‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ তকমার আড়ালে আসল খেলা কী?

ড. নাদিম মাহমুদ
ড. নাদিম মাহমুদ  © টিডিসি সম্পাদিত

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকারে থিয়েটার আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ঢাকার প্রেসিডেন্ট ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেছেন, টেলিভিশন মাধ্যমে কাজ কমে গেছে। কলাকুশলীদেরও দুর্দিন যাচ্ছে। বিশেষ করে শিল্পকলা একাডেমির অবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর। একাডেমিতে সেনাবাহিনীর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প হয়েছে।  চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া এই অভিনেতা বলছেন, অনেক সংস্কৃতিকর্মীকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এতে মূল ধারা থেকে তারা ছিটকে গেছেন। উগ্র ডানপন্থি রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয় আছে। যখন কোনো ডানপন্থি রাজনীতি তুঙ্গে উঠে যায় তখন সংস্কৃতিকর্মীরা উৎকণ্ঠিত হয়। এই সময়ে বাউলদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। তাদের আখড়া ভেঙে দেওয়া হয়েছে। উগ্র ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান আমাদের সংস্কৃতি চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
 
কথাগুলো আলোচনা করলাম এই কারণে যে, আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন ঠিক কেমন আছে তা একজন অভিনেতা ও কলাকৌশলীর মুখে ফুটে উঠেছে। দেশের কালচারাল অঙ্গন যখন ভঙ্গুর অবস্থায়, তখন এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্বরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন। এরা বলছে ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’। তাদেরকে কিছু বুদ্ধিজীবীও মনে করছেন, দেশে এই সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদেরকে সরাতে না পারলে তাদের হাত ধরে আবার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা পাবে। ফলে গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে এই ‘কালচারাল অনার্কিস্ট’ শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চনাটক প্রদর্শনে বাধা দিয়ে ‘সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে’ কোণঠাসা করার প্রথম পদক্ষেপটা নেন, মব করে কয়েক দফা। এরপর অভিনেতা মামুনুর রশীদকে একটি নাটকে মঞ্চ অভিনয় করা থেকে বিরত থাকার কথা চলে আসে, যিনি এই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছেন। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাট্য মঞ্চায়নে বাধা আসে দফায় দফায়। 

এমন এক পরিস্থিতিতে যখন নাট্যঙ্গনে ভীতিকর পরিবেশ রচিত হয়েছে, দোসর দোসর খেলা চলছে, তখন লিবারেল মানুষজন এবার ‘প্রতিবাদস্বরূপ’ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, তখন ওই কালচারাল অনার্কিস্টরা ‘তাদেরকে ফ্যাসিস্ট’ তকমা দিয়ে ছবিতে ‘জুতা’ নিক্ষেপ কর্মসূচি করেন।। এটা কারা করলেন? কেন করলেন, রাষ্ট্র যদি এই বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারে, তাহলে একদিন এই রাষ্ট্রকে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে।
 
দেখুন সোজাসাপ্টা কথা, যারা এই নোংরা কর্মসূচি পালন করেছেন, তারা কোনদিনই চান না এই দেশে ‘নাটক-সিনেমা-গান-বাজনা’ সচল থাকুক। তারা সবাই ওই শড়াতলা গ্রামের বাসিন্দা, যে গ্রামটি কয়েক মাস আগ ১০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের সই-স্বাক্ষর করে ঘোষণা দিয়েছিল যে ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো’। যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সাথে তাদেরকে চার হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
এমন যখন পরিবেশ দেশে বিরাজ করছে, তখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষগুলোকে ভয় দেখিয়ে, মব দেখিয়ে পিছিয়ে দিতে পারলে ওই গোষ্ঠীরা খুশি। এখানে বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি কেবলই ফাঁকা বুলি। আজ হোক কাল হোক ওরা এমন কর্মকাণ্ড করবে, তা অনুমেয় ছিল। কিন্তু যেভাবে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া কিছু কণ্ঠস্বরকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বানিয়ে জুতা পেটা করা হলো, তা থেকে এটা নিশ্চিত যে ওই গোষ্ঠী এই মানুষগুলোকে অনেক আগে থেকে টার্গেট করে রেখেছিল। ওরা জানে, এইসব মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শ যেটাই হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অ্যাডভোকেসি করতে পারে। ফলশ্রুতিতে ওদেরকে আটকাতে না গেলে, দেশে যে ‘উগ্রবাদী’ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন তারা দীর্ঘদিন ধরে দেখেছেন, তা ভেস্তে যাবে। ফলে রাষ্ট্রের নীরব উপস্থিতিতে ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ নামক কর্মসূচি করে ক্ষমতাসীনদের ভয়কে কিছুটা দূর করার চেষ্টা যেমন হলো, তেমনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে একটি বার্তা দেয়া হলো, দেখ তোমরা যেটাই করো বঙ্গবন্ধুকে হিরো মনো করো না। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ধারণ করো না। একাত্তরে এই কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষগুলোকে ‘পাকিস্তান ও রাজাকারারা’ হুমকি মনে করত। তারা জানে, ওদের বেঁচে রাখলে পাকিস্তানের যুদ্ধের বৈধতা আদায় করতে পারবে না। ফলে তারা বেছে নিয়েছিল ১৪ ডিসেম্বরকে। আজকেও একদল মানুষ সেই একই পথে একই শঙ্কার জায়গায় অটুট থাকছেন, তারা এখন নতুন বাংলাদেশে হুমকি মনে করছেন।

কিন্তু এইসব কর্মকাণ্ড করে কিছু হবে কি? বঙ্গবন্ধুকে যারা গতবছরও ১৫ আগস্ট স্মরণ করেনি, তারা যে এই বছর শ্রদ্ধাবনত হয়েছেন, সেটি কি আওয়ামী লীগের প্ররোচনায় পড়ে?  কামরুল ইসলাম মামুনরা কি শেখ হাসিনার ভক্ত? শাহেদ আলমরা কি আওয়ামী লীগের দালাল? নাকি শাকিব খান? কাউকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে, এক ধরনের ভালোবাসা থাকতে হয়, জানাশোনা থাকতে হয়। আর সেটা আপনারা যদি করতেন, তাহলে এই কুতর্কে জড়াতেন না, দেশটাকে বিভেদ রেখায় শাণিত করতেন না। এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষগুলো রাস্তায় দাঁড়াতে পেরেছিল, বিধায় শেখ হাসিনার বিদায় ঘণ্টা ত্বরান্বিত হয়েছিল। 

কালচারাল ফ্যাসিস্টরাই একাত্তরে মেরুদণ্ড সোজা করে রাস্তায় নেমেছিলেন, চব্বিশে নেমেছেন, আগামীতে আবার নামবেন। তাদের ঠেকানো যাবে না, কারণ তাদের ভিতর সুপ্ত একটা প্রগতিশীলমনা বিবেক থাকে, যে বিবেকের আয়নায় সবাই মানুষ। অন্যায় হলে সেটা ফুটে তোলে লেখনিতে, নাটকে, সিনেমায়। তাই কালচারাল ফ্যাসিস্ট বানানোর আগে নিজেদের আনকালচারাল বিবেকটাকে ঘষামাজা করুন। আর যেসব কথিত বুদ্ধিজীবীরা এসব মানুষকে উস্কে দিয়ে ফায়েদা লুটার চেষ্টা করছেন, তারা মনে রাখবেন এই দেশে ‘উগ্রবাদী চিন্তাচেতনা’ কখনোই ফলপ্রসু হবে না, দিনশেষে আপনারাই সাধারণ মানুষের কাছে পরাজিত হবেন!

ড. নাদিম মাহমুদ: লেখক ও গবেষক; ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)


সর্বশেষ সংবাদ