বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন
- মো. শফিউল্লাহ্
- প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৫ PM , আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৪ PM
অবিভক্ত বাংলার গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার নদী মোহনায় ভৌগোলিক কারণে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। এই বদ্বীপের নিম্ন অংশে গঙ্গা বা হুগলি ও ব্রহ্মপুত্রের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা বিভিন্ন দিকে বিস্তার লাভ করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই সমগ্র অঞ্চল লবণাক্ত অসংখ্য বৃক্ষলতা গুল্মে পরিবৃত্ত, শ্বাপদসংকুল সন্ধিবিষ্ট এক বিশাল অরণ্যে আচ্ছাদিত। এই ভয়াল নিবিড় অরণ্য সুন্দরবন নামে বিশ্বনন্দিত।
সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার। এই আয়তন দিয়ে সুন্দরবনের সীমা নির্ধারণ করা হলেও এই সীমার বাইরে ছড়িয়ে আছে অনন্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র। প্রকৃতির এক অসীম বৈচিত্র্য ও শক্তির উদাহরণ সুন্দরবন।বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে অসংখ্য প্রাণী, উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণী বাস করে। বনটিকে বলা যায় একটি জীবন্ত ইকোসিস্টেম যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসীমতা প্রদর্শন করে।
অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় সুন্দরবন প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য জীবিকার মাধ্যম হলেও বন্যপ্রাণীসহ নানান কারণেই এ বন ছিল ভয়ংকর। তা সত্ত্বেও কে বা কারা এই ভয়ংকর রূপের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল তা অজানা। তবে সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে বেশকিছু দ্বিমত আছে। কেউ কেউ বলেন সুন্দরী গাছ থেকে এসেছে সুন্দরবন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক নিহরঞ্জন রায়ের মতে- চন্দ্র-দ্বীপবন তথা চন্দ্রবন থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয় । আগে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বাকরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অংশ। চন্দ্রদ্বীপের বনাঞ্চলকে 'চন্দ্রদ্বীপবন' বলা হতো। ত্রয়োদশ শতকের মধ্যভাগে পর্তুগিজরা এদেশে বসবাস করতে আসে। তারা চন্দ্রবনকে সুন্দরবন নামে উচ্চারণ করতো।
পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই অনন্য সুন্দরবন। সুন্দরবনের গাছের অনন্যতার মাঝে আছে বিশেষ ধরনের মূল যা কখনো অক্সিজেন গ্রহণে আবার কখনো গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে যা শ্বাসমূল এবং ঠেস মূল নামে পরিচিত। এই শিকড় বিন্যাস ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে অনন্য করে তুলেছে। লবণাক্ত ও মিষ্টি পানির মিশ্রণের মধ্যে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বনকে সহ্য করতে হয় লবণাক্ততা যা অন্য কোনো উদ্ভিদ ই পারে না। এই লবণাক্ততা সহ্য করার জন্য উদ্ভিদ লেন্টিসেলের মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ বের করে দেয়। সাগর ও স্থলের মধ্যে অবস্থিত এই বনকে প্রত্যেক দিন দুইবার করে জোয়ার ও ভাটা সহ্য করতে হয় । পানির গতিতে যেন তাদের বীজ ভেসে চলে না যায় তাই দেখা দিয়েছে বিশেষ ধরনের প্রজনন। গাছে থাকতেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটে । একে viviparous ও বলা হয়। এর মাধ্যমে বীজ লবণাক্ততা থেকেও মুক্তি পায়। এভাবেই বৃদ্ধি ঘটে ম্যানগ্রোভ বনের।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনে আছে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। ৫০ প্রজাতির প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ৩৫টি প্রজাতি ই রয়েছে এ বনে। প্রধান বৃক্ষ গুলো হল সুন্দরী, পশুর, ধুন্দুল , কেওড়া, বাইন, গেওয়া, গোলপাতা ইত্যাদি। সুন্দরবন শুধু উদ্ভিদের নয় প্রায় ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল। এরমধ্যে রয়েছে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর। 'সুন্দরবন' নাম শুনলেই আমাদের মনে পড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর কথা। এছাড়াও রয়েছে চিত্রা হরিণ , বানর, মায়া হরিণ, বুনো শূকর, শজারু, কুমির, কচ্ছপ, বন বিড়াল, ডলফিনসহ আরো অনেক প্রাণী। তাছাড়াও রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি। মাছরাঙা, মদনটাক, চিল, ঈগল, শকুন, বক, বাজ, ঘুঘুসহ নানান প্রজাতির পাখি সুন্দরবনকে করে তুলেছে আরো সুন্দর।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কে আরো রাঙিয়ে তুলেছে ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪২ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক। ভেটকি, ইলিশ, রুপচাঁদা, মাগুর, ফাইশ্যা, কাঁকড়া মাডস্কিপার শুধুই জীববৈচিত্র্য বাড়ায় নি বরং সরবরাহ দিচ্ছে অনেক মানুষের খাদ্য, পুষ্টি ও জীবিকা।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে সুন্দরবনের ভূমিকা বর্ণনাতীত। শুধু কি তাই! প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূল অঞ্চল রক্ষা, সুন্দরবন থেকে মাছ, গোলপাতা , মধু সংগ্রহ করে জীবন নির্বাহ করে অনেক মানুষ। প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের সাথে জড়িত। অন্য যেকোনো বনের চেয়ে সুন্দরবনের ক্ষতিকর কার্বন গ্রহণের ক্ষমতা অনেক বেশি, যার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ হচ্ছে। বাঘসহ অনেক বিপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আশ্রয়স্থল হচ্ছে সুন্দরবন। প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আসলেই উপকূলীয় বেড়া হিসেবে কাজ করে সুন্দরবন। এর মাধ্যমে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।শুধু আর্থিক, সামাজিক বা পরিবেশগত না বরং বিনোদনের জন্য ও সুন্দরবন অনন্য।
আজ সুন্দরবনের সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য সব ই হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত এর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে মানুষের কারণেই। বস্তুত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় কারণেই সুন্দরবন হুমকির সম্মুখীন। তবে সুন্দরবন ধ্বংসের প্রধান কারণ মানবসৃষ্ট।সুন্দরবনসংলগ্ন কৃষি কার্যক্রম প্রায় ১৭ হাজার ১৭৯ হেক্টর বন ধ্বংস করেছে। চিংড়ি চাষ ধ্বংস করেছে আরও ৭ হাজার ৫৫৪ হেক্টর। কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিমেন্ট কারখানা, অন্যান্য শিল্প প্রকল্পসহ সুন্দরবনসংলগ্ন ১৫০টিরও বেশি কারখানা বিশ্বের বৃহত্তম এ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলেছে। তাছাড়া বনদস্যুদের অপতৎপরতা, অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় কিছু লোভী ব্যক্তির দুর্নীতি, সরকারের উদাসীন মনোভাব, প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল নিয়োগ না দেওয়া, বনে অগ্নিসংযোগ, বাঘ হত্যা ও হরিণ শিকার, ব্যাপক হারে গাছ নিধন, বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ ধরা ইত্যাদি ধ্বংস করছে এ অরণ্য কে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে মিষ্টি পানির সরবরাহ কমে গিয়ে বনে লবণাক্ততা বাড়ছে। তার উপর এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে বিশাল এক কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদুৎ প্রকল্প- ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিতব্য ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এভাবে চলতে থাকলে এ বনাঞ্চল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের বিরুদ্ধে আর রুখে দাঁড়াতে পারবে না।
এত এত সুন্দরের মাঝেও সুন্দরবন নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তিত। কারণ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য আজ বিপন্ন। যে সুন্দরবন প্রায় ৩০০ বছর আগেও সমগ্র অঞ্চল ছিল অনন্য ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আচ্ছাদিত, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে ম্যানগ্রোভ নির্মূল করে উন্মুক্ত জমি তৎকালীন বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ডেকে আনা মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে বিদেশি সরকার পেয়েছিল রাজস্ব, অধিবাসীরা পেয়েছিল বাসস্থান। আর সুন্দরবন হারাতে শুরু করেছিল বহু হাজার বছরের বিবর্তনে গড়ে ওঠা পল্লবিত কুসুমিত ম্যানগ্রোভ ও প্রাণবন্ত অরণচারী। সে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এখনো চলমান। এতে মানুষের কোন সমস্যা মেটেনি, বেড়েছে অসহায়তা ,রোগ-শোক, জরা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অক্ষমতা।
সুন্দরবন রক্ষার্থে বাংলাদেশে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষায় "বন আইন ১৯২৭" এবং "জাতীয় বননীতি ২০১৬" কার্যকর রয়েছে।সুন্দরবনকে UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই মর্যাদা সুন্দরবনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংরক্ষণের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। তাছাড়া ও বনবিভাগের উদ্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রকমের সভা সেমিনারসহ নানান রকমের আয়োজন করে থাকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং সুন্দরবনে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ সময়ের দাবি। তাছাড়া সুন্দররবনের অভ্যান্থরে তেলবাহী জাহাজ চলাচলে মেনে চলতে পরিবেশবান্ধব নীতিমালা। ১৪ ফেব্রুয়ারি কে ঘোষণা করা হয়েছে সুন্দরবন দিবস হিসেবে। কিন্তু এসব উদ্যোগ হুমকির মুখে থাকা সুন্দরবন ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অপ্রতুল। দরকার সময় উপযোগী ব্যবস্থা ও জনসচেতনতা।
সুন্দরবন যত ঝুঁকির মুখে পড়বে, আমাদের বহুমাত্রিক সংকট ততই প্রকট হবে । এই বন যেহেতু বিশ্বঐতিহ্যের অংশ, সেহেতু এর সুরক্ষাদানে ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে।বনকে বাঁচাতে প্রশাসন কে নদী-খাল খনন, দূষণ ও দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বনের ভেতরে মানুষ কিংবা বনজীবীদের অবাধ যাতায়াত, চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন সুরক্ষা শুধু কয়েক হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয় নয়, সুন্দরবন গোটা বাংলাদেশ, উপমহাদেশ তথা বিশ্বের পরিবেশের সুরক্ষার জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য রক্ষাকবচ।সুন্দরবনের ধ্বংসের পেছনে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, ইচ্ছামতো গাছপালা কাটা এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাপ অনুঘটক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট অনুঘটকগুলো প্রতিরোধ যেমন জরুরি, তেমনি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজনে তাদের বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আরো সম্পৃক্ত করতে হবে। সুতরাং, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সরকার সুন্দরবন রক্ষায় টেকসই ও ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেবে-এটাই প্রত্যাশা।
সুন্দরবন বাংলাদেশের অক্সিজেন ব্যাংক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি বছর দক্ষিণাঞ্চলকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় আগ্রহী ভূমিকা রাখে সুন্দরবন। অনেক মানুষের জীবিকার উৎস বটে। বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র ও সুন্দরবন। তাই আমাদের সবাইকে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। জাতীয় সুন্দরবন দিবসের অনুপ্রেরণায় সুন্দরবন কে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আমাদের সচেতনতায় পারে হাজার বছরের পরিক্রমায় গড়ে ওঠা পল্লবিত কুসুমিত ম্যানগ্রোভ বনকে রক্ষা করতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ।