শিক্ষায় ‘উল্টোপথে’ বাংলাদেশ

শিক্ষায় ‘উল্টোপথে’ বাংলাদেশ
শিক্ষায় ‘উল্টোপথে’ বাংলাদেশ  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে শিক্ষার সর্বস্তরে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির সুস্পষ্ট প্রতিফলনের সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক স্তর থেকেই বিজ্ঞান ও কৃষিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়ার কথাও ছিল সেখানে।

সেই বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষককে ফাঁসিয়ে দিতে এমন সব প্রশ্ন করে কথা রেকর্ড করেছে স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীরা, যেসব প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিক্ষককে সাম্প্রদায়িক ইস্যু তৈরি করে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম এবং নওগাঁয়ও হয়েছে। শিক্ষকের উপর নানাভাবে হামলার রয়েছে আরো উদাহরণ।

মুক্তিযুদ্ধের পর পার হয়েছে ৫০ বছর। প্রথম শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের আলোকে শিক্ষায় বৈসাদৃশ্যগুলো ঘোচানোর পরিবর্তে দীর্ঘ এই সময়ে তা বেড়েছে বহুগুণ। শিক্ষার পরিমণ্ডলে নানা কিছু নিয়ে হাজির হয়েছে অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও, যার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে সাম্প্রদায়িকতা-শ্রেণি ঘৃণা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম আজীবন শিক্ষা নিয়েই কাজ করেছেন। একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার জন্য নানা সময় আন্দোলনের মাঠেও ছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশ তো দূরের কথা, আরো বহু দেশ সেই একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করেনি। কারণ, রাষ্ট্রটা সবার নয়। একটি শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সেই শ্রেণি তার নিজের স্বার্থে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত করছে।’’

‘‘পাশের দেশে টোলভিত্তিক শিক্ষা উঠে গেলেও বাংলাদেশে মাদ্রাসা আরো বিকশিত হয়েছে,’’ বলেন এই শিক্ষাবিদ।

সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাদেকা হালিম বলেন, ‘‘সাধারণের ধারণা ছিল, শিশুরা পরিবার বা মাদ্রাসা থেকে ধর্মান্ধতা শেখে। গবেষণায় এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা চলে এসেছে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও।’’

আরও পড়ুন: চবিতে বেড়েছে স্থানীয়দের ক্ষোভ, নিরাপত্তাহীনতায় শিক্ষার্থীরা

একজন মনোবিজ্ঞানী বলছেন, শিশুদের শিক্ষাকে ঠিকঠাক রাখতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি, মিডিয়া- এই চার জায়গাকেই ঠিকঠাক রাখতে হবে। বাংলাদেশে এই চার জায়গাতেই নানা সমস্যা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

কী ছিল কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশনে?

স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সুপারিশকে যুগান্তকারী বলে মানেন দেশ-বিদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল:

ক. রাষ্ট্রের চার মূলনীতি শিক্ষার সর্বস্তরে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে হবে।
খ. সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে বাংলা।
গ. প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং সার্বজনীন। ১৯৮০ সালের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণি এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করতে হবে।

ঘ. প্রাথমিক স্তর থেকেই বিজ্ঞান ও কৃষিকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে।
ঙ. নবম শ্রেণি থেকে ভোকেশনাল শিক্ষা শুরু হবে, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সুযোগ উচ্চতর স্তরে বাড়াতে হবে।

চ. সর্বস্তরে কর্মভিত্তিক কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
ছ. ১৯৮০ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে।
জ. মূল্যায়ন পদ্ধতি বদলে ফেলতে হবে।
ঝ. সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলতে হবে।

‘বাচ্চাদের শেখার দুনিয়া’

বাচ্চাদের শেখার দুনিয়া নিয়ে কথা বলেছেন দেশে-বিদেশে নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মনোবিজ্ঞানী ফজিলাতুন নেসা।

তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষা কোনো একক বিষয় না। আমরা সব সময় বলি, শিশুরা পরিবার থেকেই শিখবে। পরিবার হচ্ছে আসল শিক্ষাগার- এটা সত্য। একটা বয়স পর্যন্ত শিশুরা পরিবার থেকেই শেখে। কিন্তু শিক্ষাটা হচ্ছে কম্বিনেশন অব অল। এখানে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি, মিডিয়া- এ রকম বড় প্রভাবক আছে। এই চার জায়গা ভালোভাবে কাজ করলে একটা শিশু ভালোভাবে শেখে।’’

‘‘৫০টা বাচ্চা ৫০ রকম পরিবারে বড় হলেও স্কুলে গিয়ে তারা একটি ‘কমন’ পরিবেশ পায়’’- এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এই সোশাল ইন্টারেকশনটা একই রকম করে করার কাজটি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘পাশাপাশি সে যে কমিউনিটির, সেই কমিউনিটির আচার আচরণ কৃষ্টি সংস্কার-কুসংস্কার, সবই শিশু কিশোররা শিখতে থাকে। মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকাও তাদের জীবনে আছে। সেটা প্রিন্টিং মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- যে কোনো কিছু এটা হতে পারে।’’

‘‘বয়সের উঠতি সময়ে শেখার প্রক্রিয়াটা আসলে একটু ভিন্ন হয়। অনেক কিছু ওরা সহজভাবে নিতে পারে না। অনেক কিছু শিখতে চায় না। নিজেরাই মনে করে, আমরা অনেক কিছু জানি। এ সময় ওদের বাবা-মায়ের প্রতি মমত্ব কমে আসে। ওরা আর্গুমেন্টেটিভ হয়। খুব স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যায়। ওদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ থাকে এই সময়টুকুতে। এটাকে আমরা একটা জাংশন বলি। ছোট বেলার সাথে বড় বেলার মাঝখানে ব্রিজ হিসাবে কাজ করে এডোলেসেন্ট সময়টা।’’

‘‘এই সময়কে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। বয়স ১০-১২ বছর, ১৩-১৯ বছর এবং ২০-২৩ বছর পর্যন্ত, এটা লেট অ্যাডোলোসেন্ট। এই সময়ে ওরা নিজেদেরকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মরে করে, আলাদা আইডেন্টিটির মনে করে। এই সময়ে ওরা অবশ্যই শেখে। তবে শেখার ধরনটা ওরা খুব ভালো শেপ দিতে পারে না, যদি না ওদের ভালোভাবে গাইড করা যায়।’’

শেখার মাধ্যম হিসাবে অনলাইন-সামাজিক মাধ্যম

শেখার মাধ্যম হিসাবে ঘুরে ফিরে সামাজিক মাধ্যমের কথা এসেছে বিশেষজ্ঞদের কথায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম এ বিষয়ে কথা বলেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড সেন্টার ও কাউন্টার টেরোরিজমের সাথে সমন্বয় করে করা একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এতে আমরা দেখেছি, আমরা মনে করতাম, একটা শিশু বড় হওয়ার সময় তাকে ধর্মান্ধ করে তোলা, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলার কাজটি কেবলই পরিবার করছে বা কেবল মাদদ্রাসা থেকে লেখা-পড়া করে আসা ব্যক্তিরা এ রকম হচ্ছে, সেটা কিন্তু আর নাই। এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট।’’

তিনি বলেন, ‘‘আশির দশক থেকে হোলি আর্টিজান বা শোলাকিয়া হামলা পর্যন্ত কেবল জঙ্গিবাদের বিস্তার হয়নি বাংলাদেশে, আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতেও পরিবর্তন হয়েছে। এখানে অনেক পরিবারে সন্তানকে বলেছে, ঠিক আছে জিহাদে যাও। অনেকে সিরিয়ায় গেছে, আফগানিস্তানে গেছে।’’

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক কমেছে

‘‘আমাদের গবেষণায় দেখেছি, মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়া ব্যক্তিরা সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছেন অনলাইন থেকে, ওয়াজ থেকে, পিআর গ্রুপ থেকে। তাদেরকে দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলা যাবে না। মেজরিটি ঝুঁকছে মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার থেকে।’’

‘‘আনরেগুলেটেড ওয়াজে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভেনশন প্রয়োজন। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।’’

‘‘তাদের মানসিকতা তৈরি হচ্ছে যে, অন্য ধর্মের মানুষরা ভালো নয়। বাংলাদেশে কেবল মুসলিমরা থাকবেন। এখানে আমাদের ধর্ম ইসলাম অনুসরণ করে চলাফেরা করবেন। নারীদেরকেও হেয় করে কমেন্ট করছে। নারী শিক্ষায়ও তারা বিশ্বাস করে না।’’

‘‘এটা খুবই অ্যালার্মিং। মাস্টারমাইন্ডরা এই কোবলমতি শিশুদেরকে ব্যবহার করছে, তাদের অনেক বড় উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য।’’

মনোবিজ্ঞানী ফজিলাতুন নেসা বলেন, ‘‘প্রযুক্তির সময়ে শেখার মাধ্যমে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার জেনারেশনকে ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। এখনকার ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি ইনফর্মেটিভ। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ওরা অনেক বেশি আপডেটেড। সেগুলো ওদের ভালো দিক।’’

তিনি বলেন, ‘‘চ্যালেঞ্জের দিকগুলোও একেবারে কম না। ভার্চুয়াল আর অ্যাকচুয়াল লাইফের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারায় এখানে একটা বড় সংকট তৈরি হয়েছে। মিডিয়ার একটা বড় প্রভাব থাকে, শিশুদের জীবনে। মিডিয়াতে যদি ভায়োলেন্স বা অপরাধ, অপসংস্কৃতি বেশি দেখানো হয়, সেটা প্রিন্টেড মিডিয়া বা যে কোনো গণমাধ্যম হোক বা সামাজিক মাধ্যমে হোক, সেগুলোতে যেটা হয়, এই বয়সের ব্রেন তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’’

‘‘একটু অ্যালার্মিং যেটা, এই বয়সের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে যেহেতু ওদের ডেভেলপমেন্টে ফেজের কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সুতরাং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওরা ভুল জিনিসটা চুজ করে। বিচার-বিবেচনাবোধটা কম থাকে। শিশু- কিশোরদের নেগেটিভ বিষয়ের প্রতি কিউরিসিটি থাকে। সেই নেগেটিভ বিষয়, তারা তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে পেয়ে থাকে। জেনারেশন ল্যাঙ্গুয়েজে বিশাল পরিবর্তন এসেছে।’’

তিনি মনে করেন, ‘‘সামাজিক মাধ্যমে এখনকার শিশুরা প্রচুর সময় থাকলেও সেখানে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, সেটা তারা জানে না। কোথা থেকে একটা ছবি নেয়া যাবে, কোথায় থেকে নেয়া যাবে না- অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাও এটা জানে না।’’

সামাজিক মাধ্যম ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করা চিকিৎসক ডা. মো. আল হাসিবুজ্জামান বলেন, ‘‘শিশুরা ঢাকার মতো শহরগুলোতে খেলাধুলা পাচ্ছে না। শিশুরা গেমিংসহ আরো কিছু জিনিসের প্রতি অ্যাডিক্টেড হয়ে যাচ্ছে।’’

‘‘নতুন একটা গবেষণায় আমরা দেখেছি, শিশুরা অন্ধকার জগতের দিকে যাচ্ছে। ধরেন, কারো ইন্টারনেট নেই, সে ইন্টারনেট পেতে কারো ওয়াইফাই হ্যাক করে ফেলছে।’’

‘‘ছোটবেলা থেকেই তাদের এই ধরনের মানসিকতা চলে আসছে, একটা অন্ধকার জগতের দিকে যাওয়ার। যেহেতু শিশুদের জন্য খেলাধুলা খুবই প্রয়োজন। সেটা শহরগুলো দিতে ব্যর্থ। এটাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।’’

‘গুরু শিষ্যের সম্পর্ক বিনষ্টের পেছনেও ধর্ম-সাম্প্র্রদায়িকতা’

একটা সময় ভারতীয় উপমহাদেশে গুরু-শিষ্য সম্পর্কে গুরুকে দেখা হতো অন্য উচ্চতায়। সেখান থেকে এখন এখানে স্কুলের বাচ্চারা শিক্ষককে ক্লাসরুমে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো কাজও করছে। এখানকার সামাজিকীকরণ কীভাবে এতটা বদলে গেল?

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলছেন, ‘‘এই উপমহাদেশে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা কেবল বই পুস্তকের সম্পর্ক নয়, বরং সেটি (দীর্ঘদিন) পেরুনো একটি সম্পর্ক। এটার ধারাবাহিকতা আমরা এখনো দেখতে পাই।’’

‘‘তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষকদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার ক্ষেত্রে আমরা ধর্মকে ব্যবহার করছি।’’

তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য ক্ষেত্রে আছে, যেমন, শিক্ষার্থীরা যখন নম্বর বেশি চায়, তখন তারা শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহার করছে। তার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে। পারিবারিক পরিচয় যদি প্রভাবশালী হয়, সেটি ব্যবহার করছে।

‘‘কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রদায়িক যে চিন্তা-চেতনার উন্মেষ হয়েছে, তার তীব্রতা স্কুল-কলেজেও ছড়িয়ে পড়েছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আতঙ্কের বিষয়। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটছে।’’

সাম্প্রতিককালের ‍কিছু ঘটনা পত্র-পত্রিকায় এলেও অনেক ঘটনা পত্রিকায় আসেনি বলে উল্লেখ করে সাবেক এই তথ্য কমিশনার বলেন, স্কুলের পাঠদান রেকর্ডের ঘটনাও ঘটছে্

সাম্প্রদায়িকতার এই চর্চা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এটা কিন্তু একদিনে হয়নি।’’ বাংলাদেশের সংবিধানে চার স্তম্ভের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এটা আছে। কিন্তু বাস্তবে এটার প্রয়োগ দেখছি না।’’

‘‘এই সামাজিকীকরণ কেবল পরিবারে হয়, সেটা কিন্তু নয়। সমাজ কিন্তু সামাজিকীকরণ করে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সামাজিকীকরণ করে, গণমাধ্যমও কিন্তু সামাজিকীকরণ করে।’’

‘‘বিজ্ঞান একটি বিষয়, সামাজিক বিজ্ঞান একটি বিষয়- এগুলোর সাথে তারা ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এটার পেছনে বড় শক্তি কাজ করছে। তারা কিন্তু বসে নেই। তারা সামাজিকীকরণ করছে।’’

সমস্যার গভীরে শিক্ষার সংকট

‘আমরা কী ধরনের শিক্ষা চাই: একটি বিকল্প ভাবনা’ শিরোনামে অন্য তিন লেখকের সঙ্গে একটি বই রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক শহিদুল ইসলামের। যা মূলত ছিল একটি গবেষণা, পরে বের হয় বই আকারে। গবেষণাটি করা হয় ২০০৫ সালের দিকে।

এই বইয়ের পূর্বকথায় বলা হয়, ‘‘চলতি শিক্ষানীতি ঘোষণার পরও আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষ ধারার শিক্ষা ইত্যাদি নানামুখী শিক্ষা প্রচলিত আছে। বিদ্যামান এসব বিভিন্নমুখী শিক্ষার সিলেবাসে বৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক বিজ্ঞান চেতনাবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী উপাদানের অস্তিত্ব এখনো রয়ে গেছে, যা স্বাধীন চিন্তাশীল ও মুক্তমনের মানুষ তৈরির পথে একটা মূর্তিমান প্রতিবন্ধকতা।’’

আরও পড়ুন: ছাত্রীনিবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

‘‘এরকম শিক্ষা সৃজনশীল, মুক্তমনা, বহুত্ববাদী মানসিকতাসম্পন্ন, আধুনিক ও আলোকিত মানুষ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে সব সময়ই সবাই প্রশ্ন করে যাচ্ছেন।’’

‘আমরা মনে করি, একটি সমতাভিত্তিক, ‍যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা, যে শিক্ষা গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনবে, যে শিক্ষা সংবিধান অনুযায়ী সকল নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, তথা মানবাধিকারের অনুকূলে, যে শিক্ষা অর্জন শেষে প্রত্যেকেই যোগ্যতা অনুযায়ী কম-বেশি উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারবে।’’

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদনে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষায় কারিগরি শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলাম।’’

তিনি বলেন, ‘‘পরবর্তীতে আমি দেখলাম, আমাদের সেই ভাবনা জাপানের ভাবনার সাথে মিলে গেছে।’’

১৯৪০ জন্মগ্রহণ করা এই বৃদ্ধ শিক্ষাবিদ জীবন সায়াহ্নে এসে শিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মতো এত বৈষম্যপূর্ণ একটা সমাজে কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার মতো সম্মান কোনোদিন দেয়া হবে না রাষ্ট্র থেকে।’’

‘‘যে কোনো উন্নত দেশে সন্ধ্যার পর শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শ্রমিক একই ক্লাবে যাচ্ছে।’’

‘‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ৫০ বছর পরের দুরবস্থার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের মাতৃভাষায় যে শিক্ষা দেয়ার কথা ছিল, সেটা থেকে আমরা সরে গিয়ে তিন ধারায় রয়েছি। মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম, সাধারণ ধারা। সাধারণ ধারায়ও আবার দুই ভাগ করে ফেলেছি। একটা বাংলা মাধ্যম, একটা ইংলিশ মাধ্যম। এগুলো সরকার কি এমনি এমনি করছে? সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এগুলো করছে।’’

‘‘অথচ ১৮৩৫ সালের দিকে উইলিয়াম অ্যাডাম ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে তিনি প্রথমেই বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষার বিকল্প নেই। তাই মাতৃভাষায় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।’’

সামাজিক মাধ্যম: কী করতে হবে?

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘‘ই-সোসালাইজেশনের কথা আমরা বলছি। ডিজিটালাইজেশন নানা নেতিবাচক কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা জটিল জায়গা।’’

‘‘লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বেশি বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। তাদের মাইন্ডসেট অনেক বেশি ধর্মান্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারা পড়াচ্ছে? কারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে?’’

‘‘প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য, মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকদের জন্য যে সব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি শিক্ষকতা করি, আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষকদের সাথে কথা বলা উচিত। লেকচার সিরিজ তৈরি করা উচিত। তাদেরকে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত করানো উচিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষক পাওয়াও চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এই জায়গাগুলোতে আমাদের নজর দেয়া উচিত। এই জায়গাগুলোতে জোর দেয়া প্রয়োজন।’’

অনলাইনে ঘৃণা-বিদ্বেষ-সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোরোধে ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারের যোগাযোগে যে সমস্যা আছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে যথাযথ পদক্ষেপ চান এই সমাজবিজ্ঞানী। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ