বিসিএস ক্যাডার ছেড়ে পুলিশের এসআই হলেও আশ্চর্য হবো না

ড. কামরুল হাসান মামুন
ড. কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশ বেতারের গবেষণা ও গ্রহণ কেন্দ্রের সহকারী বেতার প্রকৌশলী একজন বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। এটি বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ ও ট্যাক্স ক্যাডারের সমমানের। পার্থক্য হলো প্রশাসন, পুলিশ ও ট্যাক্স ক্যাডারের মত শক্তিমত্তা দেখানো বা দুর্নীতির সুযোগ প্রায় নাই বললেই চলে। তাই বিসিএস তথ্য ক্যাডারের এক কর্মকর্তা তথ্য ক্যাডার ছেড়ে নন-ক্যাডারের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। যেই চাকরিতে তিনি যোগ দিয়েছেন সেটি নন ক্যাডার একটি সাব রেজিস্ট্রারের চাকরি।

আমার বাড়ির পেছনেই ছিল উপজেলা সাব রেজিস্ট্রারের অফিস। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি এটি ছিল ঘুষ দুর্নীতির আখড়া। এখানে হ্যাডম নাই কিন্তু টাকা আছে।

উপরের এই সংবাদটি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় খুব ফলাও করে প্রচার করছে, যেন এটিই প্রথম ঘটেছে। কেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে এই কাজ সবসময় করে আসছে সেটা কি কখনো সংবাদ হয়েছে? হয়নি। কারণ হলো আমরা ধরেই নিই শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রশাসন, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডারে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

তাই শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি পেয়েও অনেকেই পরেরবার বা যতবার সুযোগ থাকে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা ততবার বিসিএস দেয় যদি প্রশাসন, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডার পেয়ে যায়। অনেকে পায়ও এবং শিক্ষা ক্যাডার ছেড়েও যায়। শুধু বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছেড়েও ওই তিন ক্যাডার ছেড়ে চলে যাওয়ার নজির আছে।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন বেশ কয়েকজন কলেজ বন্ধু সেখানে পড়তো। তাই জাহাঙ্গীরনগরের সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমি যখন কেবল মাস্টার্স পাস করি তখন জানলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক চাকরি ছেড়ে বিসিএস ট্যাক্সে চলে গেছেন। পরে শুনেছিলাম সে নাকি টাকার পাহাড় বানিয়েছে।

এর আগে আমরা জেনেছি পাকিস্তান আমলে অনেক মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সিএসপি (Civil Service of Pakistan (CSP)) প্রশাসনে যেতেন। কিন্তু কেউ ট্যাক্সে যেতেন এমন শুনিনি। বাংলাদেশ হওয়ার পর বিসিএস ট্যাক্স বেশ জনপ্রিয় হয় এবং তার একমাত্র কারণ ঘুষ দুর্নীতির সুযোগ। এরপর আসে পুলিশ।

আমি তখন এত বুঝতাম না। কেবল বুঝতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়ে ভালো চাকরি পৃথিবীতে আর হয় না। আমি তখন ভাবতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার এমন চাকরি যেখানে থেকে জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ থাকে। থাকে সারা জীবন শেখার সুযোগ। সারা জীবন ধরে শিখে শিখে নিজেকে উন্নত করব আবার তার জন্য বেতন পাব। এর চেয়ে ভালো চাকরি আর কি হতে পারে। তাই সেদিন বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম।

এখন বর্তমান সামাজিক অবস্থান থেকে বলা যায় অনেকেই বিসিএস ক্যাডার ছেড়ে পারলে পুলিশের এসআই হলেও খুব আশ্চর্য হবো না। শিক্ষকতা চাকরি ছেড়ে অন্য ক্যাডারে যোগ দিলে কোনো সংবাদ হয় না। কিন্তু তথ্য ক্যাডার ছেড়ে সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগ দেওয়ায় এদের অহমবোধে বড্ড লেগেছে। 

বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডারে চাকরির জন্য সবাই এত পাগল কেন সেটা কি বাঙালি জানে না? বাংলাদেশটাই আজ এমন হয়ে গেছে যে সবার মনের মধ্যে বেনজির হওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা বিরাজ করে। সবাই বিসিএস প্রশাসন চায় যেন পাজেরো গাড়ি পায়, অসংখ্য মিটিং-এর সিটিং মানির ইনভেলাপ পায়, গাড়ির তেল পায় এবং অঢেল টাকা কমানোর সুযোগ পায়।

একবার শুধু খোঁজ নিয়ে দেখেন বাংলাদেশের কাদের সবচেয়ে বেশি বাংলো বাড়ি আছে, কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি আছে। তাহলেই সব ফকফকা হয়ে যাবে।

শুধুই কি বিসিএস প্রশাসন, পুলিশ বা ট্যাক্স ক্যাডার? বাংলাদেশে এখন সরকারি দলের রাজনীতি করার জন্যও মানুষ পাগল। সরকারি দলের কোন একটা পদ পেতে মানুষ এখন মুখিয়ে থাকে। এর জন্য তেলামি তোষামোদি যা করার দরকার সব করে।

নির্বাচন আসলে দেখা যায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মানুষগুলো পর্যন্ত তাদের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে ট্রাকে করে নির্বাচনী প্রচারণায় নামে। সংসদ নির্বাচনের কয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত লিফলেট নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ক্যাম্পেইন করে। এই সবই করে কিছু পাওয়ার আশায়। এটা করতে গিয়ে যে শিক্ষকতা পেশাটাকে নিচে নামিয়ে ফেলছে সেই দিকে সামান্যতম ভ্রূক্ষেপ নাই। আসলে ঘুমিয়ে আছে দুর্নীতির বীজ বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের অন্তরে। আর তাইতো ক্ষমতাবান আর অর্থবানদের সমাজে এত কদর।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence