র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন ক্রমাবনতি?

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান   © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপাতত কোনো সুখবর নেই। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতি বছর বিশ্বের বিশ্ব্যবিদ্যালয়গুলোর যে র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারের মধ্যেও নেই। তালিকাটিতে ৯২টি দেশের ১৩ শত বিশ্ববিদ্যালয় রাখা হয়েছিল।

২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬ শত থেকে আটশত এর ভেতরে। তবে বছর দুইয়েক পরেই ঢাবির অবস্থান হঠাৎই নেমে যায়। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজারেরও পরে। এমনকি এ বছরের মে মাসে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে সংগঠনটি। সেই তালিকায় উল্লেখিত এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল না।

শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এ খাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতাসহ ৫টি মানদণ্ড বিশ্লেষণ করে এই তালিকা তারা তৈরি করেছিল। গত মে মাসে প্রকাশিত তালিকায় ঢাবি না থাকায় সেই সময়ে তা নিয়ে চলছিল বিভিন্ন মহলে প্রবল সমালোচনা ও মন্তব্য। যেখানে শিক্ষকসহ রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সমালোচনায় যুক্ত হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তালিকায় সেরার মধ্যে ঢাবির নাম না থাকার কারণ জানার চেষ্টা করব এ লেখায়। বিভিন্নজনের লেখায় ও বক্তব্যে নিম্নের কারণগুলো উঠে এসেছে।

বাংলাদেশে এখন ৪৩টি পাবলিক এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরে আরো চারটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আছে৷

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যা দেড় শতাধিক। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’র এই তালিকা তৈরিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি- এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে৷ তাদের এই তালিকায় এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এসেছিল। দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং তৃতীয় অবস্থানে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ছিল।

তালিকায় চীনের ৭২টি, ভারতের ৪৯টি, তাইওয়ানের ৩২টি, পাকিস্তানের ৯টি এবং হংকংয়ের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল। এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল এই তালিকায়। শুধু ছিল না বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

গতবারে তালিকায় নাম না থাকা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে হাস্য-রসের জন্ম দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম অভিযোগের সুরে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে অর্থ না দেয়ায় এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নাম আসেনি।

এদিকের ডিনের বক্তব্য পরিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, র‍্যাঙ্কিংকারী একটি সংস্থার একজন প্রতিনিধি তাদের নাকি বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় তথ্য দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিংয়ের আওতাভুক্ত হবে। ভিসি আশার বাণী শোনালেন। কিন্তু নতুন তালিকায় ক্রমাবনতি তো ঠেকানো গেল না। সেই সময় বসে ছিলেন না রাজনীতিবিদেরাও।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খান র‍্যাঙ্কিংয়ে না থাকার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ উল্লেখ করেছিলেন। মোটকথা ঢাবি যে খুব একটা ভালো পজিশনে নেই তা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়েছিল।

নতুন প্রকাশিত তালিকায় না থাকায় বিষয়টি নিয়ে আরো সমালোচনা হবে তা একেবারে নিশ্চিত। এখন আসি তালিকায় নাম আসার ক্ষেত্রে জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের মানদন্ড কী? কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) প্রতি বছর ১১টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। এ ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে: প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাফল্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাফল্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক-কর্মকর্তার সংখ্যা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময়ের হার।

এছাড়া আরো কিছু ফ্যাক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং তৈরীতে ভূমিকা রাখে। তার মধ্যে অন্যতম হলো– শিক্ষাক্ষেত্রে সুনাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে সুনাম, দেশি-বিদেশি শিক্ষকদের অনুপাত এবং দেশি-বিদেশি ছাত্রদের অনুপাত। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতি, শিক্ষক ও কর্মচারীদের দক্ষতা, শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভাগীয় কৃতিত্ব তথা গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঢাবির তালিকায় না থাকা এবং থাকলেও পশ্চাতে থাকা নিয়ে কারণ অনুসন্ধান করে যা জানা যায়। নষ্ট ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষকের ‘দলবাজি’, সাদা-নীল-গোলাপিতে বিভক্তি, শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা।

গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায় উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সাড়ে ৮ বছরের মেয়াদে মোট ৯০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জন এবং সীমাহীন দলীয়করণ তো আছেই।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে ও সিট পেতে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। ফলে তারা গণরুমে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ঢাবি বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রায় অনুপস্থিতি বা শেষের দিকে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে গবেষণার হার কম থাকা, শিক্ষার সুনাম ক্রমাগত কমতে থাকা ও সনদ-নির্ভর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মূলত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকেন। কিন্তু দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত অর্থের অপ্রতুলতা, অনুকূল পরিবেশের অভাব, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষের চেয়ে প্রশাসনিক দিককেই বেশি গুরুত্ব প্রদান, কিছু শিক্ষকের শিক্ষা বিমুখতা ও শিক্ষকতার চেয়ে রাজনৈতিক গ্রুপিং-লবিং, দলকানা দলদাসের রাজনীতিতে সময় বেশি দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিং ইউনিভার্সিটিতে পরিণত হয়েছে৷ শুধু পড়ানো হচ্ছে। এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বিসিএস ক্যাডার তৈরির আঁতুড়ঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কি সরকারি চাকরিজীবী বানাবার কারখানা? এটা কি ট্রেনিং সেন্টার? বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের সন্নিবেশ ও উদ্ভাবন করার জায়গা। তা কিন্তু একদমই হচ্ছে না।

ঢাবির গবেষণা খাতে অর্থের অপর্যাপ্ততা ও অর্থের সঠিক ব্যবহার না হওয়া নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ঢাবি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৮১০ কোটি ৪২ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করে। তবে বাজেটের আকার বাড়লেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ কমেছে। গত বছরের তুলনায় বাজেটের আকার ৯.৩৫ শতাংশ (৬৯ কোটি ২৯ লাখ) বাড়লেও গবেষণায় বরাদ্দ কমে গেছে ২.৮৪ শতাংশ। গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ২.১ শতাংশ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের যে বাজেট, তা আমাদের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ বছরের বাজেটের চেয়েও বেশি।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক গবেষণা সংক্রান্ত ব্যয় ২.৩১ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ১৯ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক গবেষণা ব্যয় ১১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। ডিউক, স্ট্যানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বার্ষিক ব্যয় যথাক্রমে– আট হাজার ৬৩২ কোটি, আট হাজার ৪৬৬ কোটি এবং আট হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

শুধুমাত্র একাডেমিক সাফল্যের উপর ভিত্তি করে URAP( university ranking by academic performance) প্রকাশ করে। URAP এর ২০১৮-১৯ তালিকা বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি চমকপ্রদ। একাডেমিক দিক থেকে আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ ১৫০০ এর মধ্যেই নেই। অথচ ‘URAP 1500’-তে ভারতের ৪৬টি আর পাকিস্তানের আটটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

‘QS World University Ranking’ অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার মধ্যে আমাদের দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও দুইটিই শ্রেষ্ঠ ৮০০ এর বাইরে। আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই টপ ১০০০ এর মধ্যে তাদের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে আর টপ ৫০০ তে আছে ৯টি। পাকিস্তানের দিকে তাকালে টপ ১০০০-এ তাদের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করে ঢাবির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত বুদ্ধি, বাকস্বাধীনতা টিকে থাকলে জাতির টিকে থাকা সহজতর হয়। উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হতে ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ রক্ষায় আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।


সর্বশেষ সংবাদ