জাতীয় ঐক্য এবং জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাব্য রূপরেখা

ড. শাহনূর হোসাইন
ড. শাহনূর হোসাইন  © সংগৃহীত

দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনে নিষ্পেষিত মানুষ জুলাইয়ে হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যে উপনীত হয়, তা এখন নানা ধারায় বিভাজিত। রক্তাত্ব এই অভ্যুত্থানে অংশগহনকারী নানাগোষ্ঠীর মধ্যে এই অনৈক্য অভ্যুত্থানের কাঙ্খিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে প্রতিবন্ধক হতে পারে বলে রাজনৈতিক চিন্তকদের আশংকা। এমতাবস্থায় বিভিন্ন মহল থেকে পুনরায় জাতীয় ঐক্য বিনির্মানের আহবান উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি কি হবে সেটি এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে জুলাই একটি অভ্যুত্থান হলেও তাতে বিপ্লবের আবহ ছিল।  সুনির্দিষ্ট  রূপরেখা থাকলে এই অভ্যুত্থানকে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি জাতীয় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক  বিপ্লবে রূপ দেয়া সম্ভব। এমতাবস্থায় একটি টেকসই জাতীয় ঐক্য বিনির্মাণ এবং জনগণতান্ত্রিক জাতীয় বিপ্লবকে বাস্তবে রূপ দিতে নিম্নোক্ত ২৪ দফা প্রস্তাব করছি :

১. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তন: বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ এক যুগ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত কোথাও জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। এমতাবস্থায় জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা আবশ্যক। স্থানীয় সরকারগুলো বর্তমানে নির্বাচিত প্রতিনিধিবিহীন বিধায়  বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনগুলো পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন।

২. রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে  ভারতের প্রভাব মুক্ত করা : ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক হবে আন্তঃরাষ্ট্রীয়। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করেছে।  যেহেতু ভারতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ভারতের সকল প্রভাব থেকে মুক্ত করতে সকলকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্টান কিংবা দল ভারতের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করলে উক্ত ব্যক্তি কিংবা দলকে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার দায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৩. নুতন সংবিধান প্রণয়ন: যেহেতু বর্তমান সংবিধান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং উক্ত সংবিধানের অধীনে দুই দুইবার ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা  কায়েম হয়েছে, এমতাবস্থায় জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার  সাথে সামজ্ঞস্য রেখে একটি নুতন সংবিধান রচনার ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক শক্তিকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় সকল অংশীজনের সমন্বয়ে একটি সাংবিধানিক পরিষদ গঠন করে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে একটি খসড়া প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ  এক বছরের মধ্যে পরিমার্জন এবং পরিবর্ধন শেষে চূড়ান্ত করবে।

৪. রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম চলমান রাখা : দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনে ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে সবাইকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে।  রাষ্ট্র সংস্কারের  লক্ষ্যে বর্তমানে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের সুপারিশগুলোকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার পাশাপাশি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিষ্টানগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হবে।

৫. মুক্তিযুদ্ধের নামে জাতিকে বিভক্ত করার অপরাজনীতি পরিহার করা : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করতে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের কোন বিকল্প নেই। অতীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে পুরো দেশকে বিভক্ত করে জাতীয় স্বাধীনতাকে দূর্বল করে বাংলাদেশেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির নিকট পদানত করা হয়েছে। জাতিকে বিভাজিত করে এমন সকল রাজনৈতিক এজেন্ডা সর্বোতভাবে বর্জন করতে হবে।

৬. জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন: যে কোন জাতীয় সংকট মোকাবেলায় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা আবশ্যক। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জনগণের সাথে আলোচনা করে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করবেন।  রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতি  সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৭. রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত করা: অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে অনেকে আলাদিনের জাদুর চেরাগ হিসেবে ব্যবহার করেছে। নুতন বাংলাদেশে  রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপরায়ণ ব্যক্তি যাতে কোন দল থেকে কোন নির্বাচনে মনোনয়ন না পায় সে ব্যাপারে  সবাইকে সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে।

৮.  নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সকল প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা: স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সকল নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।  নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্টান হিসেবে বিকশিত হতে সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হবে। আগামী চারটি নির্বাচন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অধীনে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে।

৯. রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ: রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং  জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ নিশ্চিত করা। কোন ব্যক্তিকে কোন পদে নিয়োগের পূর্বে তার পূর্ববর্তী কর্মকান্ড খতিয়ে দেখা এবং জন সাধারণের মতামত নেয়া আবশ্যক করতে হবে। ইতোমধ্যে যে সকল বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিভিন্ন পদে আসীন করা হয়েছে, তাদেরকে অপসারণ করে সৎ, যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য লোকদের মনোনয়ন দেয়া।

১০.  জুলাই  অভ্যুত্থানে গণ-হত্যাকারীদের বিচার: জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িত ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার দ্রুত সম্পাদন করতে হবে।  ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, পুলিশ, র্যাব , বিজিবি সহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।

১১. টিভি নাটক-সিনেমায় কোন ধর্মীয় পরিচ্ছদকে টার্গেট না করা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে  দাড়ি টুপিকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে মিডিয়ায় উপস্থাপন করা যাবেনা। অতীতে যেসব ব্যক্তি এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল তাদেরকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

১২. যে কোন উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ: যেহেতু উগ্রবাদী কর্মকান্ড জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, সেহেতু  সকল ধরণের উগ্রবাদী রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

১৩. দুর্নীতিলব্ধ সম্পদ উদ্ধার এবং দুর্নীতিবাজদের বিচার: বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে নজিরবিহীন দুর্নীতি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।  ব্যাংক লুট, শেয়ার বাজারে কারসাজি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাটসহ (প্রায় সতের লক্ষ্য টাকা) দেশ থেকে প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।  এমতাবস্থায় দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, দুর্নীতিলব্ধ অর্থ উদ্ধার এবং  পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি।

১৪. বিগত ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে দায়ের করা সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার: বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিরোধী দলসমূহকে দমন-পীড়নের উদ্দেশ্যে দায়ের করা সকল হয়রানিমূলক এবং গায়েবি মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

১৫. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার: পিলখানা হত্যাকান্ডকে জাতীয় ট্রাজেডি ঘোষণা এবং এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত দেশি বিদেশী কুশীলবদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৬. জাতীয় সংখ্যালগু  কমিশন গঠন: রাষ্ট্রের সকল স্তরে সনাতনসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং  তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিশেষ কমিশন গঠন।

১৭. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা: ফ্যাসিবাদের দালাল ব্যতীত সকল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে ২০০৬ সালের ১/১১ থেকে শুরু করে যেসকল সংবাদ মাধ্যম ফ্যাসিবাদের উত্থান কিংবা প্রতিষ্টায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে  সহযোগিতা করেছে তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।

১৮. সকল গুম-খুনের বিচার:  ইলিয়াস আলী, সাগর রুনি, চৌধুরী আলম সহ সকল গুম খুনের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অবিলম্বে শুরু করতে হবে।

১৯. আওয়ামী লীগের বিচার : দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্টা, জুলাইয়ের গণহত্যা, জনগণের ভোটাধিকার হরণ, নজিরবিহীন দুর্নীতি, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজার লুটসহ ১৬০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জাতীয় সম্পদ পাচারের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে।

লেখক:  সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, সান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence