কারিগরি শিক্ষা: বিমাতাসুলভ আচরণ কেন?
- সজীব ওয়াফি
- প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০৭ PM , আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১, ০২:০০ PM
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা। সভ্যতার চাকা ঘোরাতে খুব কম ক্ষেত্রই আছে যেখানে তাদের ভূমিকা নেই। অথচ শিক্ষার্থীদের সাথে কোন আলোচনা না করে দেশের সাড়ে চারশ’র বেশি পলিটেকনিকের প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। করোনা কালের এই সময় গুলোতেও তাদের আন্দোলন করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
কারিগরি শিক্ষা হাতে-কলমে অর্জন করতে হয়। সাধারণ কলেজগুলোর মত বই পড়ে খাতায় লিখে আসলেই হয় না। ক্লাস শুরু হওয়ার সময়টাতে শিক্ষকদের আন্দোলনে ১ মাসের বেশি সময় শেষ হয়েছে। পরবর্তীতে ক্লাস শুরুর সপ্তাহখানেক পরে করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় ইনস্টিটিউট। অনলাইনে ক্লাসের কথা বলা হলেও সেটা অধিকাংশে সম্ভব হয়নি। পুরো প্রতিষ্ঠানে ৪-৫ টা ডিপার্টমেন্টে অনলাইনে কিছু ক্লাস হয়েছে, তাও ৩-৪ টা কোর্সের।
গ্রাম পর্যায়ের দারিদ্র্য পরিবারগুলো থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে উঠে আসে শতকরা ৮০ ভাগ পলিটেকনিক শিক্ষার্থী। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নেটওয়ার্ক সমস্যা মারাত্মক ধরনের। অধিকাংশ গ্রামের শিক্ষার্থীকে যার কারণে কোনমতেই ক্লাস করানো সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা যাদের পরিবার গুলোকে তাড়িয়ে বেড়ায় নিয়মিত। করোনা কালীন সময়গুলোতে যে পরিবারেরগুলোর আয় রোজগারের পথ পুরোপুরি বন্ধ, তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বড় অঙ্কের ফি। বেসরকারি ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের ফি ১৫ হাজার টাকার উপরে ছাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে মিডটার্ম হয়নি, সে ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রাইভেট পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের। বৈশ্বিক মহামারীতে বন্ধকালীন এসব ফি পরিশোধ করতে না পারলে ফরমফিলাপ করে পরীক্ষায় বসাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক হতাশায় অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন পড়াশোনার ইচ্ছাও। যেখানে এমনিতেই পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পরার হার তুলনামূলক বেশি।
উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যপারে সিদ্ধান্ত আসলেও পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সাথে করা হয়েছে বিমাতৃসুলভ আচরণ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সপ্তম পর্বের পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম পর্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের। অন্যান্য সকল পর্বের সমাপনী শেষ হয় ডিসেম্বরের ভিতরেই। যেখানে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে মিডটার্ম পরীক্ষা, জুনেই সকলের সমাপনী পরীক্ষাও হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো; কিন্তু করোনার চলমান ছুটিতে কোন সিদ্ধান্তই আসছিল না।
অষ্টম পর্বের শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুন মাসে। অর্থাৎ ডিপ্লোমা শেষে সবারই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল। অথচ বোর্ডের অবহেলায় ছাত্রদের ভবিষ্যত হতাশার গহ্বরে ফেলে দেয়া হয়েছে। তাদের ভবিষ্যতকে ফেলে দেয়া হয়েছে এক থেকে দেড় বছরের ‘ইয়ার লসে’। এখন যদি সকল পর্বের পরীক্ষা হয়ও ভবিষ্যৎ সেমিস্টার গুলোতে সমন্বয় করে এ লস কাটানো অসম্ভব। হঠাৎ করে একমাস আগে পুরো সিলেবাসের উপর পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পলিটেকনিকে ভাল ফলাফল করাও জটিল হয়ে দাড়ায়। ক্লাস ব্যতিত ব্যবহারিক পরীক্ষা একদম অনর্থ ঘটানো। বরঞ্চ এমতাবস্থায় স্থগিত হওয়া ২য়, ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ পর্বের শুধুমাত্র ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তী পর্বের সাথে যুক্ত করে এবং ১ম, ৩য়, ৫ম ও ৭ম পর্বের ক্লাস চালু করে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া উপর্যুক্ত।
বিগত ২০ বছরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নানা রকমের অনিয়ম পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও নজরদারিতে ছিলো গাফলতি। শিক্ষার মানোন্নয় হয়নি বোর্ডের ধীরগতির জন্য। বিভিন্ন পরীক্ষা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও পুনঃনিরীক্ষা থেকে আয় হওয়া কোটি কোটি টাকা হয়েছে আত্মসাৎ। যেখানে ৫০% টাকা থাকার কথা ছিলো তহবিলে। ২০১৮ সালে গঠিত তদন্ত কমিটিকেও টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছ হিসাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় ২০১৯ সালের শেষদিকে। তাহলে কি দুর্নীতির চাপ ছাত্রদের উপরে দিতেই কয়েকদিন পরপর ছাত্রদের নিয়ে টালবাহানা হচ্ছে? বোর্ডের ধীরগতি ও শিক্ষার মান অবনমনের দায় ছাত্ররা নেবে কেন!
সিলেবাস সংক্ষিপ্ত না করে আন্দোলন প্রেক্ষিতে অর্ধেক নম্বরে পরীক্ষা নেয়ার নোটিশ দেয়া ছাত্রদের সাথে আরেক প্রহসন! কারণ অর্ধেক নম্বরের পরীক্ষা দিতেও পুরো সিলেবাস পড়তে হবে যেটা এত অল্প সময়ে সম্ভবই নয়। বরং শিক্ষা কমিটির আওতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রণয়ন করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষার আয়োজন যুক্তিসঙ্গত। সময়ের দাবি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়ার।
না কাঁদলে মা’ও শিশুকে দুধ দেয় না, দাবি আদায়ে চিৎকার দিতে হয়। আপ্রাণ লড়াই করতে হয়। অবিলম্বে পলিটেকনিক ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক এবং মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে চলমান সংকট সমাধানে গণতান্ত্রিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্তৃপক্ষের বোধদয় হোক। লড়াকু শিক্ষার্থীদের অভিবাদন এবং সালাম।
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক