মুসলিম বিশ্বের আইকন কে এই আবু বকর তামবাদু?
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:১২ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:২৪ PM
কয়েক দশক ধরে চলা আরাকানে রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে যখন সারা বিশ্বের নেতারা নিশ্চুপ, তখন জাতিসংঘের বিচারিক আদালতে মায়ানমারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে পশ্চিম আফ্রিকান ক্ষুদ্র মুসলিম দেশ গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার এই মামলার নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তিনি হলেন আবু বকর তামবাদু। তিনি বর্তমানে গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারবিষকমন্ত্রী।
আবু বকর ছোটবেলা থেকে দেশটির রাজধানী বাঞ্জুলের হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক থেকে এলএলবি ডিগ্রি নেন। আবু বকর তামবাদু সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ব্রিটেন থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা শেষে গাম্বিয়ায় ফিরে আইন পেশায় যোগ দেন।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০০০ সালে একটি ঘটনা আবু বকরের চিন্তা জগতের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। গাম্বিয়ায় সেই সময় স্বৈরশাসক ইয়াহইয়া জামেহের শাসন চলছিল। ২০০০ সালে গাম্বিয়ার সরকারি বাহিনী ১৪ জন শিক্ষার্থীকে রাজপথে হত্যা করে।এই ঘটনার পর আবুবকর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
২০০৩ সালে আবু বকর জাতিসংঘে যোগ দিয়ে তানজানিয়ায় রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচারে কৌঁসুলি হিসেবে অংশ নেন। বলা হয়ে থাকে, আবুবকরের কৌশলী ভূমিকা ও কারণে সেই সময় রুয়ান্ডার সাবেক সেনাপ্রধান আউগুস্টিন বিজিমুনিগোর ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। রুয়ান্ডার গণহত্যা বিচারের অভিজ্ঞতা আবুবকরকে মায়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করতে সাহস জুগিয়েছে।
আবু বকর জানান, ইয়াহইয়ার দুঃশাসন গাম্বিয়াকে মানবতার পক্ষে লড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। গাম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহের ২২ বছরের শাসনামলে বিরোধীমত ও দল দমন করে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। গুম,খুন,গ্রেপ্তার করে নির্যাতন নিয়মিত ঘটনা ছিল গাম্বিয়ার নাগরিক জীবনে।
২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহকে পরাজিত করে আদম ব্যারো চমক সৃষ্টি করেন। সেই সময় আবু বকর একজন গাম্বিয়ান রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ছিলেন। ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির বিচারমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহের পতনের পর হতে গাম্বিয়ার পরিস্থিতি দিনদিন বদলে যেতে থাকে। নতুন সরকারের আমলে ইয়াহইয়ার বিগত সরকারের অনেক কুকীর্তি বেরিয়ে আসে।
২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে আরাকানের কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং বার্মিজ সেনারা আরাকানে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে, বিশ্ব মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের দুর্দশার খবর প্রচার হতে থাকে তখন বাংলাদেশ থেকে ৭০০০ কিলোমিটার দূরের দেশ গাম্বিয়ার আবু বকর তামবাদুর হৃদয়ে কষ্ট অনুভূত হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের কিছু করার প্রতীক্ষায় তিনি ছিলেন।
রোহিঙ্গা নির্যাতনে পাকিস্তান, সৌদিআরব, তুরস্ক, পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশগুলো যখন বিবৃতি নিন্দার মধ্যে সীমাবদ্ধ তখন গাম্বিয়ার আবু বকর রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াইয়ে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।আবু বকর সেই সুযোগ পেলেন ২০১৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে।
গাম্বিয়া তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না পাঠিয়ে শেষ মুহূর্তে বিচারবিষয়ক মন্ত্রী আবু বকর তামবাদুকে বৈঠকে পাঠায়। আবুবকর ওআইসির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
দেশে ফিরে গিয়ে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবুবকর জানান, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতিটি কথায় গণহত্যার কাহিনী লেখা আছে। আমি এখানে রুয়ান্ডার গণহত্যার সঙ্গে মিল খুঁজে পাই।’
রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্য আবুবকর ওইআইসিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং এই বছর ওআইসিকে মামলায় সহযোগিতা করতে সম্মত করান। এভাবেই আবুবকর পশ্চিম আফ্রিকার এক ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়াকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সামনে নিয়ে আসেন।
অবশেষে ১১ নভেম্বর ২০১৮ সালে গাম্বিয়া মায়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন সিদ্ধান্তের জন্য মামলা করে।ওআইসি,নেদারল্যান্ড, কানাডা গাম্বিয়াকে আন্তর্জাতিক আদালতে সহযোগিতা করেছে। শুনানি শেষ হয়েছে। এখন আদেশের অপেক্ষায় সারা বিশ্বের মানুষ।
আদালতে প্রথম দিনে আবু বাকার তামবাদু বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, ‘মিয়ানমারকে এ রকম নির্দয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বলুন। তাদের বর্বরতা বন্ধ করতে বলুন, যা আমাদের সবার বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। মায়ানমারকে তাদের নিজেদের লোকদের ওপর গণহত্যা চালানো বন্ধ করতে বলুন।’
আবু বকর তামবাদু বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের মানবিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। এই বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে মানবতাদী এই মানবাধিকার কর্মী শুধু মুসলিম নয় শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে আইকনে পরিণত হয়েছেন। আবু বকর হয়েছেন নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কণ্ঠস্বর।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক