গুজব-গণপিটুনি, সরকারের দায় ও করণীয়
- আব্দুল মজীদ অন্তর
- প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০১৯, ১০:৪৮ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:২১ PM
গত কয়েকদিনে বাংলাদেশে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ও ভয়াবহতম ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলো গণপিটুনি! কি নির্মম নিষ্ঠুরভাবে মানুষ মানুষকে পিটিয়ে মারছে! যদিও এটা বাঙালিদের অনেক পুরনো ব্যাধি কিন্তু ইদানিংকালে এটা সংক্রামক হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ রূপে।
গত ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহতদের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে, আহতদের হিসেব করলে শতক পূর্ণ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শুধুমাত্র গত দুদিনেই গণপিটুনিতে আহত হয়েছে প্রায় ৩০ জনের মত। গণপিটুনিতে যারা আহত বা নিহত হচ্ছেন তারা কেউই কোন অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত নয়, সবাই প্রায় নিরিহ, নিরপরাধ মানুষ। এদের বেশিরভাগ মধ্যবয়সী নারী, মানসিক ভারসাম্যহীন, ভিক্ষুক অথবা কোন কর্মজীবী অপরিচিত পথচারী।
কেন এই গণপিটুনি?
গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে শুধুমাত্র গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে। আর গুজব বাঙালিদের অনেক পুরনো কুসংস্কার ও মানসিক রোগ। গুজব হলো এক ধরনের ভ্রান্ত প্রোপাগান্ডা যার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। মিথ্যা, ভিত্তিহীন গল্পের মাধ্যমে সমাজে গুজবের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে যে গুজবের মাধ্যমে একের পর এক নিরিহ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে তা হলো ছেলেধরা গুজব!
অনেক অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক মনে করে বড় বড় ব্রিজ বা সেতু নির্মাণে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথা লাগে, ব্রিজের নিচে কাটা মাথা না দিলে ব্রিজ চলাচলের উপযোগী হবে না অথবা ভেঙ্গে পড়বে, তাই সেতু নির্মাণের সময় ছেলেধরারা বস্তা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায় আর বাচ্চাদের একা পেলে মাথা কেটে নিয়ে যায়! এরকম গল্প অনেকেই হয়তো নানী দাদী অথবা মায়ের কাছে শুনেছেন। ফলে অনেক বাচ্চা এটাকে সত্য মনে করে আতঙ্কিত থাকে এবং পূর্ণ বয়ষ্ক অনেকেই এটাকে সত্য মনে করে থাকে এমনকি কিছু শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেও এধরণের ভ্রান্ত ধারণা বিরাজমান যা খুবই উদ্বেগের বিষয়! লোকমুখে প্রচলিত এসমস্ত গল্প সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক । বাস্তবতা হলো ছেলেধরা বলতে কোন কিছু নেই, ব্রিজ নির্মাণেও কোন মানুষের মাথা লাগে না। যা শোনা যায় তা গুজব এবং কুসংস্কার।
অনেক সময় শত্রুতার জের ধরে প্রতিবেশি শিশুদেরকে হত্যা করা হয়, হত্যার ধরনের উপর নির্ভর করে অনেক সময় গুজবের সৃষ্টি হয় যা মুল সত্য ঘটনাকে আড়াল করে দেয়। যেমন কোন শিশুকে হত্যার পর যখন তার শরিরের অর্ধেক বা মাথা পর্যন্ত যদি কোন নালা নর্দমায় পুঁতে রেখে দেয় তাহলে গ্রামের অনেক লোক এর পিছনে ভুত টাইপের অদৃশ্য অপশক্তির অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায় যা কুসংস্কার ব্যতীত কিছু নয়, এটাও একটা গুজব! ঠিক একইভাবে শত্রুতার জেরে কোন শিশুকে যখন গলা কেটে হত্যা করা হয় তখন তাকে ছেলেধরা হিসেবে প্রচার করে গুজব ছড়ানো হয়। এতে করে মানুষের মাঝে সন্দেহ এবং আতঙ্ক বেড়ে যায়। যার প্রভাব পরে গোটা সমাজে। এই গুজবের ফলে অনেক নিরিহ, নিরপরাধ মানুষকে বরণ করতে হয় করুণ ও নির্মম পরিনতি।
ঠিক এমনই এক গুজবের শিকার মা তাসলিমা বেগম রেনু। নিজের সন্তানের ভর্তির জন্য রাজধানীর বাড্ডায় গিয়েছিলেন স্কুলের খোঁজ নিতে। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি সন্তানের কাছে। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রেনুকে । রেনু হয়তো একটা বার কথা বলার সুযোগ চেয়েছিল, তিনি হয়তো বার বার আকুতি জানিয়েছিল আমি কোন ছেলেধরা নই, আমি একজন 'মা'। নিষ্ঠুর জনতা মাকে সেই সুযোগটুকুও দেয়নি।
হিংস্র অমানুষদের একের পর এক লাথি আর পিটুনিতে লুটিয়ে পড়ে রেনু। তার চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠছিল তার সন্তানদের ছবি, তার সন্তানরা যে এতিম হয়ে গেল, বাড়িতে অপেক্ষা করছে আদরের সন্তান তোবা! মাকে না পেলে ওর কান্না যে থামানো যাবে না! রেনু যে আর কোনদিনই তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে না। তার আদরের সন্তানেরা যে আর কোনও দিনই রেনুকে মা ডাকতে পারবে না! মা হয়তো বারবার আকুতি জানিয়ে বলছে তোমরা আমাকে মেরও না, আমার সন্তানদেরকে তোমরা এতিম করো না, ওরা যখন শুনবে মা আর কোনদিন ফেরে আসবে না ওরা খুব কষ্ট পাবে, ওরা খুব কান্না করবে!
সন্তানদের এই কষ্ট হয়তো মা ছাড়া আর কারও উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। উৎসাহি জনতার মাঝে একজন সন্তানেরও অস্তিত্ব ছিল না যিনি মায়ের আকুতি শুনতে পেয়েছিল, একজন বাবাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি যিনি সন্তানের কথা চিন্তা করে মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল! আমরা এমনই এক সমাজে বাস করছি যে সমাজ আজও হতে পারেনি সভ্য, বিবেকসম্পন্ন ও মানবিক। আমরা এখনও রয়েগেছি বর্বর, অসভ্য ও মূর্খদের কাতারে।
জনজীবনে এই গুজবের মারাত্মক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। গুজব সৃষ্ট গণপিটুনির ফলে জণমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মা অথবা বাবা তার নিজের সন্তানকে নিয়েও বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষ দুরে কোথাও কর্মস্থলে যেতে ভয় পাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী রাস্তার মাঝে ঝগড়া করলেও ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি! জেলে মাছ ধরতে গিয়েছে, অপরিচিত হওয়ায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হতে হচ্ছে। কেউ বেঁচে যাচ্ছে আবার কেউ নির্মমতার বলি হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
এ দায় কার?
যেকোন গণপিটুনির ঘটনায় জনগণের উপর দোষ চাপিয়ে সরকার দায় এড়াতে পারে না। জনগণ কেন আজ খুনির ভুমিকায়, কেন আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজেরা হত্যার মত জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে? এর একটা কারণ হতে পারে আইনের প্রতি আস্থা না থাকার ফল। রাষ্ট্র যখন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় জনগণ তখন আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে আইনকে নিজের হাতি তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। আইনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ! প্রতিনিয়ত চোখের সামনে অপরাধীকে আইনের ফাঁকে পার পেয়ে যাওয়ার চিত্র দেখার পর জনগণ সাধারণত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে না। এটা রাষ্ট্রের একটা বড় ব্যর্থতা, এই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
কিভাবে এই গুজব বন্ধ করা যেতে পারে?
গুজব ঠেকাতে প্রথমত সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং আমাদেরও সচেতন ভুমিকা পালন করতে হবে। আমি কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি যা কার্যকর হলে গুজব কমে যেতে পারে এবং নিরিহ মানুষ গণপিটুনির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে।
১.সরকারের উদ্যোগে প্রতিটি স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসায় জরুরি নোটিশ পাঠানো যেতে পারে, এগুলোতে যদি নোটিশ দিয়ে গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন করে তোলা হয় তাহলে অনেকাংশেই গণপিটুনির মাধ্যমে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা থেকে রক্ষা করা যাবে (যেমনটি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ভুমিকা রেখেছিল)।
২. প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, পৌর কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড কমিশনারের উদ্যোগে নিজ নিজ এলাকায় মাইকিং করে গণসচেতনতার মাধ্যমে গুজব বন্ধ করা যেতে পারে। যদি কাউকে সন্দেহ হয় তাকে কোন ধরণের নির্যাতন না করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা কোন স্কুলের শিক্ষকের নিকট হস্তান্তর করা যেতে পারে যারা পরবর্তীতে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিবে।
৩. প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানে পোস্টারিং এর মাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।
৪. সরকারের উদ্যোগে প্রতিটি মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে সচেতন করা যেতে পারে।
৫. সংবাদ মাধ্যমগুলোকে সচেতন ভুমিকা পালন করতে হবে। 'ছেলেধরা সন্দেহে' শব্দটি ব্যবহার না করে 'গুজব ছড়িয়ে নিরিহ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা' এই টাইপের সংবাদ প্রচার করা যেতে পারে। যাতে করে ছেলেধরা শব্দটির প্রচার কম হবে, ভিতি কম ছড়াবে।
৬. গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনলে গণপিটুনি কমে যেতে পারে।
সর্বপরি বিচারের আওয়তায় না এনে যে কাউকে নির্যাতন করা বা হত্যা করা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা প্রচার ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
আমরা চাই সবাই নিরাপদে এদেশে শান্তিতে বসবাস করুক। বিনা অপরাধে এবং বিনাবিচারে একটি প্রাণও যেন না ঝড়ে, কেউ যেন নির্যাতিত না হয় সেটা রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাবেক সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। সমন্বয়ক রাকসু আন্দোলন মঞ্চ।