খাদ্যযোদ্ধাদের অন্তত স্বীকৃতিটুকু দিন!
- শামীম আল মাহমুদ
- প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২০, ০৬:৫৭ PM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৫৮ PM
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনের প্রথমটিই অন্ন তথা খাদ্য। এছাড়াও বৈশ্বিকভাবে মানুষের সর্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে খাদ্য সুপ্রতিষ্ঠিত। অথচ, বৈশ্বিক মহামারীর এ চরম দুঃসময়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের কাজে নীরবে-নিভৃতে শ্রম দেওয়া খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু থেকেও হচ্ছেন বঞ্চিত।
ব্রিটিশ শাসনামলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) সংঘটিত পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষিতে জন্ম নেয় সিভিল সাপ্লাইজ ডিপার্টমেন্ট, যেটি আজকের খাদ্য অধিদপ্তরের পূর্বরূপ। সে সময় এ বিভাগের রেশনিং ব্যবস্থার তৎপরতায় মৃতের সংখ্যা ৫০ লাখেই থেমে যায়। তৎকালীন বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একে জরুরি বিভাগ ঘোষণা করেন।
পাকিস্তান আমলে ইস্ট পাকিস্তান ফুড এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস নামে পরিচিত এ বিভাগকে ১৯৫৬ সালে অবলুপ্ত করা হলেও পরিস্থিতির নিরিখে ১৯৫৭ সালে একে স্থায়ী বিভাগে রূপান্তরিত করা হয়। সেই থেকে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততার বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হলো উপজেলা। কেননা, উপজেলা পর্যায় থেকেই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান বা গম অভ্যন্তরীন সংগ্রহ, প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ ও ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, টিআর, কাবিখা ইত্যাদি খাতে বিতরণ ছাড়াও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, সদর উপজেলাগুলোতে ওএমএস কার্যক্রম তত্ত্বাবধান এবং খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীর লাইসেন্সের ব্যাপারে তদারকি করা হয়। তাই, উপজেলাকে খাদ্য অধিদপ্তরের প্রাণ বলা যায়। আর সে সূত্রেই এসব সার্বিক দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায়, সেই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকবৃন্দই হলেন খাদ্য অধিদপ্তরের প্রাণভোমরা।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার এ দুর্যোগকালেও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা ঢাল-তলোয়ারবিহীন যোদ্ধার মত হলেও বীরদর্পে কাজ করে যাচ্ছেন। কেননা, দাপ্তরিক উদ্যোগে তারা কোন ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লোভস বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পাননি। এছাড়াও এই অবরুদ্ধ সময়ে তাদের সরকারি যানবাহন না থাকায়, কালোবাজারি ঠেকাতে অনেকে পায়ে হেঁটে বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনে যাচ্ছেন।
তবুও দায়িত্বের বোঝার গুরুভারের কথা চিন্তা করে, পরিবার-পরিজন দূরে রেখে, সপ্তাহের সাতদিনই তারা দাপ্তরিক কাজ হাসিমুখেই করছেন। উপজেলায় আর কেউ থাকুক বা না থাকুক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পিআইওর চাহিদা মোতাবেক যেকোন সময় যেকোন ত্রাণ বিতরণে তারা বলি দিচ্ছেন নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা।
তবে, সরকারের অন্যান্য কর্মবীরদের মত উপজেলা ফুড অফিসার নামে সমধিক পরিচিত এ প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তারা পাদপ্রদীপের আলোর বাইরেই রয়ে যাচ্ছেন। বরং তাদের কাজ জনগণের সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত বলে কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর জন্য আগে থেকেই জনমনে বিরাজমান বদনামের ভাগীদার হচ্ছেন তারা।
সব কর্মক্ষেত্রেই ভালো-মন্দ মিলিয়েই কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও অল্প কিছু দুর্নীতিবাজের জন্য সবার ভাবমূর্তি খারাপ হয় সবখানেই। অথচ, এ দুর্দিনে দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন করে যাচ্ছেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তথা উখানিরা। সারা দেশে যেখানেই ওজনে কম বা দামে বেশি নিয়ে ডিলাররা অবৈধ মুনাফা অর্জন করছিল, সেখানেই দেখা যাচ্ছে তাদের সোচ্চার ভূমিকা। ফলশ্রুতিতে, কয়েকজন ডিলারের ডিলারশিপ বাতিলসহ কারাদণ্ডও হয়েছে। বরং অপরাধীকে শাস্তি দিয়েও অনেককে সইতে হয়েছে ‘চালচোর’ গালি, হতে হয়েছে লাঞ্ছিত।
যদিও ডিলার নিয়োগের পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং তাৎক্ষণিক শাস্তিদানের একক ক্ষমতা তাদের নেই। গত ১৫ এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম শহিদ খাদ্যযোদ্ধা এমআইএস এন্ড এম বিভাগের নিরাপত্তা প্রহরী সুরুজ মিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে নেই খাদ্যযোদ্ধাদের নাম।
অবশ্য, মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত ১৫ এপ্রিল প্রেস রিলিজে ডাক্তারদের মতোই জীবন বাজি রেখে কাজ করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান এবং এ সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিশেষ স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার আহবান জানান। অনেক হতাশার মাঝেও এ এক আশার বাতিঘর।
তবে খাদ্য বিভাগকে অবিলম্বে জরুরি বিভাগ ঘোষণা এবং উপজেলা পর্যায়ের সুকঠিন দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনের জন্য সমস্ত বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদটিকে ক্যাডারভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। তাহলেই, তাদের অতীতের বিনা দোষে বিদ্রুপের শিকার হওয়া ও সকল অসম্মান-অসুবিধার স্থায়ী সমাধান হবে।
উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ:
তাৎক্ষণিক:
১. অনেক জনসমাগমে কাজ করতে হলেও মাস্ক, গ্লোভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গগলস, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা নেই
২. জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও প্রণোদনা, স্বাস্থ্যবীমা ও ঝুঁকিভাতার ব্যবস্থা নেই
৩. নিয়মিত মিল পরিদর্শন, বাজারদর যাচাই, কালোবাজারি রোধে চাল বিতরণ তদারকি করার দায়িত্ব থাকলেও দাপ্তরিক গাড়ি/ টিএর ব্যবস্থা নেই
৪. ডিলারশিপ প্রদানের ব্যাপারে পূর্ণ কর্তৃত্ব ও তার শাস্তি প্রদানের সর্বময় ক্ষমতা নেই, কিন্তু বদনামের ভাগীদার হতে হয়।
স্থায়ী:
১. ডিসিএফের ৫০ শতাংশ ইউসিএফ থেকে পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে তার বাস্তবায়ন নেই
২. জরুরি কাজে নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও জরুরি বিভাগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া
এর প্রেক্ষিতে আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা:
১. অবিলম্বে মাস্ক, গ্লোভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সরকারিভাবে সরবরাহকরণ
২. বর্তমান জরুরি অবস্থায় প্রণোদনা, স্বাস্থ্যবীমা ও ঝুঁকিভাতা বরাদ্দকরণ
৩. সার্বিক কাজে ব্যবহারের জন্য দাপ্তরিকভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করা
৪. ডিলার নিয়োগ, মিলের লাইসেন্সসহ প্রতিটি কাজের অনুমতি ও বাতিলের ক্ষেত্রে শাস্তি বিধানের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা রাখা
৫. উপজেলা ফুড কন্ট্রোলার/ সমমান পদকে ক্যাডারভুক্ত করা
৬. খাদ্য অধিদপ্তরকে সরকারের জরুরি বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা
এ দুঃসময়ে অকাল মৃত্যুতে কাউকে যেন নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধার না দেখে চলে যেতে না হয়, সেজন্য দ্রুত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদটিকে ক্যাডারভুক্ত করা দরকার। জরুরি অবস্থায় তাদের গুরুত্ব সবচেয়ে দৃশ্যমান বলে এবং খাদ্য অধিদপ্তরের ক্যাডার সোপানের জট দূর করতে এ বিষয়ে আর বিলম্ব করা একদমই অনুচিত। সম্মান নিয়ে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক/ সমমান পদের কর্মকর্তারা মরতে রাজি, তবু সিভিল সাপ্লাইজ বিভাগের জনক হ্যাজবার্নওয়েলের যেন বদনাম না হয়।
লেখক: প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদপ্তর