ডেঙ্গুতে আক্রান্ত দেশ, দরকার গণসচেতনতা

  © সংগৃহীত

বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম। ডেঙ্গু নিয়ে প্রতিনিয়তই জনমনে উদ্বেগ যেমন বাড়ছে, তেমনি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে অজানা এক আতঙ্ক । এমন আতঙ্ক আর উদ্বেগের পরিস্থিতি কেন তৈরা হলো, এর জন্য দায়ীই বা কারা- এসব প্রশ্নও এখন জোরালো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলেই এই পরিস্থিতি হয়েছে। যদিও সাধারণ জনগণ ভিন্ন কিছু মনে করে। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কোনা কারণ নেই, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু অবস্থা দেখে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। কেননা গত কয়েকদিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয় যে এটা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের মাঝে খুব সহজেই ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু মূলত মশা বাহিত রোগ। এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা মারতে ব্যর্থ হওয়ায় এটা একজন থেকে আরেকজনের মাঝে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে চাইলে সবার আগে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মশা মারায় ব্যর্থতা হলে কখনোই এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

১৯৯৩ সালে একবার রংপুরে মশার প্রকোপ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। জানা যায় তৎকালীন পৌর মেয়র সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু মশার বৃষ্টি বন্ধে অভিনব এক পদ্ধতি অবলম্বন করে সারাদেশে আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৫০০ মশা জমা দিলে ১০০ টাকা দেয়া হবে। কাজেও দিয়েছিলো তাঁর ঐই ঘোষণা। মাত্র ১৫ দিনে মশার প্রকোপ অনেক কমে গিয়েছিলো।

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অনেকেই ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার ঘটনার মুখে সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুর সেসময়কার পদক্ষেপ ফের আলোচনায় এসেছে। জনসাধারণের একটিই দাবি ঔষুধেও যদি কাজ না হয় তাহলে এমন কোনো অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করুন,যাতে আমরা মশার ভয় থেকে পরিত্রাণ পাই। কেননা মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টায় সারাক্ষণ মনোযোগ থাকলে সব কাজই বিঘ্নিত হয়। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবন। সারাক্ষণ মশারির ভেতর অবস্থান করাও সম্ভব নয়। তাই মশা যাতে বংশ বিস্তার করতে না পারে সে দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে।

Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর এক হিসাব অনুযায়ী ২০৮০ সালের মধ্যে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১.৫ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন। এর কারণ হলো উষ্ণতা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা পৃথিবীজুড়ে বেড়েই চলেছে। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশও এর মধ্যে পড়েছে। যত খরা, তত ডেঙ্গুর ঝুঁকি। এর কারণ এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক, এই মশার জীবনচক্র থেকে দেখা যায় আবহাওয়া যত উষ্ণ হবে তার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দিন তত কম হবে। ফলে এটি খুব দ্রুত রোগ ছড়াতে পারে। বর্তমানে হচ্ছেও তাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপটা অনেক বেশি। শুধু যে জলবায়ু পরিবর্তনই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির একমাত্র কারণ তা নয়, অন্যান্য কারণও আছে। তবে ডেঙ্গু বিস্তারে যে মূলত আমরাই দায়ী এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমরা যদি একটু সচেতন হতাম,তাহল আর যাই হোক ডেঙ্গুর প্রকোপ এতো বৃদ্ধি পেত না।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের এখনই কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, কেননা মানুষ যে হারে প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এমনটা চলতে থাকলে খুব শ্রীঘই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলতে যেতে পারে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা—সবাইকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের প্রশাসনে জনবলের ঘাটতি থাকায় সামাজিক আন্দোলনের প্রতি বেশি জোর দিতে হবে। কেননা অপর্যাপ্ত জনবল দিয়ে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আসলেই দুরূহ কাজ। তাই জনগণের সচেতনা বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগী হওয়াই বেশি জরুরি। শুধু নিজে নিজে সচেতন হলে হবে না সকল মানুষকেও সচেতন করতে হবে। সকলেই যদি সচেতন থেকে নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করে তাতে কাজ হবে বলে মনে করি। এডিস মশার বংশ বিস্তার তো আমরাই করি। আমরা যদি আমাদের আশেপাশের সব কিছু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলে তো এডিস মশা আর বংশ বিস্তারের সুযোগ পাবে না। হবে না ডেঙ্গুও। আসুন, আমরা নিজেরা সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি ডেঙ্গু প্রতিরোধে অবদান রাখি।

লেখক : শিক্ষার্থী : দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ