দেশের প্রয়োজনে তরুণরা বারুদের মতো জ্বলে উঠে

  © টিডিসি ফটো

ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিচ্ছে আমাদের সুন্দর সময়, সুযোগ ও ভবিষ্যৎ। বিজ্ঞানের অভিশাপ এবং আশীর্বাদ দুটোই রয়েছে। আজ বিজ্ঞান দিয়েছে গতি কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ, অনুভূতি, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা। স্মার্টফোনে গেইম,গান, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, ভিডিও দেখা ইত্যাদি এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। ফলে আধুনিক আবিষ্কার তথ্য-প্রযুক্তি এখন অনেকাংশেই মানুষকে করেছে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ ও সেলফিশ। মোবাইল ফোনকে স্বাস্থ্যের জন্য ‘টাইম বোমা’র সঙ্গে তুলনা করছে বিজ্ঞানীরা।

সম্প্রতিককালে প্রায় ২০০টি গবেষণায় মোবাইল ফোনকে মস্তিষ্কের টিউমার ও ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সামাজিক দায়িত্ববোধ ভুলে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে কৃত্রিম লোক দেখানো সামাজিকতা নিয়ে ব্যস্ত। আজ তরুণদের যেন নেই কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা সঠিক দিকনির্দেশনা। হাতের স্মার্ট ফোন ও ল্যাপটপটি হয়ে গেছে তরুণদের ঘরকুনো রোবোটিক জীবনযাপনের হাতিয়ার। তারুণ্যের চিন্তাধারাতে ভ্রান্ত মতবাদ স্থান করে নিচ্ছে। তারা দিন দিন শক্তিহীন, কর্মহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাদের আড্ডা খেলাধূলা নেই বললেই চলে। মোবাইলে ফেসবুক ও সিনেমা-নাটক দেখে অযথা সময় নষ্ট করছে। মাদকদ্রব্য সেবন করে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে ও গার্লফ্রেন্ডের পিছনে অঢেল সময় দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। ডেকে আনছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার এক ভবিষ্যৎ।

অথচ এ তরুণরাই ব্রিটিশদের জন্য ছিল আতঙ্ক। আজ জন্মে না সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবে উজ্জীবিত বীর। এই তরুণরাই ৪৭-এর ভারত বিভাগ, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬ 'র ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভুত্থান, ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস ভুলে তরুণরা আজ প্রতিবাদহীন নির্লিপ্ত জীবন বেছে নিয়েছে। সর্বত্র যেখানে চলছে চরম অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, লুটপাটের মহোৎসব। সেখানে তরুণদের নীরবতা ঘরকুনো স্বভাব জাতির জন্য অশনিসংকেত বৈকি।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের অভিভাষণে বলেছিলেন ‘আমরা যৌবনের পূজারি, নব নব সম্ভাবনার অগ্রদূত, নব-নবীনের নিশানবর্দার। আমরা বিশ্বের সর্বাগ্রে চলমান জাতির সহিত পা মিলাইয়া চলিব। ইহার প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে যে, বিরোধ আমাদের শুধু তাহার সঙ্গেই। ঝঞ্ঝার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়নমান তুফানের মতো আমরা বহিয়া যাইব। যাহা থাকিবার তাহা থাকিবে, যাহা ভাঙ্গিবার তাহা আমাদের চরণাঘাতে ভাঙ্গিয়া পড়িবেই। দুর্যোগ রাতের নিরন্দ্র অন্ধকার ভেদ করিয়া বিচ্ছুরিত হউক আমাদের প্রাণপ্রদীপ্তি। সকল বাধানিষেধের শিখর-দেশে স্থাপিত আমাদের উদ্ধত বিজয় পতাকা। প্রাণের প্রাচুর্যে আমরা যেন সকল সংকীর্ণতাকে পায়ে দলিয়া চলিয়া যাইতে পারি।’

আজ হোক অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর প্রতিবাদ। হোক সত্য উচ্চারণের দীপ্ত শপথ। হই মহিশূরের সুলতান বিপ্লবী টিপু সুলতানের সেই অমোঘ বাণী প্রতিষ্ঠার সারথি। ‘শিয়ালের মত একশো বছর জীবনধারণ করার চাইতে সিংহের মতো একদিন বাঁচাও ভাল।’

আজ তরুণরা জেগে উঠলে জাগবে আলোকিত সবিতা। যার বিচ্ছুরণে দূরীভূত হবে অসত্য অন্যায়ের তখত তাউস। কবি নজরুল ইসলাম যখন লক্ষ্য করলেন যৌবন তার এ ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে, বৃদ্ধ চতুর রাজনীতিবিদরা তরুণদের চোখে লোভের অঞ্জন পরিয়ে দিচ্ছে, তখন বড় দুঃখে ও অভিমানে ‘শিখা’ কবিতায় লিখলেন,

হায়রে ভারত, হায়, যৌবন তাহার
দাসত্ব করিতেছে অতীত জরার
জরাগ্রস্ত বুদ্ধিজীবী বৃদ্ধ জরদগাবে
দেখায়ে গলিত মাংস চাকরির মোহ
আনিয়াছে একেবারে ভাগাড়ে শ্মশানে।
যে হাতে পাইত শোভা খরতরবারি
সেই তরুণের হাতে ভোট ভিক্ষাঝুলি
বাঁধিয়া দিয়াছে হায়, রাজনীতি ইহা।

তারুণ্যের কবি নজরুল এ দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলেন না। যে দেশের বাচ্চাদের খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে ? বর্গীদের লুটতরাজ, রাহাজানির মতো জঘন্য অপরাধকে ছড়া কবিতায় বীরত্ব মাখা কণ্ঠে উচ্চারণে ভয় দেখিয়ে বাবা-মা বাচ্চাদের ঘুমিয়ে দেয়। সেখানে দেশে বীর সন্তান জন্মাবে কিভাবে? সে কথা ভেবে হয়তো শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা শিখবে কিভাবে ?

আজ তরুণরা যদি নিরব থেকে যায় তাহলে আগামী দিনে তারা পাবে বাসযোগ্যহীন পরিত্যক্ত নগর, শহর। যেখানে থাকবে ভাগাড়, আবর্জনার স্তুপ, অনিরাপদ নগরী কিংবা রাষ্ট্রের বিকলাঙ্গ অবস্থা। পুকুর চুরি, বালিশ কাণ্ড, বিদ্যানের পুস্তক ক্রয়ে যেভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থলোপাট হচ্ছে, আবার পর্দা দিয়ে যেভাবে সব ঢেকে ফেলা হচ্ছে এসব অবশ্যই তারুণ্যের ভাবনার বিষয়।

আজ রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় দেখেও তারুণ্যের যদি মনে প্রতিবাদের জোশ না আসে তাহলে বুঝতে হবে জাতির তারুণ্যের শক্তি দিন দিন নড়বড়ে ও পঙ্গুত্ব বরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে ৬০০ টাকার বালিশ হয়ে যায় ৬ হাজার টাকা কোথাও ২৭ হাজার টাকা, ২ হাজার টাকার বালিশের কভার হয় ২৮ হাজার টাকা, ১ হাজার টাকার গাউন ৪৯ হাজার টাকা, ৩০০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভস পয়ত্রিশ হাজার টাকা, ৩০০ টাকার রেক্সিন ৮৪ হাজার, একটা কেটলি তিন তলায় উঠাতে খরচ ৪ টাকার জায়গায় ৪ হাজার টাকা, একটা পর্দা ৭০০ টাকার জায়গায় হয়ে যায় ৩৭ লাখ টাকা, ৪০ জনের চায়ের আপ্যায়ন ব্যয় চারশ টাকার জায়গায় হয়ে যায় ৪০ হাজার টাকা, পাঁচটটি চেয়ারের দাম ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে হয়ে যায় ১কোটি পঁচিশ লাখ টাকা, ১১ হাজার টাকার টেবিল হয়ে যায় ১১ লাখ টাকা, আবার কোথাও অস্তিত্বহীন যন্ত্রপাতির মূল্য হয়ে যায় শতশত কোটি টাকা।

ঘুনে ধরেছে তারুণ্যের প্রতিবাদে। তবে এ অবস্থায় তরুণদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াল দুঃসময়। যেদিন রুখে দাঁড়িয়েও হয়তো শেষ রক্ষা হবে না। তরুণরা আজ ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা কতটুকু ভাবছে? বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদেরা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার তরুণদের কি চাওয়া পাওয়ার আছে, তা নিয়ে কিন্তু তারা মোটেও চিন্তিত নন। জোড়াতালি দিয়ে চলছে সবকিছু।

সুকান্ত বাবুর সেই অঙ্গীকার আজ যারা দেশের হাল ধরে আছেন তারা বেমালুম ভুলে আছেন, এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে. চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ. প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

আজ বলতে হয় নজরুলের সেই ‘যৌবনের গান’, প্রমথ চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটীকা’ সবই কি কেন যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তাই তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তরুণ বা নওজোয়ানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন:

অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে,
না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে!
এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ,
তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ
পাহাড়ে চড়িয়া নীচে পড়ে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
অজগর খোঁজে গহ্বরে—নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
চড়িয়া সিংহে ধরে কেশর—নৌজোয়ান!
বাহন তাহার তুফান ঝড়—নৌজোয়ান!
শির পেতে বলে—‘বজ্র আয়!’
দৈত্য–চর্ম-পাদুকা পায়,
অগ্নি–গিরিরে ধরে নাড়ায়—নৌজোয়ান।

স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৮০ ভাগেরও বেশি ছিল তরুণ, যাঁদের বয়স ৪০-এর নিচে। রাজাকার-আলবদরদের খাতায় যারা নাম লিখিয়েছিল, তাদেরও বেশির ভাগও তরুণ ছিল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে সুকর্ম বলি কিংবা কুকর্ম বলি সবখানেই তরুণরা ভ্যানগার্ড।

দেশের ষোল কোটি মানুষের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। আগামী ১৫ বছর পর তাঁরাই রাষ্ট্রের ও সমাজের সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করবে। তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকশিত হবার সুযোগ না দিলে তারা আগামীকে শুধু অযোগ্য অদক্ষ নাগরিকই হবে তা নয়, তাদের বিরাট একটি অংশ বিপথগামী হতে বাধ্য। বাংলাদেশের ২৫ বছর বা তার নিচের বয়সের মানুষের সংখ্যা ৪৯ শতাংশ। আর কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ। এই কর্মক্ষম মানুষের সিংহভাগ হলো তরুণ।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নানকার, টংক, তেভাগা, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ সব লড়াই সংগ্রামের প্রধান শক্তিই তারুণ্যর। বাংলার দামাল তারুণ্যই আমাদের সব অর্জনের প্রধান হাতিয়ার। সুতরাং বর্তমান তারুণ্যের কাছে চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছু আছে। নিজেদের আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা ভুলে দেশ নিয়েও ভাবতে হবে।তরুণরা যদি এভাবে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাহলে জাতি হারাবে আগামী দিনের যোগ্য নেতৃত্ব। গড়ে উঠবে মানসিক শক্তি সাহসহীন তাঁবেদার মেরুদণ্ডহীন নেতৃত্ব।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ