কোটি টাকা ক্ষতি জেনেও বললেন—‘ড্রেজিং হবে এবং এটাই আমার সাফ কথা’

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. রুকনুল ফেরদৌসের পোস্ট

শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা  © সংগৃহীত

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. রুকনুল ফেরদৌস তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একদিন’ নামে একটি লেখা পোস্ট করেছেন। এই লেখায় ফুটে উঠেছে পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একগুঁয়ে স্বভাবের একটি চিত্র।

মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ড. রুকনুল ফেরদৌসের দেওয়া পোস্টটি শেয়ার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তার দেওয়া পোস্টটি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের উদ্দেশে হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘এক সময় আমি কাজ করতাম ড. মমিনুল হক সরকার স্যারের সাথে। ড. মমিনুল হক সরকার স্যার হলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান একজন নদী বিশেষজ্ঞ। তাঁর মাথাটা একটা আস্ত কম্পিউটার। আমাদের যে কাজটা করতে অনেক সময় লাগত, সেটা তিনি চোখের নিমিষে বলে দিতে পারতেন শুধু মাত্র স্যাটেলাইট ইমেজের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে। স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগ পাওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার। সেই হিসেবে আমি অনেক ভাগ্যবান।

অনেক বছর আগের কথা। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের নদী নিয়ে একটা প্রোজেক্টর সূচনা করেছিলেন। প্রোজেক্টের নাম ছিল ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’। এটার জন্য একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও ছিল। তো ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ প্রোজেক্ট শুরুর আগে দুইটা পাইলট প্রোজেক্ট নেওয়া হল যমুনা নদীতে। একটা সিরাজগঞ্জ এবং আরেকটা কুড়িগ্রাম জেলাতে। ঐ উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ড. মমিনুল হক সরকার স্যারকে দায়িত্ব দিয়েছিল সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে (একটা নির্দিষ্ট জায়গায়) ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে কি না তা গবেষণা করে রিপোর্ট আকারে জানানোর জন্য। ঐ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অনেক কিছুর ভবিষ্যৎ ঠিক হবে।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ

আমাদের গবেষণার ফলাফল ছিল ‘যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না’। 

এখানে কোটি কোটি টাকার ব্যাপার এবং ড্রেজিং করলে সম্পূর্ণ টাকাই নষ্ট হবে, তাই আমরা খুবই সতর্ক ছিলাম। ড. মমিনুল হক সরকার স্যার আমাদের গবেষণার রিপোর্ট উপস্থাপন করলেন। একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশান করলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যে, কেনো যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না। মিটিং এ উপস্থিত তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ঐ রুম থেকে চলে যাবার পর, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বললেন ‘যেভাবেই হোক ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে এভাবে রিপোর্ট তৈরি করতে। এটা উপরের নির্দেশ। রিপোর্ট আজকের মধ্যেই দিতে হবে কেননা আগামীকাল রিপোর্ট যাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে’। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালককে দায়িত্ব দিলেন বিষয়টা তদারকি করতে। 

আমি স্যার কে বললাম, আমরা এটা হতে দিতে পারি না। এইভাবে দেশের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হবে এবং তা আবার আমাদের হাত দিয়েই? এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। আমি স্যারকে বললাম হয়তবা প্রধানমন্ত্রী এটার কিছুই জানেন না। আমাদের উচিত যেকোনো ভাবেই হোক প্রধানমন্ত্রীকে এটা জানানো। স্যার তখন আমাকে বললেন কোন ভাবে যদি পরিকল্পনা মন্ত্রীকে বিষয়টা জানানো যায় তবে কাজ হতে পারে। স্যার তখন কাকে ফোন করেছিলেন মনে নাই, তবে আমাদের ভাগ্য ভাল। পরের দিন সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মন্ত্রীর বাসায় একটা সাক্ষাতের সময় পাওয়া গেল।

পরেরদিন সন্ধ্যায় পরিকল্পনামন্ত্রীর বাসায় ড. মমিনুল হক সরকার স্যার গিয়েছিলেন এবং মন্ত্রী মহোদয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ‘যমুনা নদীর ঐ নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না’। কিন্তু ‘ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে’ এই রিপোর্ট তো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চলে গেছে। এখন উপায় কি? মন্ত্রী মহোদয় সরকার স্যার কে বললেন, আপনারা আবার নতুন করে রিপোর্ট ও প্রেজেন্টেশান তৈরি করুন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং এর দিন ১০/১২ কপি নতুন রিপোর্টটা নিয়ে আসবেন। যেহেতু একটা রিপোর্ট চলে গেছে তাই এটা আপাতত কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টা অবগত করব। মিটিং এর দিন রিপোর্টটা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিবেন। আমি মিটিং এর দিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমতি নিয়ে আপনাকে রিপোর্টটা দিতে বলব। আশা করি প্রধানমন্ত্রী মানা করবেন না।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মিটিংয়ের দুই দিন আগে ড. মমিনুল হক সরকার স্যার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্যার হার্ট এর রোগী ছিলেন। স্যার আমাকে তাঁর রুমে ডেকে বললেন, উনার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মিটিং এ যাওয়া সম্ভব না। স্যার এর ইচ্ছা, আমি যেন যাই। স্যার বললেন, আমার বিশ্বাস তুমি পারবা। তুমি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝাতে পারবা। আর পরিকল্পনা মন্ত্রী তোমাকে সাপোর্ট দিবে। আমি এক কথায় বললাম, আমি পারব এবং এই ড্রেজিং যাতে না হয়, সেই ভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করব। 

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, তিন স্তরের সিকিউরিটি চেক পার করে একটা হল রুমে গিয়ে আমার জন্য নিদ্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম। আমি যেহেতু নতুন, তাই আমাকে বলে দেয়া হল কখন কখন কথা বলতে পারব, কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে কথা বলার জন্য অনুমতি নিতে হবে, অনেক নিয়ম কানুন। 

পরিকল্পনা মন্ত্রী ঐ হল রুমে প্রবেশ করা মাত্র আমি তাঁর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে আমার রিপোর্টগুলো তাঁকে দিতে চাইলে তিনি বললেন, আপনি নিজের হাতে এক কপি প্রধানমন্ত্রী কে দিবেন এবং বাকি কপি গুলা সামনের সারিতে বসা বাকি মন্ত্রীদের দিবেন। আমাকে উনার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন।

একে একে অনেক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা এসে হাজির হলেন। ঐ মিটিং এ তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এবং বি আই ডাবলু টি এ এর চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। একটু পর প্রধানমন্ত্রী এসে হাজির হলেন। মিটিং শুরু হল। শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বলার পর পরিকল্পনা মন্ত্রীকে ঐ দিনের মিটিং এর বিষয় উত্থাপন করতে বললেন। মন্ত্রী মহোদয় শুরু করলেন এবং কিছুক্ষণ বলার পর বললেন যে আমাদের পানি বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা আগের রিপোর্টের থেকে ভিন্ন এবং সময় স্বল্পতার জন্য আমরা তা আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে পারি নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে উপস্থিত একজন পানি বিশেষজ্ঞ তা আপনার সামনে উপস্থাপন করবেন।

প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলেন এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী আমাকে হাতের ইশারায় রিপোর্ট দিতে বললেন। আমি আমার সামনের রাখা রিপোর্টগুলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এর দিকে এগিয়ে গেলাম। তার ডানপাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে এক কপি তার হাতে দিলাম। উনি হাতে নিয়ে এক এক করে রিপোর্টের পাতা উল্টাতে লাগলেন এবং পুরা রিপোর্টটা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন। ঐ সময় সবাই চুপ করে ছিল। যেন পিন পতন নীরবতা। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট টা তার টেবিল এ রেখে আমাকে বসতে বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাকি রিপোর্টগুলো অন্য মন্ত্রীদের দিব কি না? উনি অনুমতি দিলেন এবং আমি বাকি রিপোর্ট গুলো মন্ত্রীদের বিতরণ করে, আমার জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলাম।  

মিটিং এর এক পর্যায়ে গিয়ে আমাকে অনুমতি দেয়া হল প্রেজেন্টেশন দেবার জন্য। আমি দিলাম এবং পরিষ্কার ভাবেই সব বুঝিয়ে দিলাম যে, ড্রেজিং ফলপ্রসূ হবে না। উপস্থিত সবাই দেখল এবং শুনল। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হল। আমার স্পষ্ট মনে আছে, কৃষি মন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ আমাকে সাপোর্ট করে নাই।

প্রধানমন্ত্রী অনেক কথা বললেন এবং শেষে বললেন, ‘ড্রেজিং হবে এবং এটাই আমার সাফ কথা’। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আমি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম সেদিন। আমি প্রধানমন্ত্রী কে খুব ভাল মানুষ এবং একজন দেশপ্রেমী জানতাম। আমার অনেক দিনের ধারণা মুহূর্তের মধ্যেই ভেঙ্গে শেষ হয়ে গেল। যে মানুষ একটা গরীব দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তার কাছে হাজার কোটি টাকা নষ্ট হবে, এটা কোন ব্যাপার না। এটা কোন কথা হল? মনে অনেক প্রশ্ন আর হতাশা নিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম। আর কোন কথা বলি নাই।  

মিটিং শেষে প্রধানমন্ত্রী চলে যাবার পর এক এক করে যখন সবাই চলে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব আমার কাছে এসে বললেন বাইরে গিয়ে যাতে আমি উনার জন্য অপেক্ষা করি। কথা বলবেন। বাইরে এসে আমি পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন উনি বের হয়ে আসলেন এবং আমাকে বললেন উনার গাড়িতে বসতে। সচিব এর গাড়িতে তার পাশে বসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বের হলাম। আর তখনই শুরু হল আমার উপর আক্রমণ। এমন কোন খারাপ গালি নাই যে সচিব আমাকে দেয় নাই। খারাপ ভাষায় অজস্র গালিগালাজ করছিলেন।  

একবার জিজ্ঞেস করলেন, এই যে রিপোর্ট পরিবর্তন করলাম, তা তাকে জানালাম না কেন? বললাম, সত্যিটা প্রধানমন্ত্রীর জানা উচিত, তাই রিপোর্ট পরিবর্তন করেছি। এ কথা শোনার পর সচিব তার ড্রাইভার কে বললেন, গাড়ি থামাতে। মাঝ রাস্তায়, বিজয় সরণির কাছে গাড়ি থামলে, সচিব আমাকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেট চলে গেলাম। একটা সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে অফিসে ফেরত আসলাম। সব ঘটনা ড. মমিনুল হক সরকার স্যার এবং নির্বাহী পরিচালক স্যার কে বললাম। দুই জনই একই পরামর্শ দিলেন। এই ঘটনা এখানেই শেষ। আমি যেন কাউকে না বলি।   

পরবর্তীতে যমুনা নদীতে ঐ জায়গায় ড্রেজিং হয়েছিল এবং ড্রেজিং করে কোন লাভ হয় নাই।’


সর্বশেষ সংবাদ