বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে আধুনিক ও সময়োপযোগী উদ্যোগে নতুন ভিসিরা নজর দিবেন কি?

ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ
ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে একটি পরিবর্তনশীল বিশ্বের মুখোমুখি, যেখানে প্রযুক্তির উন্নয়ন, গ্লোবালাইজেশন এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির চাপ ক্রমবর্ধমান। এই প্রেক্ষাপটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভিসির কৌশলগত নেতৃত্বের মাধ্যমে একাডেমিক উৎকর্ষতা অর্জন, শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। 

আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তা অনুসরণ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আধুনিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন স্ট্যানফোর্ড এবং এমআইটির মতো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের উদ্ভাবনী শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ের কারণে এগিয়ে রয়েছে।  তবে, শুধুমাত্র আধুনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই চলবে না, ভিসিকে সেই পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিশ্চিত করতেও হবে।

যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্যই হলো অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স নিশ্চিত করা অর্থাৎ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা এবং গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। ভিসির নেতৃত্বে শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অপরিহার্য। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (NUS) এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে যেখানে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশেও বাস্তবায়িত হলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানের একাডেমিক এক্সেলেন্স অর্জনে সক্ষম হবে। নতুন নিয়োগকৃত ভিসিদের প্রথম ও প্রধান কাজই হবে অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স নিশ্চিত করা। 

দ্বিতীয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক কার্যক্রমে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা সবসময় তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদেরও প্রশাসনিক স্বাধীনতা বজায় রেখে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করা উচিত, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেন। ভিসিকে অবশ্যই একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সিনেট, সিন্ডিকেট এবং একাডেমিক কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ভূমিকা নিশ্চিত থাকে। এই কাঠামোগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করলে রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা কমে যায়।

এছাড়াও, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষকদের যোগ্যতা এবং শিক্ষার্থীদের মেধার উপর। প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী আকর্ষণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT) মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নিয়োগ করে, যা তাদের গবেষণা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বমানের ফলাফল আনতে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করে মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে GST গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে ভিসিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে: এই নতুন পদ্ধতি কি সত্যিই মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম? ভিসিদের উচিত এই প্রশ্নের গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করা যে, এই পদ্ধতি আমাদের উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখতে এবং সঠিক মেধাবী শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে কতটুকু কার্যকর। অন্যথায় ভিসিদের পক্ষে অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। 

তৃতীয়ত, গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন এবং গবেষণা পরিবেশ নিশ্চিত করা ভিসিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য বিশাল তহবিল সংগ্রহ করে, যা তাদেরকে বৈশ্বিক গবেষণায় অগ্রণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তদ্রূপ, বাংলাদেশেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সংগ্রহ করতে হবে, যাতে শিক্ষকেরা গবেষণা করতে উৎসাহিত হন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মান অর্জন করতে পারেন।

একইসাথে, বর্তমান বিশ্বে ডিজিটালাইজেশন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার সম্প্রসারণ, ই-লার্নিং টুলসের ব্যবহার এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সুবিধা শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে আরও সহজলভ্য করবে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করবে। 

একইভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজেও ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি সম্ভব। বিভিন্ন সফটওয়্যার এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভর্তি, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজগুলো আরও সহজ এবং স্বচ্ছ করা যেতে পারে। যেমন, MIT তাদের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে, যা শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের সময় এবং শ্রমের অপচয় কমিয়ে এনে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করছে।

তাছাড়া, বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে ট্রান্সডিসিপ্লিনারি শিক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করলে শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ট্রান্সডিসিপ্লিনারি পাঠ্যক্রম পরিচালনা করছে, যা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ ধরনের পাঠ্যক্রম চালু করা হলে, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। ভিসিদের ট্রান্সডিসিপ্লিনারি শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে নজর দিতে হবে। 

চতুর্থত, আজকের বিশ্বে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের জন্য এন্টারপ্রেনারশিপ সেন্টার চালু করেছে, যা নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ ধরনের উদ্যোগ চালু করে শিক্ষার্থীদের নতুন উদ্ভাবনী প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। একইভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিবেশ সচেতন করার লক্ষ্যে গ্রিন ক্যাম্পাস ইনিশিয়েটিভ গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া তাদের ক্যাম্পাসের সবুজায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশেও এই ধরনের প্রকল্প হাতে নিলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠবে।

পরিশেষে, বর্তমান যুগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন এবং এগিয়ে যাওয়া আধুনিক ও সময়োপযোগী উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল। ভিসিরা যদি আন্তর্জাতিক মানের উদাহরণ অনুসরণ করে তাদের কৌশলগত নেতৃত্ব পরিচালনা করেন, তবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক উৎকর্ষতা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবেন। স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি, হার্ভার্ড এবং অন্যান্য বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানগুলোর সফল পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিজিটালাইজেশন, ট্রান্সডিসিপ্লিনারি শিক্ষা, উদ্যোক্তা শিক্ষা, এবং পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে নজর দিয়ে তাদের নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে।

এছাড়া, সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সংগ্রহ করে গবেষণার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। এইসব উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানের শিক্ষার সাথে সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হবে এবং দেশের উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। সবশেষে, ভিসিদের আধুনিক প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী চিন্তার সাহায্যে একাডেমিক সাফল্য ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হলে, তাদের অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একসাথে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ হবে।

লেখক: ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ। সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। Email: mourtuza@ku.ac.bd


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence