ডাকসুর লড়াই: ভয়মুক্ত নেতৃত্বের স্বীকৃতি ও ট্রমা-ত্যাগের গল্প

ছাত্রনেতাদের অধিকার বনাম ফ্যাসিবাদের প্রতিধ্বনি

লাহুল গালিব
লাহুল গালিব  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রথমেই বলে রাখি, নতুন করে ডাকসুতে নেতৃত্ব দেওয়ার কোনো খায়েশ আমার নেই। কারণ আমি প্রায় ৫ বছর আগেই ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে যুব রাজনীতিতে পা দিয়েছি এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের বাউন্ডারী সেট করে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই ডাকসু মূলত ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের ন্যায্য অধিকার- যারা এখনো রিয়েল মিনে “স্টুডেন্ট” হিসেবে কন্টিনিউ রান করে যাচ্ছে! ব্যক্তিগতভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমার নিজেরও শিক্ষাজীবন শেষ হয়নি। ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন এখনো অবধি আমি শরীরে বয়ে নিয়ে চলছি! জুলাই না আসলে হয়তো কখনো আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ফিরে আসার স্বপ্নটাও পূরণ হতো না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মানবিক দিক বিবেচনায় রিকন্সিডার না করলে হয়তো আমিও কোনোভাবে এই প্রেমেসিসে ফিরতাম না...

বিগত ১৫-১৬ বছর আওয়ামী লীগ শাসনামলে ছাত্রলীগের নৃশংসতার কারণে রেগুলার ক্যাম্পাস লাইফ, ক্লাস-পরীক্ষা, ভাইভা, কোর্স ওয়ার্ক, হলের আবাসন সুবিধা বঞ্চিত যে সকল শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন নির্যাতিত হয়েছে তাদেরকে আজ এক অদ্ভুত সাইবার বুলিং ফেস করতে দেখছি যেটাকে স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্সের একদম প্রাইম এক্সামপল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এদের অনেককেই ব্যক্তিগত ভাবে চেনার সুবাদে বলছি, বারবার শারীরিক মানসিক নিপীড়নের স্বীকার হয়ে তাদের লাইফটা ট্রমাটাইজড হয়ে গেছে। যারা এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছে তারা ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে এই ফিলটাকে রিলেট করা সম্ভব না যে শরীরের রক্ত, জখম কিংবা গ্রেফতারের আতঙ্ক নিয়ে নিয়মিত শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাওয়াটা কত বড় ডন্টিং একটা টাস্ক!

যারা মুখোশধারী ছাত্রলীগ সেজে নির্বিঘ্নে হলে থেকে ওদের জুতা চেটে, নৌকা নৌকা স্লোগান দিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে এখন নিয়মিত নিয়মিত বয়ান বাজারে ছাড়ছে - ওদের পক্ষে এই অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করা সম্ভব না। ছাত্রলীগের যেসমস্ত নিপীড়ক সংগঠক বিগত সময়ে ছাত্র নির্যাতনের মতো অমানবিক অপরাধের সাথে জড়িত তারাই সময় পরিক্রমায় এখন বয়ান নিচ্ছে যে, অমুক সেশনের উপরে কারও উচিত হবে না ডাকসু করা! কিন্তু ওরা ভুলে যাচ্ছে ওদের পূর্বসূরিদের দৃষ্টান্ত। ২০১৯ সালের ডাকসুতে ০৭-০৮ সেশনের একজন জিএস ইলেকশন করে ভোট ডাকাতি করতে পারলে, ২৫ এর ডাকসুতে ১৫-১৬ সেশনের একজনের ফেয়ার পার্টিসিপেশনে সমস্যা কি? - ওইটা বললে আবার ওদের মুখ বেজাড়!

নরওয়েজিয়ান পিস স্কলার জোহান গ্যালটং-এর একটা একাডেমিক টার্ম আছে, “কালচারাল ভায়োলেন্স”-অর্থাৎ সমাজের গোঁড়া ধ্যান-ধারণা, ইতিহাসের বিকৃত ন্যারেটিভ আর রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির গোপন অস্ত্র দিয়ে অন্যায়কে ন্যায্য প্রমাণ করা। ছাত্রলীগ বছরের পর বছর ক্যাম্পাসে নির্যাতন চালিয়ে, হল দখল করে এই সিস্টেমিক ইনজাস্টিস চালিয়ে গেছে! আর আজকে তারাই উল্টো নির্যাতিতদের বিরুদ্ধে এইজ শেমিং শুরু করেছে! ভিক্টিম ব্লেমিং করে নিজেদের অন্যায় ঢেকে দিতে পুশ করছে রানিং স্টুডেন্ট শিপের ন্যারেটিভ! এদের ভাবখানা এমন যে, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দামের মতো সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে এই একাডেমিক বিলম্ব ঘটিয়ে এখন নাটক দেখাচ্ছে! এরা কালচারালি কতটা “ভায়োলেন্ট” একটু বুঝেন দয়া করে।

সবচেয়ে কষ্ট লাগে দেখতে যে, যে-সকল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সহযোদ্ধাদের নিতান্তই নিজের মায়ের পেটের ভাই মনে করতাম তারা সময়ের পরিবর্তনে এখন ভেশধারী শয়তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জুলাই পরবর্তী প্রেক্ষাপটে লিপফ্রগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে এখন তারা একইসাথে ছাত্র রাজনীতির আধ্যাত্মিক “মেন্টর” সাজতে চায়, আবার জাতীয় রাজনীতির ভাইটাল ফিগার হিসেবেও আবির্ভূত হতে চায়! মাঝখান দিয়া নিজেদের আন্ডার-প্রিপেয়ার্ড সৈন্যদের কমিশনড র‍্যাংক দিয়ে ডাকসুতে সেট করতে তারাও এখন বেজন্মা ছাত্রলীগ আর মুখোশধারী হিপোক্রেটদের সেট করা ন্যারাটিভ পুশ করেছে। এটা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, ঐক্যে ফাটল আর বিশ্বাসে চিড় ধরানোর জন্যে গুড এনাফ!

ব্যক্তিগতভাবে আমার কথা বাদ দেই, কারণ ছাত্ররাজনীতির ক্যারিয়ারে আমি স্বীয় সিদ্ধান্তেই ইতি টেনেছি। কিন্তু এরকম অনেককেই আমি চিনি যারা শত, সহস্র অত্যাচার, নিপীড়ন (স্টেট-স্পন্সর্ড ভায়োলেন্স) সহ্য করেও শেখ হাসিনার আমলে বুক চিতিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছে এই ক্যাম্পাসে। ডিলেইড এডুকেশন এই সংগ্রামেরই একটা কনসিকুয়েন্স মাত্র! স্বাভাবিক পরিবেশ থাকলে কখনোই হয়তো এই মানুষগুলোর এতোদিন এভাবে ঝুলে থাকার কথা ছিল না। এই অপরিসীম ত্যাগ, তিতিক্ষার পরে তারা যদি একবার ডাকসু করতেও চায় সেটা কি খুব বেশী অন্যায্য কিছু হবে? আমি না হয় ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি বিধায় এই জায়গায় অধিকার খাটাতে পারছি না, কিন্তু তারা এতোদিন মাঠ কামড়ে পড়ে ছিল - তাদের তো এটা হক!

কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়মুক্ত পরিবেশ বিনির্মাণে এই ত্যাগী নেতৃত্বকে বর্তমান সিংহভাগ রানিং শিক্ষার্থী (জেন জি) গণতান্ত্রিক উপায়ে ডিনাউন্স করবে কিনা সেটা ভোট হওয়ার আগেই বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তার আগে এই যে তাদেরকে ভিলিফাই করে ডিহিউম্যানাইজ করার অপপ্রয়াস-এটাকে ধিক্কার না জানিয়ে আমি আসলে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ৩০ পরবর্তী বয়সে ছাত্র রাজনীতি বেশিদিন কন্টিনিউ না করাই শ্রেয়। কিন্তু সবাই এটাতে এগ্রি করবে এমনটাও তো না। ছাত্রলীগ তো এখনও টপ লেভেলে ২০১১-১২, ২০১০-১১ সেশন দিয়েই রান করে! সেখানে ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার, ছাত্র ফেডারেশন অথবা ছাত্র ইউনিয়নের ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ অথবা ২০১৫-১৬ এর কেউ ছাত্র রাজনীতি করতে চাইলে তাদের তো এই নিয়ে বয়ান দেওয়ার কিছু দেখি না।

মেইন কথা হচ্ছে, ডাকসু'র লাইমলাইটটা সবাই চায়! কিন্তু গণহত্যাকারী ধিক্কৃত সংগঠনের টাউট বাটপারেরা যে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে আজকে এই ফাইট থেকে আউট এটা তারা মানতে নারাজ! আর এদিকে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী “ছাত্র” পরিচয় ছাপিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখা বালখিল্য যুবকদেরও এখন উভয় সংকট! আজকে জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ না করে ছাত্র সংশ্লিষ্ট রাজনীতিতে থেকে গেলে এই লাইমলাইটের সর্বোচ্চ দাবিদার তারাই হতে পারতো! কিন্তু কুছ পানে কি লিয়ে কুছ খোনা ভি পারতা হ্যায়-এই নীতিতে তারা ডাকসুকে বিসর্জন দিয়েছে স্বেচ্ছায়। মাঝখান দিয়ে ফ্যাসিবাদী আমলে মুখোশ পরে মধু খাওয়া বিতিক পার্টি এখন স্বপ্ন দেখে ঢাকা ইউনিভার্সিটির নির্বাচিত নেতৃত্ব দখলে নেওয়ার! সেটাও ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে চোখে চোখ রেখে লড়ে যাওয়া সংগ্রামী চরিত্রগুলোকে ভিলিফাই করে! 

লেখক: কর্মী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!