তিতুমীরে আরেকটা দিন
- মামুন সোহাগ
- প্রকাশ: ২১ জুন ২০২০, ০৫:১৭ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৩৭ AM
আজ তিনমাস হলো চোখ ভরে ক্যাম্পাসকে দেখি না। করোনাভাইরাসের সতর্কতায় গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেই আমরা শিক্ষার্থীরা ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ি ফিরতে শুরু করি। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাম গা থেকে মুছে কেবলমাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পা রেখেছি। ক্লাস হয়েছে, শুনেছি। শুনছি ক্লাস হবে নিয়মিত। যেতে হবে ক্লাসে, নিয়মিত হতে হবে। এভাবেই চলে গেছে হাতে গোনা ক'টা দিন। ঠিক সেসময়ই ধাক্কা দিলো মহামারী। যে যেভাবে পেরেছে বাড়ি ফিরেছে, শহরে থেকেও ঘরবন্দী হয়েছে।
লম্বা ছুটি! প্রায় ১০০ দিনের মতো ক্যাম্পাসে হাটি না। এই অবসরে ক্যাম্পাসের ছবি দেখি। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্লাটফর্ম তিতুমীরিয়ান গ্রুপে সবাই স্মৃতিগাথা নানান গল্প লিখে, ছবি পাঠায়। সেগুলো পড়ে চোখ বুলিয়ে নিই, নিজে লিখি। তবে করোনার এই দূঃসময় কাটিয়ে উঠে তিতুমীর কলেজে আরো এক সকাল চাই। ক্যাম্পাসের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে গোটা ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াবো। শহীদ বরকত মিলনায়তনে বিতর্ক ক্লাবের নানা যুক্তিতর্ক, ছাত্রলীগ চত্বরের শিক্ষার্থীর ভিড়, বাধনের রক্ত খোঁজাখুঁজি, সাংবাদিক সমিতির ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের কলম-ক্যামেরা হাতে হটিহটি করে বেড়ানো সবই হবে।
কল্পনায়, ভাবনায় আমার প্রিয় ক্যাম্পাসকে খুঁজতে খুঁজতেই এই অবসরের বেলা অবেলায় হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। কিন্তু আশা হারাইনি, আবার ফিরব সেথায়। অন্য রকম একটি দিনে, অন্য রকম একটি সকালে। সেসেঞ্জারে বন্ধু-বান্ধবের মেসেজ চালাচালিতে গ্রুপ চ্যাট ভারি হলেও তাতে যেনো প্রাণ নেই। একবার চোখে দেখা আর একসাথে হেটে পুরো ক্যাম্পাস হেটে দেখার স্বাদ ফুরোচ্ছে না। দিনকেদিন এ অপেক্ষা যেনো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে..।
দূঃসময় চিরদিন থাকে না। রাতের কেটে যেমন ভোরবেলাতে আলো আসে ঠিক তেমনই দূঃসময়ও কেটে যায়। ব্যাথা, বেদন, যন্ত্রণা সবই ফিকে হয়। নতুন একটা দিন আসবে। সেই সকালটা একেবারে অন্য রকম হবে। মিরপুরের বাসায় ঘুম থেকে সকাল ছ’টায় ওঠার জন্য অ্যালার্ম দিয়ে রাখবো। খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই শেওড়াপাড়ায় বাসের লাইনে দাড়াবো। তর সইবে না! বাস ধীরে ধীরে আসবে; বাসভর্তি যাত্রী নিয়ে। আমি বাসে উঠতে পারছিনা। বাস চলে যাচ্ছে, আমি যাবো... আমি আর অপেক্ষা করবো না। হেটে হেটে আঁগারগাও পর্যন্ত গিয়ে তারপর বাসে উঠবো।
না, সেদিন বৈশাখি বাসের হেলপার মামার সাথে হাফ ভাড়া নেওয়ার জন্য কোনো তর্কতর্কি না। হেসেহেসে আরো দশটা টাকা বেশি দেবো। বলবো ‘মামা এটা তোমার মিট-আপ বোনাস’। মহাখালীর আমতলি যেতে না যেতেই বিদঘুটে জ্যাম, ট্রাফিক সিগন্যাল। আমার তর সইবে না। বাস থেকে নেমেই ভো-দৌড়। ক্যাম্পাসের মেইন গেটে ক’জন আমার অপেক্ষায় থাকবে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবো না। আমি জলদি পায়ে হেটে দ্রুত এগোতে থাকবো দ্বিতীয় গেটের দিকে। ঢুকেই আমি জুতা মোজা খুলে হাতে নিবো। ক্যাম্পাসের দ্বিতীয় গেট থেকে ঢুকে শহীদ বরকত মিলনায়তন, কলা ভবন, বিজ্ঞান ভবন, ছাত্র সংসদের সামনের গোলচত্ত্বর সব জায়গাতে খালি পায়ে হেটে নেবো।
সেদিনের সকালকটা একেবারে অন্যরকম হবে। গেলো এক মাসে দেশে কোনো করোনাভাইরাসের রোগী ধরা পড়েনি। আক্রান্ত বা মৃত্যুর ভয়ে শরীরে কোনো কাপুনি নেই। স্কুলে-স্কুলে ভ্যাকসিন ক্যাম্প বসেছে। ইনজেক্ট করে তা দেওয়া হয়েছে আমার গায়েও। পরশু ঝিনাইদহ থেকে ফেরার পথে আমাকেও ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে প্রত্যেকটা গোলচত্ত্বরে আজ শিক্ষার্থীতে ছেঁয়ে গেছে।
ছাত্রসংসদ থেকে ছাত্রলীগের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে’ কলাভবনের সামনের কড়ই তলা নতুন প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। আজ সবার গলার স্বর বেড়ে গেছে। ঝাঁঝালো স্লোগানে কম্পিত গোটা ক্যাম্পাস। টেকনাফ থেকে মহাখালী ক্যান্সার হসপিটালে মাকে নিয়ে আসা আক্কাসের জরুরীর রক্তের প্রয়োজনে সে কলেজের বাধন শাখাতে গুটি মেরে বসে আছে। বাধনকর্মীরা একজন ডোনার খুঁজতে গেলে গুণে গুণে ১০ জন পেয়ে গেলেন। আজ আর কারো ভয় নেই। শরীরে, মনে সাহস আর শক্তি বেড়ে গেছে।
‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবুও শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা...’ গানটির ভাসা ভাসা আঁওয়াজ অডিটোরিয়াম থেকে বরকত মিলনায়তনে কানে আসছে। আজ সবাই এসেছে শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চের। একই কাপড়ের পাঞ্জাবি-শাড়িতে মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে তারা। আজকের দিনটা অন্যরকম।
আমি এসব দেখতে দেখতেই চলে যাবো ক্লাসরুমে। সবাই গাদাগাদি করে থাকবে। সবচেয়ে ওপরের তলায় সিড়িতে পৌঁছবে। ছুটে চলে যাব ক্লাসের দিকে। পুরোনো সেই চিরচেনা ক্লাস। সবাই সবার সঙ্গে মন খুলে গল্প করছে, এমন একটি দৃশ্য দেখার জন্যই মনে হয় আমরা সবাই বেঁচে আছি। হেঁটে হেঁটে ক্লাসের একেবারে শেষের বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যাব। কয়েক মাস আগেও এমন এক সকালে একা একা বসে থাকতাম, এমনটা ভাবতে ভাবতেই কোনো এক বন্ধু এগিয়ে এসে আমাকে হয়তো জড়িয়ে ধরবে! কত দিন পর যেন দেখা হলো… দিন, মাস, বছর?
প্রিয়তমাকে এক পলক দেখার জন্য আমি চলে যাবো সুফিয়া কামাল হলের গেট পেরিয়ে একেবারে সামনে। না সেদিন আর ফোন করবো না। জোড়া পাঁচেক গোলাপ নিয়ে সেদিন গলা উঁচিয়ে ডাকবো। তার সাড়া না পেয়ে পুষ্পকানের সামনে আসতেই ঝুঁম বৃষ্টি। আকাশে হু হু করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমি ভিজে গেছি। শুধু আমি না আমার সাথে থাকা হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেদিন ভিজছে। আষাঢ়ে বৃষ্টির এই ভরপুরে শরীরে পানি লাগিয়ে নিচ্ছি সবাই। প্রাণে মেরে ফেলা ভাইরাস আমাদের থেকে যেনো অনেক দূরে চলে যায়।
ধূঁয়েমুছে সাফ করে নিচ্ছি আমরা সবাইকে। ভেজা শরীরে ক্যাম্পাসের চৌকাঠ পেরিয়ে শাকিল চত্বরে আসতেই গোলাপ ফুল আর আতশবাঁজি কেনার ধুম। না, আজ কোনো মাস্ক কিংবা গ্লাবস হাতে নেই কেউ। আজ নেই কোনো দূরত্ব বজায়ের বাঁধাধরা নিয়ম। আজ আমরা মৃক্ত, স্বাধীন।
আড্ডা দিতে দিতে গল্প হবে, বাসায় থেকে কী কী মজার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। সেই মজার অভিজ্ঞতা শুনে হো হো করে হেসে উঠবে পুরো টেবিল। সেই টেবিলের দিকে পাশের টেবিলে বসা কেউ বিরক্তি নিয়ে তাকাবে না। বিশ্বজয়ের পর ঠিক যেমন হয়। তেমন অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা মেতে উঠবো। না, সেদিন কোনো বাড়ি ফেরার তাড়া থাকবে না।
ভালবাসার আপন আলয় তিতুমীর কলেজে কেটে যাবে সারাটা দিন, সন্ধ্যাটুকুও। এ যেনো ঈদের দিন। বাঁধভাঙা খুশির আনন্দ। তবে এমন দিন কবে পাবো আমরা? কবে!! কবে!!
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা