বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ শিক্ষার্থীর ডাকাত চক্র

ডাকাতির প্রতীকী
ডাকাতির প্রতীকী  © সংগৃহীত

রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১২ নম্বর সেক্টরের ৬১ নম্বর বাসা। ১৮ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সমন্বয়কের ভুয়া পরিচয়ে ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে ঢোকেন ৯ থেকে ১০ জন। তারা বিজিএমইএ ও শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জিম্মি করেন। সেখানে অবৈধ অস্ত্র ও টাকা রয়েছে, এমন অভিযোগ তোলেন।

চক্রটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি-ধমকির এক পর্যায়ে বাসার গৃহকর্ত্রী ইডেন মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ ড. মমতাজ সাহানারার কাছে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে বসে। টাকা দিতে রাজি না হলে বাসায় চালানো হয় লুটপাট। হাতিয়ে নেওয়া হয় ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১৫ লাখ টাকা। এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায় সমকাল।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার অভিযোগ দেওয়ার পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ ছাত্র মিলে ডাকাত দলটি গড়ে তোলে। গত ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গুর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা বিভিন্ন ফ্ল্যাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুটের বড় ধরনের ছক কষেন। চক্রের দলনেতা হলেন মারুফ হাসান পল্লব (৩২)। তিনি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্র। সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন কাওসার। এ ছাড়া তন্ময় ও রনি নামে আরও দুজনের তথ্য পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন: শিক্ষককে মারধর করায় বিএনপি নেতাকে অব্যাহতি

এরই মধ্যে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ পল্লব ও তার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন সজীবকে (২৬) গ্রেপ্তার করেছে। বাকি ১০ জনকে গ্রেপ্তারে রাজধানীসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলায় অভিযান চলছে।

উত্তরা পশ্চিম থানা সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষার্থী উত্তরায় দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত আড্ডা দিতেন। এতে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা ডাকাত চক্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তাদের টার্গেট। উত্তরায় শাহ মখদুম অ্যাভিনিউতে যে বাসায় তারা টার্গেট করেন, সেটি ছিল কৃষক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ হাওলাদারের। তিনি পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। ডাকাত চক্রের সদস্য সজীব আগে থেকেই ওই বাড়ির আরেকটি ফ্ল্যাটে থাকা বায়িং হাউসে চাকরি করতেন। এ কারণে ওই বাসায় নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার থাকতে পারে বলে তার ধারণা ছিল। পরে সজীব বিষয়টি পল্লবকে জানান।

সূত্র আরও জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দলটি ওই বাসায় ঢোকে। বাইরের লোকজনের সন্দেহ এড়াতে বাসার অদূরে পার্ক করে রাখা হয় পুলিশ লেখা মোটরসাইকেল। ২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ফ্ল্যাটটিতে ছিল দলটি। তারা ফ্ল্যাটে ঢুকেই সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআর খুলে ফেলে। এরপর চাঁদা না দিলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাতে থাকে হারুন অর রশিদের স্ত্রী ড. মমতাজ সাহানারাকে। পরে শোবার ঘর থেকে ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১৫ লাখ টাকা লুট করে।

আরও পড়ুন: আলোচিত সেই এডিসি সানজিদাকে বদলি

পুলিশ জানায়, গত মঙ্গলবার ভোররাতে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের হোটেল প্যারাডাইজ থেকে পল্লবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছে পাওয়া যায় লুণ্ঠিত ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার, একটি পাসপোর্ট ও ঘটনায় ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল। বুধবার তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং অন্য অভিযুক্তদের বিষয়ে তথ্য দেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর থেকে সজীবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছে পাওয়া যায় লুণ্ঠিত এক লাখ টাকা।

এ বিষয়ে মামলার বাদী মমতাজ সাহানারা বলেন, বাড়ির ম্যানেজারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা ছয় তলায় নিয়ে আসে। এরপর গৃহকর্মী দরজা খুলে দেয়। বাসায় ঢোকার কারণ জানতে চাইলে তারা সমন্বয়ক পরিচয় দেয়। বাসার নিচে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছে বলে জানায়। তারা দাবি করে, আমার স্বামীর দুটি অবৈধ অস্ত্র বাসায় রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমার স্বামী বাসায় ঢোকেন। তিনি তাদের বলেন, বৈধ দুটি অস্ত্র থানায় জমা দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্রও দেখাতে পারবেন। একপর্যায়ে উপজেলা নির্বাচনে আমার স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বী কাওছার আমিন হাওলাদারের ছবি দেখিয়ে বলতে থাকে, কাওছার আমিনকে নাকি আমার স্বামী নির্যাতন করেছেন।

সাহানারা আরও বলেন, ২৫ লাখ টাকা চাঁদা না দিলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দেয় তারা। এরপর বাসার আলমারির ড্রয়ার থেকে স্বর্ণ লুট করে।

আরও পড়ুন: ‘অন্তর্বাস দিবস’ বলা সেই শিক্ষকের বদলি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এই চক্রের কারও বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলায় জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৭টি ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দলটির সন্ধান পাওয়া গেছে। ছাত্র সমন্বয়কের ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা দলটির সব সদস্যকে আটকের জন্য চার-পাঁচটি টিম অভিযান চালাচ্ছে।

এর আগে ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসায় ও কার্যালয়ে ডাকাতি হয়। সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরা ডাকাতরা নিজেদের যৌথ বাহিনী বলে পরিচয় দেন। তারা ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করেন বলে গৃহকর্তা ও পুলিশ সূত্র জানায়। ওই ঘটনায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতির ঘটনায় র‍্যাবের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও রয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ