ঐতিহ্য ও গৌরবের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
এম এম মুজাহিদ উদ্দীন  © ফাইল ফটো

ইউরোপের খ্যাতিমান অনেক বিশ্ববিদ্যালয় একদা পাঠশালা ছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাঠশালাগুলো নানা কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই ইউরোপের মতো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অতীত ইতিহাসের খাতা প্রায় শূন্য। ব্যতিক্রম শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৮৬৮ সালে পুরান ঢাকার এ ক্যাম্পাসে পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায়চৌধুরী। ১৮৭২ সালে বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই বিদ্যাপীঠের নামকরণ করে একে স্কুলে উন্নীত করেন।

১৮৮৪ সালে কলেজে রূপান্তরিত করলে এ বিদ্যাপীঠ নতুন মাত্রা পায়। এবার ব্রিটিশ সরকারের নেকনজর পড়ল এই বিদ্যাপীঠের ওপর। ওই বছরই এই বিদ্যাপীঠকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজে’ উন্নীত করা হয়। অচিরেই ভারতের খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে এই কলেজ নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শাখাকে পৃথক করা হয়। তখন স্কুলের নাম হয় ‘কিশোরী লাল জুবিলী স্কুল’।

শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে ১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ)- অবকাঠামো, ছাত্র-শিক্ষক ও গ্রন্থাগারের বই প্রদান করলে পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছে এর মর্যদা বহুগুণে বেড়ে যায়। ১৯২১ সালে জগন্নাথ কলেজকে অবনমন করা হয় ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট’ পাস করে। এই আইনের ফলে এই বিদ্যাপীঠকে ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামকরণ করে এর স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়।

এই বন্ধ দুয়ার খুলেছিল ওই ঘটনার ২৮ বছর পর। ১৯৪৯ সালে এই বিদ্যাপীঠে আবার স্নাতক পর্যায়ে পাঠদান শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে এই বিদ্যাপীঠকে সরকারিকরণ করা হয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সাল থেকেই এই বিদ্যাপীঠে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। যা অদ্যাবধি চালু রয়েছে। ২০০৫ সালে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হলেও ২০১২ সালে ২৭/৪ ধারা নামক কালো আইন বাতিলের মাধ্যমে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।

বর্তমানে মোট ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৬ টি বিভাগের ও ২টি ইন্সিটিউটের মাধ্যমে এখানে প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ দেশে। তবে অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। অল্প সময়েই ভর্তিচ্ছুদের পছন্দের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই এ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই প্রতিবছরই বাড়ছে ভর্তি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেও স্নাতক সম্মান শেষেই চাকরির বাজারে অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি বিসিএস। আর সেই বিসিএস পরীক্ষায়ও তাদের সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়। প্রতিবছরই এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন ক্যাডারে প্রথম স্থান, দ্বিতীয় স্থানসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চাকরি পাচ্ছে।

দেশের প্রায় সব সেক্টরেই এই সাহসী যোদ্ধারা দেশের সেবার কাজে নিয়োজিত আছে। প্রতি বছর আবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে দেশের শান্তি, উন্নয়ন ও মান রক্ষার কাজে নিয়োজিত হচ্ছে আর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষকতা সুনামের সাথে করে যাচ্ছে। জাতীয় ও আন্তজার্তিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিয়োগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাফল্য দেখাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণার সূতিকাগার। গবেষণা উপকরণের এবং সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা থাকলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটি হাঁটি পা করে সে দিকেই পথ চলছে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ বিভাগে এমফিল, পিএইচডির কার্যক্রমে প্রায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ জে সালেহ আহম্মদ বাজারে প্রচলিত স্টিক থেকেও কম খরচে এনজাইমবিহীন গ্লুকোজ সেন্সর উদ্ভাবন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য গবেষক দল পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগ থেকে ডিজেল ও পেট্রোল তেল তৈরির প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন। অনুষদ বা বিভাগগুলোও নিয়মিত গবেষণা পত্রিকা প্রকাশিত করছে, যা তরুণ গবেষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করছে।

বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য প্রশংসনীয়। সময়ের আবর্তে ক্ষমতার পরিবর্তনে বাংলাদেশী নিয়মে ভিসির পালাবদল ঘটছে। প্রতিবছর ২ হাজারের ও অধিক শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েশন করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। আবার প্রায় ৩হাজারের মত শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচেছ। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এ বিশ^বিদ্যালয়ের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। আগামী ২০ শে অক্টোবর এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৪ বছরে পদার্পণ করবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হলের ব্যবস্থা করতে পারেনি। কলেজ থাকাকালীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ১৪-১৫টা আবাসিক হল ছিল।

কিন্তু অধিকাংশ হলই এলাকার রাজনৈতিকও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের হাতের কব্জিতে রয়েছে। বেশ কয়েকবছর পর পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলের জন্য আন্দোলন করে আসছে। পুলিশের টিয়ালশেল,রাবার বুলেট গায়ে বিদ্ধ করে রাজপথে রক্তাত্ত¦ হয়েছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছোবলে অনেকবার আন্দোলন সফলতার মুখ দেখতে গেলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কয়েকটা হল উদ্ধার হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা সংস্কার করার উদ্যেগ নেয়নি। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০০ একর জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যাধুনিক ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হবে। একনেক এর জন্য অর্থ বাজেট দিয়েছে। কিন্তু শর্ত দিয়েছে বর্তমান ক্যাম্পাসের জায়গা সরকারকে ছেড়ে দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি কেরানীগঞ্জে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ হলেও পুরাণ ঢাকার এই দুই শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল ক্যাম্পাস থাকবে। এখানে বলা দরকার যে ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ২টি ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম চলে। প্রতিকূলতা সত্বেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বপ্নবোনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একদিন বিশ্বের বুকে স্বগৌরব ও ঐতিহ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। একদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে বড় খেলার মাঠ, আবাসিক হল, অত্যাধুনিক গবেষণাগার, সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, আধুনিক ক্যান্টিনসহ আরো অনেক কিছু। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হবে বিশ্ব সেরা কোনো বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ অথবা কলামিস্ট ।

লেখক: তরুণ লেখক ও শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগও সাংবাদিকতা বিভাগ.
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence