বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস: দরকার নাকি হস্তক্ষেপ?
- আব্দুল্লাহ আল মামুন (তুষার)
- প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ০৫:৩৬ PM , আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৬ PM
সাধারণত কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিক অভিযোগ, গুরুতর উদ্বেগ বা দমনমূলক পরিবেশ তৈরি হলে, যা জাতীয় ব্যবস্থায় সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখনই আন্তর্জাতিক সহায়তা, নজরদারি ও জবাবদিহির জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উপস্থিতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কার্যনির্বাহী অফিস (OHCHR) একটি অফিস স্থাপন নিয়ে এখন বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, OHCHR এবং UNHRC এ দুইটি সংস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন– OHCHR মাঠপর্যায়ে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ, তদন্ত ও কারিগরি সহায়তা দেয়; এবং UNHRC বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক মঞ্চ, যারা নীতিনির্ধারণ ও আলোচনায় অংশ নেয়। এছাড়াও OHCHR রিপোর্ট তৈরি করে; আর UNHRC সেই রিপোর্ট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে; অন্যটি নীতিগত ও কূটনৈতিক স্তরে সক্রিয়।
বাংলাদেশে যেই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে সেটি হচ্ছে OHCHR। কেউ বলছে এটা দেশের জন্য প্রয়োজন, আবার কেউ বলছে এটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ।
মূলত, জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের (OHCHR) কাজ–গুম, নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য সংগ্রহ করা ও সেগুলা বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘে উপস্থাপন করা। সংস্থাটি বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। প্রয়োজনে কারিগরি সহায়তাও দেয়।
বাংলাদেশে এ অফিস স্থাপনের সিদ্ধান্তের পেছনে মূলত ফ্যাসিস্ট আমলের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদন সেই ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।
এ অফিস থাকলে অনেকগুলো ভালো দিক হতে পারে। যেমন- রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সহায়তা আরও জোরালো হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো জায়গায় মানবাধিকার পরিস্থিতির নজরদারি বাড়বে। গুম বা নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলো আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইতে পারবে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ থাকবে যাতে তারা স্বচ্ছভাবে কাজ করে। মানবাধিকার সংক্রান্ত সংস্কারে কারিগরি সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বাড়তে পারে।
তবে এর কিছু খারাপ দিকও উঠে আসবে। যেমনটা দেশের রাজনৈতিক স্বার্থে হস্তক্ষেপ এবং গোয়েন্দা বা নিরাপত্তা সংস্থার তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠা। অনেক সময় মানবাধিকার ইস্যু রাজনীতির হাতিয়ারও হতে পারে।
এছাড়া, পার্বত্য জেলায় স্বার্থান্বেষী মহলকে সাপোর্টিভ ভূমিকা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এলজিবিটিকিউ সমর্থন, ধর্মীয় উগ্রপন্থি ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতে হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠার ব্যাপারগুলোও থাকবে। আমরা যদি মানবাধিকার উন্নয়নে আন্তরিক হই, তবে OHCHR ভয় না পেয়ে কাজে লাগানোই উচিত। স্বচ্ছ কাঠামো ও সংলাপের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রম দেশের জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে।
এজন্য আলাপ-আলোচনা, নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ এবং দেশের আইন মেনে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে এমন একটি কাঠামো দরকার। সরকার যদি OHCHR এর সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করে, তাহলে এর সুবিধাগুলো বেশি প্রাধান্য পেতে পারে। অন্যদিকে, যদি এটিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দিবে।
লেখক, সাংবাদিক ও ফ্যাক্ট চেকার,
সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা)।