বিএনপিতে ত্যাগীদের স্থলে হাইব্রিডরা, শঙ্কা-সন্দেহ

সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান  © টিডিসি ফটো

‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয় অপ্রত্যাশিতভাবে জুড়ে বসাকে কেন্দ্র করে। যা দৃষ্টিকটুও। তারপরও এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে রাজনীতিতে। বিশেষ করে বিএনপিতে। এই তো কয়েক মাস আগেও দৃশ্যত দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল। কিন্তু, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শেখ হাসিনা ভারতে পালালে দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুঁজে বের করতে হচ্ছে লম্প জ্বালিয়ে। সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে তাদের বড় একটি অংশ বিএনপির দলে ভিড়েছে। কিছু ভিড়েছে জামায়াত বা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দলে। যা সুদূরপ্রসারী ভাবনায় রাজনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, অন্তত গত ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগে আর আদর্শিক রাজনীতি ছিল না। আবার আগামী ১০ বছর পর ওই দলছুট অংশটি অন্য দলে ভিড়বে না, এটা হলফ করে বলা কঠিন।

সেজন্য, মনে রাখতে হবে হঠাৎ কেউ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিএনপির চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া কিংবা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের গুণগান গাইলেই তিনি বিএনপির নেতাকর্মী বা সমর্থক হয়ে যাবেন না। বিএনপির মনে করার আগে তার গত দিনের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নে নিতে হবে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী হতে হবে। ভাবুন, যারা প্রকৃতপক্ষে বিএনপি বা জামায়াতের সমর্থন দিতেন, তারা দীর্ঘ সময় নানাভাবে আওয়ামী লীগ ও তাদের পোষা প্রশাসনের দ্বারা নির্যাতিত ছিলেন। এই নির্যাতনকারীরাই মূলত আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট হতে সহযোগিতা করেছে। যারা সহযোগিতা করেছে, তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। কেননা, নিজের আখের গোছানোর জন্য ওই সহযোগিরাই আবার বিএনপি-জামায়াত বা ছাত্রদের ফ্যাসিস্ট বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তাদের রাজনৈতিক নীতি বা আদর্শ নেই।

সব রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন, আদর্শ কিংবা নীতি থাকা জরুরি। এবং, অবশ্যই এ নীতি-আদর্শের বাস্তবায়ন থাকতে হবে মানুষে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে। আর যদি প্রকৃতপক্ষে এর বাস্তবায়ন না থাকে, তাহলে আবারও যেকোনো দল আওয়ামী লীগের মতো গণশত্রুতে পরিণত হতে পারে। সেজন্য সতর্ক থেকে কে হাইব্রিড, আর কে প্রকৃত দলপ্রেমী তা নির্ধারণ করতে হবে। নির্ধারণে ভুল হলেই বিপদ। কোনো রাজনৈতিক দল যদি তার প্রকৃত নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দলটির সাসটেইন করা কঠিন হয়ে পড়ে। 

বিএনপি গণমানুষের রাজনৈতিক দল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত ৩১ দফা ধারণ করলে কোনো নেতা বা কর্মীর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু, বিএনপির এখন বড় সমস্যা ওই প্রায় ৭০ শতাংশ আওয়ামী লীগারের অনেকে হঠাৎ বিএনপির সঙ্গে মিশে যাওয়া। তাদের আশ্রয় ও বেপরোয়া কাজের বৈধতা দেওয়া এক বড় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে প্রবেশ করা ওই বড় অংশ জানে কীভাবে লুটপাট করতে হয়, ভোট ডাকাতি করতে হয়, টেন্ডার বাণিজ্য করতে হয়; সর্বোপরি কীভাবে জনগণের অধিকার হরণ করতে হয়। মোদ্দাকথা, তারা জানে কীভাবে পরিশ্রম ছাড়া অর্থ আয় করতে হয়। ওদের কাছে এখন টাকাও রয়েছে। কারণ, ওরা আওয়ামী আমলে প্রচুর অবৈধ অর্থ আয় করেছে। আর তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে যদি দলীয় ত্যাগী বা পরিশ্রমীরা কোণঠাসা হয়ে যায় বা হতাশ হয়ে দূরে সরে যায়; তা হবে দুঃখজনক। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ত্যাগীদের জায়গা স্থায়ীভাবে দখল করে নেয় হাইব্রিডরা।

ফ্যাসিবাদ চক্র ও তাদের দোসররা মিলে গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের জনগণের ওপর পাকহানাদার বাহিনীর মতো নির্যাতন নিপীড়ন করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি। দু:শাসন, অপশাসন, ভোট ডাকাতি, লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা, গুম থেকে শুরু করে আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের অবতারণা করেছিলো। জনগণের কণ্ঠরোধ করে দাবিয়ে রাখা হতো। জামায়াত-শিবিরের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানসিক নির্যাতন করা হতো। এমন নির্যাতক গোষ্ঠী বাংলার ইতিহাসে কখনো আসেনি। এই অসভ্য শাসক গোষ্ঠীর কথা আগামী কত বছরেও মানুষ ভুলতে পারবে না তার ঠিক নেই।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইস্পাত কঠিন গণঐক্য, ব্যাপক জনভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি, আত্মনির্ভরশীলতা, প্রগতি অর্জন, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ আধিপত্যবাদের বিভীষিকা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি গঠিত হয়েছিলো। সেই উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে রাজনীতি করার কারণে এখনো দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে আছে বিএনপি। মাঝে কিছু সময়ে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ার কারণ কী সেটি বিএনপির নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ বা দর্শন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা ছাড়াই বড় একটি অংশ দলটির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কে আওয়ামী লীগ, কে জামায়াতে ইসলামী সেটি যাচাই-বাছাই করবার ন্যূনতম ক্ষমতাও তাদের নেই। সম্ভবত বিশেষ সুবিধার আশায় তারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত ১৯ দফা এবং তারেক রহমানের প্রবর্তিত ৩১ দফা সম্পর্কে অনেকের জানাশোনা নেই। পড়াশোনা নেই নেতা-কর্মীদেরও। উগ্র অসাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মধ্যম ধারা হলো উদারপন্থী। মোটাদাগে এই উদারপন্থী বা মধ্যমপন্থী রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী বিএনপি।

আওয়ামী লীগের বিকল্প মানেই বিএনপি নয়, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। দল টিকিয়ে রাখতে হলে আগে দরকার দলের নীতি বা আদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট বলে বিএনপিকে ফ্যাসিস্ট ভাববার কোন কারণ নেই। অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে তুলনা করে বিশেষ সুবিধা নিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতে ইসলামী মানেই ইসলাম নয়’। ব্যাপারটি বিএনপির অনেকেই ভালো করে জানেন না। ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের পর বিএনপিতে প্রচুর জামায়াতের অনুপ্রবেশ ঘটে। জামায়াত-শিবির বিএনপির হয়ে যায়। এই হয়ে যাওয়ার রাজনীতি বিএনপিতে বহমান। অনেকেই বলে থাকেন জামায়াতে ইসলামী বিএনপিতে অনেক শক্তিশালী। ছদ্মবেশী রাজনীতির ভয়াবহতা আগে বুঝতে হবে। ছদ্মবেশী রাজনীতি প্রকৃত আদর্শের পতন ঘটায়। ছাত্রলীগ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি বিষয় আগে বুঝতে হবে, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ইসলামী বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তবে হ্যাঁ জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘদিন জোট ছিল। সেটি নির্বাচনী জোট। এখন সেই জোটের কার্যকারিতা নেই। আন্দোলনের বা নির্বাচনের প্রয়োজনে জোট হলে সেটি রাজনৈতিক জোট হলেও আদর্শিক জোট নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জামায়াত করেনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ১৯৮৬ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরশাদকে ক্ষমতার বৈধতা দিয়েছিল। এরশাদের দল ক্ষমতায় যায়, আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে। জামায়াত হয় বলির পাঠা। একইভাবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলো জামায়াত। ফলাফল, আওয়ামী লীগের ২১ বছর পর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। এসব ইতিহাস বিএনপির তৃণমূলকে জেনে রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন নির্যাতক পাকিস্তান সরকারের সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল জামায়াতে ইসলামী। সেই বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দলটি আজ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনাও করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে আওয়ামী লীগ চেতনার ব্যবসা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করে।

বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললেই শুনতে হয়, ওমুক এটা করছে, তমুক সেটা করছে, আমি তো কিছুই করতে পারছি না। আমাকে তো কোথাও দেওয়া হচ্ছে না, আমার কিছুই ভালো লাগে না। আর রাজনীতি করব না, রাজনীতির সঙ্গে থাকব না। অনেকের ভেতর হতাশা আর হতাশা। অন্যের প্রাপ্তি থেকে না পাওয়ার বেদনা। তবে মনে রাখতে হবে, রাজনীতি অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়। প্রাপ্তির জায়গা নয়। যারা রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবে, তারা ভুল পথে রয়েছে। বিগত ফ্যাসিবাদ সরকার যেটি করেছে সেটির পুনারাবৃত্তি আর হবে না। ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আজ আওয়ামী লীগ জনধিকৃত, জনবিচ্ছিন্ন। জনগণের কাছে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত। কেউ কেউ মজা করে বলে থাকেন, কেবল শেখ হাসিনা নয়, পুরো আওয়ামী লীগই ভারতে পালিয়ে গেছে। 

রাজনীতি বলতে সেইসব নীতিকে বলা হয়, যেসব নীতি অনুসরণের মাধ্যমে একটি জাতি বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। রাজনীতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজনীতি হলো একটি আদর্শিক প্লাটফর্ম। এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে রাষ্ট্র এবং মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। যে প্লাটফর্ম গুম, হত্যা, শত নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করে একটি ফ্যাসিবাদকে পতন ঘটাতে কার্পণ্যবোধ করে না। আদর্শিক রাজনীতি এবং যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ফ্যাসিবাদ পতন করে ঘরে ফিরতে পারে।

রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে নেতারা (পরিবর্তনে যাদের ভূমিকা ছিল না) যখন আদর্শিক প্লাটফর্মের বাইরে থেকে পছন্দ করেন তখন হতাশা তৈরি হয়। কষ্টের মাত্রা বাড়ে। রাজনীতির প্রতি ঘৃণা জন্মে। এই পরিস্থিতি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ছাত্র-জনতার পট-পরিবর্তনকালে কিছু কিছু নেতা কোনোভাবেই ছাত্র আন্দোলনে ছিলেন না। বা সর্বশেষ ৬ মাস কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি করেননি অথবা জেলখানায় ছিলেন কিন্তু শরীরে লাগানো বড় পদ, পট-পরিবর্তনের পর তাদের অতিরিক্ত হিরোগিরিতে বিরক্ত সবাই। এসব থেকে হতাশা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু এই হতাশা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে হবে না। প্রতিবাদ করতে হবে। যুক্তি, ন্যায়, নীতি এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে দাবি তুলতে হবে।

বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীকে বুঝতে হবে, এই দলের রাজনীতি কারোর কাছে ইজারা দেওয়া হয়নি, যে ইচ্ছে খুশিমতো যা তাই করে ফেলবেন। ধর্মের কল বাতাসে নড়ের মতো দেখবেন ওই অসৎ চক্র তাদের কর্মকাণ্ডে পরাজিত হবে, বিতর্কিত হবে। ব্যুর্জোয়া রাজনীতিতে হ্যান্ডমগিরি বেশিদিন থাকে না এবং টিকবেও না। যারা নিজেদের বিশাল হ্যান্ডম দেখিয়ে ফ্যাসিবাদের দোসরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অর্থ উপার্জনে আছেন তাদেরও পতন হবে। তারাও ধ্বংস হবে। দলের ভেতরে তাদের পতন ঘটাতে হলে নিজেদের হতে হবে সত্য, নিষ্ঠাবান এবং পরিচ্ছন্ন। হতাশামুক্ত থেকে সুস্থ ধারায় চর্চা ঘটাতে হবে। অল্প হতাশায় যারা রাজনীতির শেষ দেখে ফেলেন তারা কিন্তু রাজনীতি বোঝেন না। রাজনীতি হলো সাধনা, গভীর ভাবনার জায়গা। এর জন্য দরকার নিজেকে সৎ রাখা, সকল অন্যায়, অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা। সঠিক পথে থাকলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়।

আমরা ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়েছি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য। প্রতিটি মানুষের প্রাপ্ত অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আগে থানার ওসি নেতার বাসায় বা আত্মীয়দের সাথে সখ্য থাকতো বলে আবারো সেই পথ অনুসরণ করতে হবে কেন? বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিগত সময়ে জেলা বা থানা প্রতিনিধি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো বলে তা বাতিল করে আবার পুরাতন নীতি অনুসরণ করতে হবে কেন? জেলা পিপি, অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপি নিজেদের কোটায় বা আত্মীয় স্বজন নিয়োগ দিতে হবে কেন? দলের ত্যাগীদের কথা কি মনে পড়ে না? দলের ভেতরে কেন নেতার পরিবারের সদস্যদের বাহাদুরি বা প্রভাব বিস্তার করে ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে? কেন ত্যাগী কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে হবে? আপনারা কি জানেন, ত্যাগীরা মাঠে ছিল বলে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। ত্যাগীরা যখন মাঠে ছিল, তখন নেতা জেলে নতুবা পলাতক আর আত্মীয়রা আরাম আয়েশে ফ্যাসিবাদের সাথে তাল মিলিয়েছে। পরিস্থিতি পরিবর্তনে নেতার বা তার পরিবারের দাপটে প্রকৃত ত্যাগীরা কোণঠাসা। কোনো জায়গায় প্রকৃত কর্মীরা নেতাকে বললে, নেতারা জবাব দিচ্ছেন আরেকজনের জন্য বলেছি। সেই আরেকজন নেতার আত্মীয়। এসব আত্মীয়দের কিন্তু বিগত আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে দেখেনি। এতো আত্মীয়প্রীতি দেখালে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে সময় লাগবে না। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানো হয়েছে আত্মীয়করণের জন্য নয়।

ফ্যাসিবাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর সুযোগ নেই। ফ্যাসিবাদ দোসরদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। জাতির সামনে প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং আইনানুগ শাস্তি ভোগের আগ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের সাথে সখ্য রাখা মানেই বিগত জুলাই-আগস্টের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা। ফ্যাসিবাদ পতনে যাদের ন্যূনতম কোনো অবদান নেই, তাদের একটি অংশ অর্থলোভে ফ্যাসিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। শহীদের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন। অনেক নেতা টাকার বিনিময়ে বড় বড় ফ্যাসিস্টকে সীমান্ত দিয়ে দেশপাড়ে সহযোগিতা করেছেন। ফ্যাসিবাদ আন্দোলনে পলাতকরা স্থানীয় ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যে ফিরে মহারাজা হয়েছেন। ফ্যাসিবাদ সহযোগিতা করে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। যারা এসব অন্যায় এবং জঘন্য কাজ করেছেন তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। একইসঙ্গে মিডিয়ার অগোচরে স্বর্ণের দোকানে লুটপাট, ঘের দখল, ফেনসিডিলের চালান গায়েব, সংখ্যালঘু নারীকে ধর্ষণের মতো অমানবিক নিষ্ঠুর কাজও সংঘটিত হয়েছে। আপনি যত বড় নেতা হোন না কেন আপনিও ফ্যাসিস্ট সহযোগী হয়ে যাবেন। নিজেকে পুনরায় ফ্যাসিস্ট হিসেবে গড়ে তুলবার পরিণাম কঠিন হবে, এটি নিশ্চিত করা যায়।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান বারবার বলেছেন, ‘আমাদের কিছু কিছু নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি চিন্তা ঢুকে গেছে, বোধহয় আমরা ক্ষমতায় চলে গেছি। আপনাদের সবাইকে দৃঢ়ভাবে বলব, আমরা ক্ষমতায় যাইনি। আমরা ক্ষমতায় যাব কি না, জানি না। তখনই আমরা ক্ষমতায় যেতে পারব, যখন আমরা বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন পাব। কাজেই জনগণের সমর্থন আমাদেরকে আদায় করতে হবে। আপনার কথা, আপনার কাজ, আপনার ওঠাবসা, আপনার চলাফেরা সবকিছুর ওপর নির্ভর করছে বিএনপির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আপনাকে মানুষ বিএনপি হিসেবেই চেনে। আপনার সবকিছু এমন হতে হবে, যাতে জনগণের সমর্থন আপনার প্রতি, আপনার দলের প্রতি থাকে। দলকে রক্ষা করা, দলকে সামনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার একার নয়, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নয়, দায়িত্ব আমাদের সবার।’

আগামীর বাংলাদেশ হবে জনগণের। ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির। হবে অন্যায়, অনিয়ম এবং শোষণমুক্ত বাংলাদেশ। সবার আগে বাংলাদেশের সৃষ্টিকে ধারণ করতে হবে। এরপর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের অগ্রগতিতে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো আর কেন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান হয়েছিলো, সেটি ভাবতে হবে। এই চেতনা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারলে কখনো পথহারা হবে না বিএনপি, পথহারা হবে না বাংলাদেশ।

লেখক : রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক


সর্বশেষ সংবাদ