কোণে দুই বিন্দু হাসি ফুটাইয়া বলিলেন, ‘কি খবর হে। বস।’ আমি বলিলাম, ‘বিশেষ কোনো সংবাদ থলিতে নাই।’ তিনি আবারও দুই বিন্দু হাসি উপহার দিয়া চাইনিজ কালিতে আঁকাবুকি করিতে লাগিলেন।
পাশে উপবিষ্ট লেখক ডানদিকে ঘাড় ঘুরাইয়া বলিলেন, ‘আমার নাম ইমদাদুল হক মিলন।’
‘আমি শুধাইলাম লেখেন কি?’
‘গল্প।’
‘গল্পের নাম কি?’
‘নাম ঠিক করি নাই।’
অচিরেই গল্পটি সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় ‘না সজনী’ নামে প্রকাশিত হইলে তাহা পাঠ করিবার সুযোগ লাভ করিলাম। বলিতে হয় একযোগে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং তাহার গল্পের সুস্বাদের সহিত সম্যক সাক্ষাৎকার হইল। তিনি উত্তম লেখক বটেন। পরে শুনিয়াছি, ‘না সজনী’ তাহার জন্য বর হইয়াছিল। তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিলেন।
নানা অনুষ্ঠানে মিলন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হইয়াছে, কখনও কিঞ্চিৎ কখনও অধিক বাক্যালাপ হইয়াছে। তিনি ভদ্রলোক। সর্বদাই নির্ভুল শোভনতমণ্ডিত ব্যবহার করিয়াছেন। তাহার গেণ্ডারিয়ার কুঠিতে যাইবার সুযোগ ঘটিয়া ছিল কি-না তাহা স্মরণ করিতে পারিতেছি না।
কোন এক আড্ডায় বলিয়াছিলেন যে বাংলা সাহিত্যের সকল তালেবর লেখকের তাবৎ উপন্যাস এবং ছোটগল্প তিনি মনোযোগ দিয়া পাঠ করিয়াছেন। ইহা শুনিয়া সঝাঁকুনি বিস্মিত হইয়াছিলাম। ক্লাস ফাইভে থাকিতে ‘মবিডিক’, ‘এ লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি’ ইত্যাদি নামিদামি বই-পুস্তকের অনুবাদ বেশ-কতক পাঠ করিয়াছিলাম। ক্লাস সেভেনে ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ ইংরেজিতেই একদফা কোশেশ করিয়াছিলাম। অতঃপর ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যাযাবর, জরাসন্ধ, বনফুল, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, নিহাররঞ্জন গুপ্ত, নিমাই ভট্টাচার্য প্রমুখের লেখা ক্লাস নাইনে উঠিবার আগে ঢের পড়া হইয়াছিল। শশধর দত্ত ও কাজী আনোয়ার হোসেনের কথা না বলিলেও চলে। মিলন ভাই এমন সব লেখকের নাম বলিলেন যাহাদের উপন্যাস পড়া হয় নাই। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাহার উপন্যাস ‘গোরা’ কিংবা ‘নৌকাডুবি’ তখনো হাতের নাগালে আসে নাই। বুদ্ধদেব বসু পড়িয়াছি ১৯৮০ বা একাশীতে।
আমার প্রতীতি এমতরূপ যে পড়াশোনা একটি সরবরাহচালিত প্রক্রিয়া। অন্যের বই হাতে আসিয়া পড়িলে ফেলিয়া রাখিবার জো নাই। ট্যাঁক খসাইয়া দোকান হইতে যে সকল বই কিনিয়া সন্তুষ্টচিত্তে ঘরে ফিরিয়াছি, তাহার শতভাগ পাঠ করিয়াছি এইরূপ দাবি কস্মিনকালেও করিতে পারিব না। কিন্তু ধারে বই নিলে তাহা দ্রুত পাঠ করিয়া শেষ করিয়াছি।
যাহা হউক, হুমায়ূন আহমেদের প্রবল আবির্ভাব এবং আশির দশকের শেষ ভাগে দ্রুত উত্থানের পূর্বাবধি মিলন ভাই ছিলেন আমাদের সবচাইতে প্রিয় কথাশিল্পী। ১৯৮৬ সালে কবি শামসুর রহমানের সম্পাদনায় ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র ‘অধুনা’ প্রকাশ করিতে গিয়া আবার তাহার সহিত লেনদেন শুরু হইল।
১৯৮৯ সালের শেষ ভাগ। অস্ট্রেলিয়া যাইব উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য। ইতোমধ্যে ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুসম্পন্ন। সময়মত বৃত্তিও জুটিয়াছে। ভিসার জন্য ইন্টারভিউ দিয়া গুলশানে বাসে চাপিয়া নয়াপল্টনে শিল্পী ইউসুফ হাসানের প্রতিষ্ঠান ‘রূপ’-এ বসিয়া আড্ডা দিতেছি—এই সময়ে ইমদাদুল হক মিলনের আবির্ভাব হইল। ইউসুফ হাসান উদারচিত্তে পুনরায় সিঙ্গারা এবং চায়ের কথা বলিলেন। তখনও সম্ভবত সিঙ্গারা জাতীয় নাশতার মর্যাদা অর্জন করে নাই। যাহা হউক, সেই দিন মিলন ভাইয়ের সহিত দীর্ঘক্ষণ সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা হইয়াছিল। বলিলেন, ‘তুমি চিত্রবাংলায় ছোট একটা আলোচনা লিখিলে কিন্তু আর কোনো বড় মাপের আলোচনা লিখিলে না।’ আমি না ঘাবড়াইয়া বলিলাম, ‘বড় মাপের একটি উপন্যাস লিখিবেন আমি তাহা সবিস্তার আলোচনা করিব। সেই অপেক্ষায় আছি।’
মিলন ভাই কথা রাখিয়াছেন। বৃহদাকার ‘নূরজাহান’ লিখিয়াছেন। আমি আমার কথা রাখিতে পারি নাই।
একখানা মজার গল্প বলি। যখন বাংলাবাজার পত্রিকায় চাকরি করি তখন তাহার কাছে গল্প চাহিলাম। গল্প পাওয়া গেল কিন্তু তাহার শেষ পৃষ্ঠা নাই। বাহকের নিকট হইতে সদুত্তর পাওয়া গেল না। ফোনে মিলন ভাই হাসিতে হাসিতে বললেন, ‘শেষ পৃষ্ঠা পাঠাইতে গেলে তুমি আগামী শুক্রবার সাহিত্যপত্রটি বাহির করিতে পারিবে না।’
বলিলাম, ‘উপায় কি?’
টেলিফোনের অপর প্রান্তে একপ্রস্থ হাসিয়া লইয়া মিলন ভাই বলিলেন, ‘উপায় একটি বাতলাইয়া দিতে পারি। গল্পের বাকী অংশ তুমি লিখিয়া ফেল।’
আমি তাহার কথা রক্ষা করিয়াছিলাম। দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সেই গল্পের শেষ পাতার লেখক আমি নিজেই বটেক।
মিলন ভাই প্রচুর লিখিয়াছেন। বাংলাদেশ বলিয়া তাহাকে প্রচুর লিখিতে হইয়াছে। অস্ট্রেলিয়াতে বসিয়া এক মার্কিন লেখিকার একটি বই পড়িতে ছিলাম। লেখিকার নাম বিস্মরণ হইয়াছি। এরিকা জং হইতে পারেন। এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন, ‘লেখক হইয়া জন্মগ্রহণ করা নেহায়াৎ অনুচিত। তবে লেখক হিসাবে নিউইয়র্কে বসবাস করা রীতিমতো দণ্ডনীয় অপরাধ। কেবল বেস্টসেলারদের ক্ষেত্রে এই অপরাধ মার্জনীয়।’
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই বাণী একটু ঘুরাইয়া বলিতে পারি। বাংলাদেশে লেখক হিসেবে জন্মগ্রহণ করা কেবল অপরাধ নহে; দণ্ডনীয় অপরাধ। ঘন ঘন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ করিলে এবং সংবৎরে কুল্লে চারিপাঁচখানা উপন্যাস বা কি গল্পসংকলন প্রকাশ করিলে এই অপরাধ মার্জনা করা যায়। প্রশ্ন উঠিতে পারে কে এই দণ্ড প্রদান করিয়া থাকেন? আর কেই-ই বা প্রমার্জনাকারী? প্রকাশক। বিশ্বাস না হইলে শাহবাগে এক চক্কর ঘুরিয়া আসিতে পারেন।
মিলন ভাইয়ের স্বাস্থ্য আল্লাহর রহমতে ভালো। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মিলন ভাই। জন্মদিনে আমৃত্যু আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। সত্তরের কাছাকাছি বয়সে হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছি মৃত্যু নয়, বার্ধক্যই প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। তাই তাহার সুদীর্ঘ জীবন কামনা না করিয়া আমৃত্যু সুস্বাস্থ্য কামনা করিলাম। তিনি আমার প্রিয় মানুষদের একজন। ইহাই তাহার সম্পর্কে শেষ কথা। নিজের কথা বাদ দিলে বলিতে পারি, তাহার মত সজ্জন এবং উপকার-প্রবণ মানুষ আমি কম দেখিয়াছি। তাহার সৌজন্যবোধ অসাধারণ। তিনি রাগ করিয়াছেন—এইরকম পরিস্থিতি ঘটিয়াছে বলিয়া শুনি নাই।
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী: সাহিত্যিক ও গবেষক; অবসরপ্রাপ্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার