করোনাজয়ী এক সরকারি কর্মকর্তার যুদ্ধগাথা
- খালিদ ফেরদৌস
- প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ০৫:১২ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:০৪ PM
প্রকৃতির উপর অমানবিক হয়ে বিজ্ঞান ও উন্নয়নের কাঁধে চড়ে বিশ্ব চলছিল বেশ! হঠাৎ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে হানা দিলো করোনাভাইরাস। যার সংক্রামণে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাছে। সেই দুর্ভাবনা ও বাংলাদেশেও এসে আছড়ে পড়ল। সরকারও নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে।
৮ মার্চ সবাইকে অবাক করে প্রথম বাংলাদেশে সার্স-কোভ-২ প্রজাতির ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগ শনাক্ত হয়। চারিদিকে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে হলো। বাড়তে থাকল আক্রান্তের সংখ্যা। ১৮ মার্চ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঘোষণা দিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজন মারা গেছেন।
মারা যাবার পর সরকার স্ক্রিনিং, টেস্ট, লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন্সহ নানা পদক্ষেপ জোরেশোরে গ্রহণ করতে শুরু করল। সারাদেশজুড়ে এমন ভীতিকর ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতি তৈরি হলো যা আগে দেখেনি জনগণ। ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার এমন সব বিধিনিষেধ আরোপ করল যে, সবাই ঘরে ঢুকে যেতে শুরু করল। কিন্তু সরকারি প্রশাসনিক পরিসেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তার সাথে জড়িতদের নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরেই থাকতে হলো। কারণ তাদের মাথায় দায়িত্বের বোঝা। তাদেরকে মাঠ ছাড়লে হবে না।
এমনই একজন নির্ভীক, সাহসী ও দায়িত্ববান সরকারি কর্মকর্তা সবুজ হাওলাদার। সে সম্প্রতি করোনাকে পরাজিত করে কোটি মানুষের সাহসের বাতিঘরে পরিণত হয়েছে। সে ৩১তম বিসিএস-এ অংশগ্রহণ করে কৃতীত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে নরসিংদীতে কর্মরত আছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণে অধ্যয়নসূত্রে সে আমার ক্লাসমেট। আমাদের সামনেই সে জীবন যুদ্ধ করতে করতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ছাত্রজীবনে আমরা সবাই তাকে কর্মঠ ‘জীবনযোদ্ধা সবুজ’ বলেই ডাকতাম। আমাদের সকলের ধারণা- জীবন যুদ্ধের ধূসর-বর্ণীল অভিজ্ঞতা তাকে করোনাভাইরাসকে পরাজিত করতে সহায়তা করেছে। সে কীভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে, তা নিজেই বর্ণনা করেছেন।
সে বলেছে, আমি বর্তমানে নরসিংদী সদর উপজেলায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছি। আমি উপজেলার কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কমিটি এবং করোনা কুইক রেসপন্স কমিটির একজন সদস্য। এছাড়া উপজেলার ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত। আমরা ১২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে কয়েকজন অফিসার করোনা টেস্টের জন্য স্যাম্পল সিভিল সার্জন অফিসে জমা দেয়। আমরা যেহেতু উপজেলার বিভিন্ন জনসেবামূলক কার্যক্রমে জড়িত ছিলাম; সেহেতু ইচ্ছা করেই টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিয়েছিলাম।
১৩ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে যখন টেস্টের রেজাল্ট হাতে পেলাম তখন দেখি- টেস্টে আমার করোনা পজিটিভ। প্রথম শুনে আমি চমকে উঠলাম। কেননা আমার শরীরে কোনো লক্ষণই ছিলো না। আমি বিলম্ব না করে ডাক্তারের সাথে আলাপ করলাম। আমি তাকে বললাম, আমি হোম কোয়ারেন্টিনে থাকব। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমার কথা শুনল না।
তারা বলল, আমাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম হোম কোয়ারেন্টিন কিন্তু কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে আইসোলেশন। এই দুই ইচ্ছার টানাপোড়েনে এক প্রকার তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম। যা সময় সুযোগ করে দেশবাসীকে বিস্তারিত জানাব। তারপরও আমার মনে হচ্ছে, বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারীর বাস্তব পরিস্থিতি মানুষের জানার প্রয়োজন রয়েছে।
আমি ডাক্তারের কথা মতো আইসোলেশন ওয়ার্ডে চলে গেলাম। সেখানে আরও ৩০ জন করোনা পজিটিভ রোগী ছিল। সেখানকার পরিবেশ মোটেও ভালো ছিল না। সেখানে তেলাপোকার অভয়ারণ্য, কম করে হলে বিশ-পঁচিশটা বিড়াল নির্বিঘ্নে বসবাস করে। ডাক্তার-নার্স বা সেবাকর্মীদের জন্য ভয় ও আতঙ্ক পরিলক্ষিত হয়েছে, যা ক্ষেত্রে বিশেষে অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে। বর্তমানে করোনা রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে আমি মনে করি।
এই পরিবেশ ও পরিস্থিতি মোটেও কাম্য নয়। এজন্য আমি সরকারকে দায়ী করব না। স্বাস্থ্যসেবায় যারা নিয়োজিত আছে তাদের সদিচ্ছা দিয়ে এই পরিবেশের অনেকটা উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। যা হোক, সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার কারণে এই জরাজীর্ণ ওয়ার্ড থেকে দুইদিন পর আমাকে ও উপজেলা প্রকৌশলীকে আলাদা একটি রুমে স্থানান্তর করা হয়। করোনায় আক্রান্তকালীন ডাক্তারের পরামর্শ এবং নিজের বিবেচনাবোধ দিয়ে সকল নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করেছি। ফলশ্রুতিতে ৭ম দিনে দ্বিতীয় টেস্টে করোনা নেগেটিভ আসে।
এর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমার ৩য় টেস্ট করানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসে। সকলের সুবিধার্থে আমি করোনা চিকিৎসাকালীন যেসব নিয়ম কানুন মেনে চলেছি বা সেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা নেগেটিভ করেছি- তা বলতে চাই। আমি প্রতি এক ঘন্টা পর পর গরম পানি পান করতাম। লাল চায়ের সাথে লবঙ্গ, আদা, দারুচিনি, গোলমরিচ মিশিয়ে পান করছি দিনে কম করে হলেও চার থেকে পাঁচ বার।
দিনে তিনবার গরম পানির স্টিম বা ভাপ নিতাম, যা করোনা নেগেটিভ করতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া সুযোগ পেলেই লেবু চা পান করতাম। কুসুম গরম বা যতটুকু মুখে বা গলা সহ্য হয় এমন পানি দিয়ে নিয়মিত গলা গারগিল বা খাঁকারি করেছি। নিয়মিত গরম পানি দিয়ে গোসল করতাম। ঠান্ডা যেকোনো জিনিস এড়িয়ে চলতাম। করোনার থেকে প্রতিকার ও প্রতিরোধে সঠিকভাবে স্বাস্থ্য পরিচর্চার মাধ্যমে, বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি। যেমন- ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, জিং ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ খাবার। এর মধ্যে আমড়া, পেয়ারা, লেবু, কমলা, মাল্টা, আপেল এবং দেশি মৌসুমি ফল। যাদের দামি ফল কিনে খেতে সমস্যা তারা কম দামি দেশি মৌসুমী ফল খেতে পারে। ভিটামিন জাতীয় ফলমূল খাওয়ার পাশাপাশি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন- ডাল প্রভৃতি খেয়েছি। সব সময়ের জন্য মহৌষধ মধু, কালিজিরা খেয়েছি প্রতিদিন সকাল-বিকেল।
সুষম খাবার খেয়েছি যেমন- সবজি, মাছ, মাংস প্রভৃতি। প্রতিদিন দুপুরে একগ্লাস গরম দুধ খেয়েছি। এক কথায়- করোনা রোগীর সবচেয়ে ভালো ট্টিটমেন্ট হলো- গরম পানি পান, ফুটন্ত গরম পানির ভাপ নেয়া ও চা পান করা। নিয়ম করে আমি নিজে এই নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে মেনে চলেছি। ফলস্বরূপ খুব দ্রুত আমি করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছি।
বর্তমান ভীতিকর পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলব- আমাদের দেশে করোনাভাইরাস নিয়ে আতংক, ভয় একটু বেশি। আক্রান্ত না হয়েও অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। করোনা নিয়ে আসলে এতো আতংকিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। করোনাকে এতো ভয় পাবার কিছু নেই। এটা সাধারণ একটা ফ্লু-এর মতো রোগ। তবে যারা হাঁপানী, ঠান্ডাজনিত শারীরিক সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন এবং যারা বয়স্ক তাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
আবার বলি, সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর কোনো কারণে যদি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই যায়; তবে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া চলবে না। করোনাভাইরাস নিয়ে প্রসঙ্গক্রমে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আমি যতটুকু জানি আমাদের যত প্রজাতির সাপ আছে, তার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ বিষধর। বাকি ৯৫ শতাংশ বিষহীন। যেগুলোতে কামড়ালে মানুষ মরে না।
কিন্তু মানুষ সাপে কাটলেই মনে করে তাকে বিষধর সাপ কামড়িয়েছে। আমি আর বাঁচব না। এজন্য মানুষ প্যানিকড না ভীষণ ভয় পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। যার ফলে হার্ট স্ট্রোক করে অনেকে মারা যায়। একই বিষয় করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও ঘটছে এবং ভবিষ্যতে আরো ঘটবে যদি বিষয়টিতে সচেতন না হই। আমি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- করোনায় আক্রান্ত হলে সাহস হারানো যাবে না, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া যাবে না।
মানসিক শক্তি যদি বজায় রাখা যায়, তবে করোনা কাউকেই দুর্বল করতে পারবে না। এমনকি বয়স্কদেরও না। তাছাড়া করোনাকে আমাদের জয় করতেই হবে। এই লড়াকু মানসিকতা থাকলে এ যুদ্ধে আমরা জিতবই। তাছাড়া করোনা শক্তিশালী হতে পারে; কিন্তু সে তো আর ঈশ্বর নয়। তাই আসুন বিধাতার উপর বিশ্বাস রেখে সচেতন হই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি নিজে সুস্থ থাকি অন্যকেও সুস্থ রাখি।’
এই সরকারি কর্মকর্তার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হবার বাস্তব অভিজ্ঞতা দেশের কোটি কোটি মানুষের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। যা সুস্থ বাংলাদেশ তথা সুস্থ বিশ্ব গড়ে তুলতে টনিকের মতো কাজ করবে। যুগে যুগে এই পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের মতো অনেক মহামারী হানা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ নিয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে আপিন শক্তিতে।
ঘুরে দাঁডানো জন্য এমন লড়াকু মানসিকতার সবুজ হাওলাদাররা নেতৃত্বে দিয়েছে। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পথের দিশা দিয়েছে ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাদের মতো সাহসের বাতিঘররা করোনায় অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিকে আলোকিত করুক সমগ্র বাংলাদেশকে। যাতে প্রিয় স্বদেশ ফিরে পায় উন্নয়ন ও অগ্রগতির আপন মহিমা ও ছন্দ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট