বদলে গেছে পৃথিবী
- অধ্যাপক ড. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
- প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০, ০৩:৪৫ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৫ PM
পৃথিবীর বদলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হলেও, দিনদিন এটাই অনেকটা স্বাভাবিক এর মত হয়ে উঠেছে। করোনা কালীন এই দুর্যোগে পৃথিবী সেজেছে আবার নতুন রূপে, চারিপাশে সবুজের সমারোহ, বহমান এই সময়ে বদলে গেছে চারপাশ। ঘরের ভেতর ও বাহির। বাড়ির আনাচে-কানাচে নতুন চেহারা। নবরূপে প্রকৃতি ও পরিবেশ, চির কাঙ্খিতরূপে। ভারসাম্য আসছে জীবন ও খাদ্যচক্রে, বাস্তুসংস্থানে। নদী আর সাগরে স্বাভাবিক গুণ ও মানের পানি।
কক্সবাজারের বাসিন্দারা মন চাইলে দেখতে পারে ডলফিন এর নাচানাচি, যেন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করেছে সেখানকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে। জল ও মাছে ভরপুর নদী- নালা, হাওড়-বাওর। কষ্টসাধ্য জীবনটাও যখন নৌকার মাঝি আর জেলেদের সুন্দর করে আর একটি বার বাঁচার আশা জাগায়, তখন মনে হয় পৃথিবী সত্যিই নতুনভাবে, নতুন করে আমাদেরকে বাঁচতে শিখিয়েছে। গাছে গাছে ফুলের সমারোহ, পাখির কিচিরমিচির, মৌমাছি মধু সবই যেন তাদের নিয়মেই চলেছে, শুধু বদলে গেছে মানুষের জীবনযাপনের ধরণ, নিয়মাবলী। শৃঙ্খলা এসেছে প্রতিটি মানুষের জীবনে।
বদলে গেছে মানুষ। প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচার আশায় সুনির্দিষ্ট দূরত্ব বজায়ের মাধ্যমে মানুষ শিখে গেছে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে নতুন করে আর একটি বার বাঁচতে হবে। করোনা কালীন এই দুর্যোগেও থেমে নেই কারোর ই পথ চলা, হোঁচট খেলেও , উঠে দাঁড়ানোর শক্তি এখন মানুষের প্রতিনিয়তই তৈরি হয়ে গেছে, এ যেন প্রতিদিনের সূর্য উদয় হওয়া আর সূর্য অস্ত যাওয়ার ই একটি দৃশ্য আমাদের সমাজে বিরাজ করছে বর্তমানের এই করোনা মহামারীর দিনগুলোতে।
বদলে গেছে আমাদের জীবন যাপন! চাইলেই কেউ কারো সাথে দেখা করতে পারে না। কিন্তু সামাজিক দূরত্বের মধ্যেও মিল-বন্ধন বরং আরও বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জীবনকে করেছে অনেকটাই সমৃদ্ধ এবং ত্বরান্বিত। ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল এর যুগে মানুষ চাইলেই সবাইকে দেখতে পারে, কথা বলতে পারে, ঘন্টার পর ঘন্টা দিতে পারে আড্ডা, যেখানে নেই কোন বাধা। করোনা কালীন এই দুর্যোগ বরং আমাদের কে শিখিয়েছে পরিশ্রম,আত্মত্যাগ, সংযমী হওয়া সৌহার্দ্য, ভালোবেসে জীবনকে আরেকটি ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কেউ করোনাই আক্রান্ত হলেই ভয় না পেয়ে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম পালনের মাধ্যমে আমরা চাইলেই এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি।
পরিবর্তন এসেছে আমাদের খাদ্যভ্যাসে। প্রত্যেকদিন ১৫-২০ মিনিট রোদ যদি আমরা নিতে পারি তাহলেই আমাদের দেহে ভিটামিন ডি এর চাহিদা অনেকটাই পরিপূরক হিসেবে কাজ করে, সেই সাথে ভিটামিন সি এর কোন বিকল্প নেই। ভিটামিন সি ক্ষতিকর জীবাণুগুলির বিরুদ্ধে এপিথিলিয়াল প্রতিরোধব্যবস্থাকে দৃঢ় করে। এমনকি অণুজীবের ধ্বংস হারও বাড়িয়ে দেয়। যেমন পেয়ারা, আমলকি, কমলা, জাম্বুরা, সজনে পাতা, শাক, লেবু, কাঁচামরিচ ইত্যাদিতে ভিটামিন 'সি' পাওয়া যাবে। প্রচুর পরিমানে পানি পান করাটা আবশ্যক। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। সেটা যেকোনভাবে হতে পারে। ব্যায়াম করে বা বাসার কাজ করে।
আমাদের দেশের যেকোনো ধরনের মসলা জাতীয় খাবার যেমন, আদা, রসুন, লবঙ্গ, সিড (সরিষা, গোল মরিচের গুঁড়ো, চিয়া সিডস, ইত্যাদি) কালোজিরা ইত্যাদি প্রতিদিন একটু একটু করে খাওয়া। একদিন দুইবেলা করে রং চা অথবা গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
বদলে গেছে আমাদের চলার পথ। ঘরে বাইরে প্রত্যেকটি জায়গায় এসেছে পরিবর্তন। অফিস আদালত থেকে শুরু করে বাজার প্রত্যেকটি জায়গায় এসেছে দারুণ সব পরিবর্তন, শৃঙ্খলা এবং নিয়মের পথে চলা। বিষন্ন এবং এই হতাশা মুক্ত জীবন পেতে আমাদেরকে সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে হবে, প্রতিটা সময় পারিবারিক, অফিশিয়াল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম সর্বোপরি জনসচেতনতা সবার মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। বাইরে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরে ফেরা পর্যন্ত প্রত্যেকটি মুহূর্তে নিজ নিজ দায়িত্বে হতে হবে সবাইকে সচেতন।
আমাদেরকে প্রত্যেকটি দিন নিশ্চিত করতে হবে প্রতি ৩ মিনিট পরপর হাত ধোয়া থেকে শুরু করে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, চশমা পরিধান করা এবং একই সাথে তিন ফিট দূরত্ব নিশ্চিত করা সবার মাঝে। সবথেকে সতর্কতামূলক কাজ যেটি আমাদেরকে সবসময়ই পালন করতে হবে সেটি হচ্ছে, হাঁচি কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যেকেই যদি স্বাস্থ্যবিধি গুলো ঠিকমতো মেনে চলি এবং আমাদের জীবনের একটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে এই স্বাস্থ্যবিধি গুলোকে জায়গা করে দিতে পারি, তাহলে আশা করি করোনা মোকাবেলায় আমাদের জয়গান নিশ্চিত হবে একদিন ইনশাল্লাহ। আমরাও আশার আলো দেখব।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কি বেড়েছে? সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকলেও মানুষের মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। বদলে যাওয়া এই পৃথিবীতে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে, পৃথিবী আমাদেরকে শিখেছে নতুন করে কিভাবে আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মত্যাগী হতে হয়।প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী গরীব দুঃখী মানুষের মধ্যে চেষ্টা করছি বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার টাকা পয়সা ,খাদ্য ,ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার। গড়ে উঠেছে মানুষে মানুষে সহমর্মিতার এক প্রতিচ্ছবি। হাতে হাত রেখে কাজ করার মধ্যে আছে আত্মতৃপ্তি, সেখানে হারানোর ভয় নেই। বরং করোনা দুর্যোগে এই সাহায্য সহযোগিতায় মানুষকে আরেকটিবার শিখিয়েছে আত্মত্যাগ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। আরো শিখিয়েছে বেঁচে থাকার লড়াই টা আরো কিভাবে সহজ করা যায়। ধর্ম-বর্ণের ভেদ ভুলে সবাই বাঁচতে শিখেছে। ধনী- গরিবের বৈষম্য কমেছে। মানুষ জেগে উঠেছে প্রতিটি মানুষের মনে। এখন গরীব-অসহায় কিংবা প্রান্তিক মানুষের কথাও সবার ভাবনায় থাকে। মানবিকতা, ঔদার্য, মৃত্যুভয়, সততা, দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি, আত্মত্যাগ ও সবারে নিয়ে ভালো থাকার মানসিকতা তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। মানুষের মধ্যে কমেছে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি , লুটপাট। মানুষে মানুষের ভালোবাসাটা ও যেন হয়েছে প্রবল।
বদলে গেছে সময়। সত্যিই তো সময় কতটা বদলেছে। গত তিন মাসে সবার জীবনে যে পরিবর্তন লক্ষণীয়, সত্যিই বিস্ময়কর। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই তাও যেন মানুষ দেখেছে খুব কাছ থেকে। একই সাথে কিভাবে সাহায্য সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় সেটা নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের প্রাণিকুল ব্যস্ত। করোনার এই দুর্যোগকালে ও বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ধৈর্য ,ভালোবাসা বরং মানুষ মানুষে বেড়েছে। আগে একই ছাদের নিচে সবার বসবাস থাকলেও যান্ত্রিক জীবন মানুষকে করে তুলেছিল পাশবিক, কিন্তু এখন চাইলেই সবাই সবার খোঁজ খবর রাখতে পারে, মা-বাবা , সন্তান,ভাই-বোন ,আত্মীয়-স্বজন সবার প্রতি ভালোবাসার বন্ধন টাও যেন হয়ে উঠেছে অনেক প্রবল, সময়ই আমাদেরকে শিখিয়েছেন আবার নতুন করে সবার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, বয়স্ক মানুষগুলোকে কাছে টেনে একবার তাদের ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করা।
সময় সত্যিই অনেক শক্তিশালী, চোখের পলকে সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়, শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু। কিভাবে বস্তুনিষ্ঠ, সত্যবাদী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। তাই সময় কে ভালবেসে প্রতিনিয়ত আমরা স্বপ্ন দেখি বরাবরের মতই একদিন সূর্য উদয় হবে, আর সেই দিনে থাকবেনা করোনার কোন প্রাদুর্ভাব, শূন্যের খাতায় নেমে আসবে করোনা রোগী। আশার আলো জাগবে মনে। করোনা কালীন পুরাতন দিনগুলো আমাদেরকে তখন মনে করিয়ে দিবে সত্যিই তো বেঁচে থাকাটাই যেন অবাক সত্য, এই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের প্রতিটি দিনের চলার পথ হবে আরও সুদৃঢ় এবং আমাদের চিন্তা শক্তি থাকবে সুদুরপ্রসারী যেখানে থাকবে নতুন নতুন স্বপ্ন, আশার আলো এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার কোন এক গল্প।
চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।