জেল হত্যা দিবস: বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কময় একটি দিন

প্রফেসর ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর
প্রফেসর ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর  © টিডিসি ফটো

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত একটি অধ্যায়ের নাম জেল হত্যাকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি এবং এ দেশের তৎকালীন একটি কুচক্রীমহল বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এরপর ষড়যন্ত্রকে চূড়ান্ত রূপ দিতে এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে হত্যা করা হয় চার নেতাকে। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন দেশমাতৃকার সেরা সন্তান এই জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব। কারাগারে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ যাতে ঘুরে দাঁড়িয়ে আর এগোতে না পারে, স্বাধীনতা যাতে ব্যর্থ হয়, বাংলাদেশ যাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় সেই চক্রান্ত করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র অগ্রসর হয়। এরই অংশ হিসেবে এবং এ দেশে যাতে কোনদিন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার, হত্যা, নির্যাতনের ষড়যন্ত্র শুরু করে একটি গোষ্ঠী। সেই ষড়যন্ত্র থেকেই জেলখানার ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে তারা।

যে কয়েকটি ঘটনা বাংলাদেশকে কাঙ্খিত অর্জনের পথে বাধা তৈরি করেছে, তার মধ্যে জেল হত্যা অন্যতম। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী এই চার নেতা বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই জাতীয় চার নেতাই বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন।

জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭১'এর ১৪ ডিসেম্বর ঘটেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে ফেলার মহাপরিকল্পনা হিসাবে প্রথমে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো অত্যন্ত নৃশংভাবে। যে মহানায়কের প্রত্যক্ষ অবদানে বিশ্ব মানচিত্রে সগর্বে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল একটি নতুন দেশ, একটি নির্দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের লক্ষ বীর সন্তান, হাসিমুখে জীবন দিতে পিছপা হয়নি, ছিনিয়ে এনেছিল একটি স্বাধীন পতাকা, সেই মহান নেতাকে, বাংলাদেশের স্থপতিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলোনা নরপশুরা। এবার তারা মনোযোগ দিল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী  বঙ্গবন্ধুর সহচরদের প্রতি।

নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। কিন্তু যুদ্ধরত জাতি নেতৃত্বশূন্য ছিলনা। বঙ্গবন্ধুর সহচর যে চার মহান নেতা, সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে হাল ধরেছিলেন তাঁরা হলেন– সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম  মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহচর। ৭১' এর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি হানাদারেরা ব্যাপক ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দেশ জুড়ে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ধানমন্ডির বাসভবন থেকে। গ্রেপ্তারের  আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ  দিবাগতরাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ই পি আর এর একটি ছোট ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। পাকিস্তানি সামরিকজান্তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পরে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু  না , জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে  হাল ধরার জন্য এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী এবং সহযোগী বন্ধুরা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসরন করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।

১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের  প্রথম সরকার গঠন করা হয়, একটি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁর অন্যতম সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। সরকারের অন্যান্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন  আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামান। কর্নেল এমএজি ওসমানীকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও পাঠ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম অনুযায়ী বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মুজিবনগর। তখন যদি এই চার নেতা শক্ত হাতে হাল না ধরতেন তবে আমাদের সেদিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার, নিপীড়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে বিশ্বজনমতের সমর্থন, প্রতিবেশি ভারতে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয় সুনিশ্চিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষনের জন্য ভারতকে রাজী করানো, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় দেশস্বাধীন করার মতো দুরূহতম কাজ তাঁরা সম্পাদন করেন অত্যন্ত সুষ্ঠু এবং সফলভাবে। এই সরকারের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়।

শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। ঘাতক চক্রের লক্ষ্য ছিল বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের পদানত করে মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে আটক করে রাখার পর যে চার নেতা বঙ্গবন্ধুর হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন, সেই জাতীয় চার নেতাকেও বঙ্গবন্ধুর মতো নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার 'বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড' গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরপরেই জেলে জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমনভাবে নেওয়া হয়েছিল যাতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আপনা আপনি এটি কার্যকর হয়। আর এ কাজের জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয়। এই ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা করবে।
 
মানবতাবোধের চরম নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হচ্ছে ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। দেশের আপামর জনতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যাদের নেতৃত্বে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশকে স্বাধীন করেছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে, এ দেশের জনগণকে একত্রিত করে ও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করে বিজয়ের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছেন, সেই জাতীয় চার নেতাকে চরম নির্মমতার স্বাক্ষর রেখে ৩ নভেম্বর কারাগারের ভেতরে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হয়। জেলহত্যা দিবসে দেশবাসীর আশা, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মতো জেল হত্যাকাণ্ডের মামলার রায়ে মৃত্যুদ্ণ্ড প্রাপ্ত সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের খুঁজে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই দেশ হবে কলঙ্কমুক্ত। আজ এই চার জাতীয় নেতার মৃত্যুদিনে এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক: ট্রেজারার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ