সন্তানের রেজাল্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া কতটা ক্ষতিকর, জানেন?
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৪ PM , আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৫, ০৬:৪৪ PM
ফেসবুকে একটা ছেলের রেজাল্ট কার্ড চোখে পড়ল। বলা হচ্ছে, এই ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েছে। ১৩০০ নম্বরের মধ্যে ১২৮৫ নম্বর পেয়ে সে সারা দেশে প্রথম হয়েছে।
আগে প্রতি বোর্ডে প্রত্যেক বিভাগ থেকে ২০ জন করে স্ট্যান্ড করতো। রেজাল্ট বের হওয়ার দিন ও তার পরের কয়েক দিন ওই ২০ জন পত্রিকার পাতা দখল করে রাখতো। দেখা যেতো, দেশের বাদ বাকি শিক্ষার্থীদের কোনো খবর নাই। এটা দিয়ে বাকিদেরকে যে অসম্মানটা করা হতো, যতটা মানসিক চাপে রাখা হত, তার কোনো অন্ত নেই।
তারপর বৈষম্য দূর করার জন্য জিপিএ সিস্টেম নিয়ে আসা হল। শুধু বৈষম্য দূর করা না, এই সিস্টেমের সুবিধা হলো সারা দুনিয়ার সাথে একটা তাল মেলানো যাবে। কিন্তু হলো যে লাউ সে কদু! আগে বাপ-মারা বাচ্চা স্ট্যান্ড করলে গল্প করতো। কয় বিষয়ে লেটার মার্ক পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাগাড়ম্বর করতো। এখন অনলাইন থেকে মার্কশিটের স্ক্রিনশট নিয়ে ফেসুবকে আপলোড করে দোয়া চায়! সারা দেশে ফার্স্ট হয়েছে বলে দাবি করা বাচ্চাটার মার্কশিটও নিশ্চয়ই তার “একদিনের জন্য গর্বিত” বাবা মা কিংবা শিক্ষকরাই আপলোড করেছেন? কিন্তু ওই মার্কশিটটা আপলোড করার আগে একটাবার ভাবেন নাই যে, তার বাচ্চা যখন জিপিএ-৫ পেয়েছে, তখন সারা দেশে প্রতি একশ জনে ৩২টা বাচ্চা ফেল করেছে!
সারা দেশের অন্তত ১৩৪টা স্কুলে একজনও পাশ করতে পারে নাই! এর মধ্যে বহু স্কুলে কোনো মেয়ে পাশ করে নাই, কারণ ইতোমধ্যে তাদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে! আগের বছরের তুলনায় অন্তত ১ লাখ বাচ্চা এ বছর পরীক্ষাই দেয় নাই। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া একটা বাচ্চার বয়স কোনোভাবেই ১৫/১৬ বছরের বেশি না। সেই একই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার বয়সে হাজার হাজার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এইটা একটা দেশের জন্য সুখের কোনো খবর না।
যেহেতু আমরা এসএসসিতে জিপিএ-৫, বা গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়াটাকে একটা সামাজিক মর্যাদার কাতারে নিয়ে গেছি, এখন যার সন্তান আজ এই দুইটার কোনোটাই পায় নাই, আমরা চিন্তাও করতে পারছি না যে, তাকে কতবড় মানসিক অত্যাচারে ফেলে দিচ্ছি আমরা। নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাবা-মা দুইজনের কেউই শরমে কাউকে বাচ্চার রেজাল্টের কথা বলেন নাই। অফিসে গিয়ে পারলে যতটা সম্ভব লুকিয়েচুরিয়ে থাকবেন, যেন কেউ বাচ্চার রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করতে না পারে।
শুধু নিজেরা না, বাচ্চার রেজাল্টটাকে পাবলিক করে ওর উপর একটা মানসিক চাপ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ওর মাথায় এটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তোকে ফার্স্ট হতে হবে। এটা তোর নিয়তি! তুই ফার্স্ট হলে আমি গর্বিত হই। কিন্তু কয়জন এটা শিখিয়েছে যে, জীবন মানে তো শুধু পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া না।
শুধু স্কুল কেন? ইউনিভার্সিটির মত এতবড় একটা জায়গায় নোটিশ বোর্ডে ৫০ জনের রেজাল্ট একসাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়! সেইখানে একজনের নামের পাশে জিপিএ ৪/৪ ঝুলতেছে যখন, আরেকজনের জিপিএ তখন আড়াই। এই যে প্রথম বছর থেকে চার এবং আড়াইয়ের মধ্যে যে ইঁদুর দৌড়টা শুরু হয়, যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়, সেটা আর কখনো ঘুচে না। যে ছাত্রটা প্রথম বছরে ফার্স্ট হয়, সে ধরেই নেয় যে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়াটা তার জীবনের নিয়তি। এরপর যত উপায় আছে, দরকার হলে অসুদপায় হলেও সে ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার চেষ্টা করে।
আর যে জিপিএ আড়াই পায়, সে ধরে নেয়, তারে দিয়ে পড়ালেখাটা আর হবে না। সে কোনোমতে টিকে থাকার একটা চেষ্টা করে যায়। একটা সার্কিফিকেট জোগাড় করা হয়ে যায় তার সকল চেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু! ফার্স্ট হওয়া ছাত্রের একটা ইমেজ দাঁড় করানো হয়। সেটা আমরা জানি। চশমা পরা, ফুল হাতা শার্টের একটা ইমেজ! আড়াই পাওয়া ছাত্রেরও একটা ইমেজ দাঁড়ায় বৈকি। সেটাও আমরা সবাই জানি।
অথচ একটা মানুষের পরীক্ষার রেজাল্ট নিতান্তই তার ব্যক্তিগত! এটা আপনি তার অনুমতি ছাড়া কোনোভাবেই দুনিয়ার তাবৎ মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পারেন না। যে শিক্ষার্থী ফার্স্ট ইয়ারে ভালো রেজাল্টের জন্য বৃত্তি পায়, সে গোটা নোটিশ বোর্ডের ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। তার নামটাকে হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা কি করে সম্ভব হয় আমি জানি না।
এই গোটা প্রক্রিয়ায় শুধু অন্যের প্রাইভেসি ভাঙা না, শিক্ষকরা আরো নানা রকমের অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়েন। এরে মধ্যে বড় একটা দিক হলো, যে ছেলে বা মেয়েটা ক্লাসে প্রথম হয়, তারা তাকে ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করেন। মনে করেন এটা হল সোনার টুকরা, বাকিটা সস্তা ধাতব, অথর্ব! এই দেখার মধ্য দিয়ে তারা একদিকে ক্লাসে বিভাজন তৈরি করেন, অন্যদিকে কম নম্বর পাওয়া ছেলেটাকে সুযোগ পেলেই খাটো করার চেষ্টা করেন। অধিকাংশ সময় এই খাটো করার প্রক্রিয়াটা ক্লাসরুমে সবার সামনেই চলতে থাকে। এমন অনেক শিক্ষককে দেখেছি, যারা তাদের শিক্ষার্থীদেরকে আগের সেমিস্টারের মার্কস দেখে পরের সেমিস্টারেও মার্কিং করেন। অর্থাৎ আগের সেমিস্টারে খারাপ রেজাল্ট করা একটা ছাত্র পরের সেমিস্টারে খুব ভালো লিখেও ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারে না। ব্যাপারটা এমন যে, ‘তুই একবার লাস্ট হইছস, তুই আবার ফার্স্ট হোস ক্যামনে?’
বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিক্ষার্থীদের এই প্রাইভেসিকে খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়! যে কোনো ধরনের পরীক্ষার রেজাল্ট সেই শিক্ষার্থীকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তার ইমেইলে বা লেটার বক্সে পাঠানো হয়! কার কি রেজাল্ট, ক্লাসে কে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হয়েছে, সেটা নিয়ে কখনোই ক্লাসরুমে আলাপ হয় না। নোটিশ বোর্ডে ঝুলানোর তো প্রশ্নই আসে না! ক্লাসে ফার্স্ট বা সেকেন্ড বা লাস্ট বলে কিছু নাই। সবাই সমান!
এতে করে সেই শিক্ষার্থী লজ্জা বা সামাজিক চাপ থেকে মুক্তি পায়, ক্লাসের সামনে বা নোটিশ বোর্ডে জানানো হয় না বলে, কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীকে লজ্জা পেতে হয় না, তার মধ্যে অহেতুক প্রতিযোগিতা বা হীনম্মন্যতার জন্ম নেয় না। ফার্স্ট হওয়া শিক্ষার্থীকে তার ফলাফল ধরে রাখার জন্য কোনো অনৈতিক চর্চায় জড়াতে হয় না। ফলে গোটা ক্লাসরুমে একটা স্বাস্থ্যকর ফ্রেন্ডলি পরিবেশ বজায় থাকে। কী ছোট একটা কৌশল, অথচ কি অসামান্য ফলাফল। আমরা কবে মানুষের গোপনীয়তাকে সম্মান করতে শিখবো কে জানে।
রাজু নূরুল: লেখক, অনুবাদক ও বেলজিয়ামে পিএইচডি গবেষক
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com