ইসিএ হলো পাঠ বহির্ভূত কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত রূপ

ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার
ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার   © ফাইল ছবি

যারা উচ্চমাধ্যমিক শেষে দেশের বাহিরে পড়তে যেতে চায় তাদের জন্য Extracurricular Activity (ECA/ ইসিএ) বা পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ ও বৈচিত্র্য দেখতে চায়। তারা চায়, তাদের ক্যাম্পাসে এমন শিক্ষার্থীদের সমাহার ঘটুক, যাদের আগ্রহ শুধু শ্রেণীকক্ষ বা পড়াশোনায় কেন্দ্রীভূত না থেকে বাহিরের জগতের নানাবিধ কর্মকাণ্ডে ছড়িয়ে পড়বে। বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়ে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করবে।

তবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে একজনকে সকল ধরনের ইসিএ-তে পারঙ্গম হতে হবে। অলরাউন্ড নৈপুণ্য দেখাতে পারলে ভালো। তার মানে অলরাউন্ডারই হতে হবে এমনটা নয়। যে কোনো নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রের পারঙ্গমতা শিক্ষার্থীকে এগিয়ে নিতে পারে। যেমন, চাঁদপুরের নাফিস উল হক সিফাত ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদক জিতে এইচএসসি পাসের আগেই এমআইটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে, হার্ভার্ডে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সিয়াম শহীদ নূরের অলিম্পিয়াডে পদক ছিল না, কিন্তু বহুমুখী ক্ষেত্র- পাবলিক স্পিকিং, নেতৃত্ব ও মেন্টরিং, বিতর্ক, বৈজ্ঞানিক প্রকল্প প্রস্তুতকরণ, খেলাধুলা, ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে পারদর্শিতা ও পদক ছিল।

ইসিএ-কে বলা যায় শিক্ষাক্রমের বর্ধিতাংশ। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। নিয়মিত পড়াশোনা বা এ জাতীয় কাজের বাহিরে যেসব কাজ করা হয় সেগুলোই ইসিএ। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ পূরণের উদ্দেশ্যে নিয়মিত স্কুল কার্যক্রম, পাঠ্যক্রম বা কোর্সের বাইরে সংগঠিত বিভিন্ন কার্যকলাপ ইসিএ-এর অন্তর্ভুক্ত। কোনো কোনো দেশে এগুলো সহশিক্ষাকার্যক্রম নামেও পরিচিতি।

সাধারণভাবে, কাজগুলোকে এমন হতে হবে যার মাধ্যমে শুধু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীই বিকশিত হবে না। বরং সমাজ বা নিদেনপক্ষে আশেপাশে থাকে মানুষের উপর একটা ধনাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করবে। ধরা যাক, কেউ গান গাইতে পারে, কিন্তু সেটা শুধু স্বগৃহে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। সে গান গেয়ে, বা গান শেখানোর ভিডিয়ো তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে পারে। তাহলে মানুষ বিনোদন পাবে বা গান শিখতে পারবে। 

ইসিএ-এর মধ্যে রয়েছে- খেলাধুলা, গান, ছবি আঁকা, জনসেবামূলক কাজ, ক্লাব ও দল গঠন, শখের কাজ, ও অন্যান্য। দাবা ক্লাব, বিতর্ক দল, নাটকের ক্লাব, শিক্ষার্থী পরিষদ, ফুটবল দল, গানের দল, হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক, বিদেশি ভাষা শেখার গ্রুপ, গানের দল, ব্লগ লিখা, ভ্লগ তৈরি, রান্না করা, পরিবারের বা বিদ্যালয়ের ছোটোদের পড়াশোনায় সাহায্য করা, ইত্যাদিও ইসিএ-এর অন্তর্ভূক্ত।

ইসিএ-এর কার্যক্রমের মধ্যে আরও থাকতে পারে- লোকালয়ে সেবা প্রদান, বিবিধ মানবিক কার্যক্রম, খণ্ডকালীন চাকুরি, পরিবারে বিশেষ দায়িত্ব পালন, অনুদানমূলক কাজ, ক্যাম্পিং, ট্রেকিং, ফটোগ্রাফি, যোগব্যায়াম, শিল্পকলা, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, ইত্যাদি। এগুলো বিদ্যালয় কেন্দ্রিক যেমন, ক্লাব, খেলাধুলা, ও শিক্ষার্থী পরিষদ; অথবা সমাজকেন্দ্রিক হতে পারে, যেমন, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, স্থানীয় দল গঠন, পাড়ার কোনো দলে অংশগ্রহণ, ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা। আসলে ইসিএ-এর তালিকা করলে, আজকের প্রবন্ধের পাতায় ঠাঁই হবে না। নির্দিষ্ট পড়াশোনার বাহিরে গঠনমূলক যা যা করা যায়, তার সবই ইসিএ-এর অন্তর্ভূক্ত। 

ইসিএ শিক্ষার্থীদের জীবনে নানাবিধ সুফল বয়ে আনে। ইসিএ শিক্ষার্থীদের নতুন দক্ষতা, আগ্রহের ক্ষেত্র এবং বন্ধুত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব, আবেগ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মীদের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। ইসিএ-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় ফুটে উঠে। এগুলো শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার দক্ষতা, দায়িত্বের প্রতি আনুগত্য, সময় ও অগ্রাধিকার ব্যবস্থাপনা প্রকাশের মাধ্যম।ইসিএতে অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক পরিধি বৃদ্ধি পায়, সমাজ ও মানুষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, এবং নেতৃত্বের দক্ষতা পরিশীলিত হয়।

আরও পড়ুন: দুর্বল শিক্ষার্থীদের ব্যবস্থাপনা 

গবেষণায় দেখা যায়- ইসিএ-তে অংশগ্রহণের ফলে দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষার্থীদের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ফয়সালার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক ইলিয়ট জাকারবার্গের কথা স্মরণ করা যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময়ে তিনি ক্যাম্পাসের বন্ধুদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তা আর হার্ভাডের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

ইসিএ শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়াকে তেজদীপ্ত করার পাশাপাশি সামাজিক, মানসিক ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী অভিজ্ঞতা অর্জন করে, এবং যা শিখে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের সুযোগ পায়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষের বাহিরে নেতৃত্ব, সহযোগিতা, সামাজিক দক্ষতা, আত্মনির্ভরশীলতা, সৃজনশীলতা ও কঠোর পরিশ্রম করার শিক্ষা পেয়ে থাকে। ইসিএ শিক্ষার্থীর বায়োডাটাকে সমৃদ্ধ করে, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করে। উদারহরণস্বরুপ, কোনো শিক্ষার্থী যদি ব্যবস্থাপকের চাকুরি নিতে চায়, সেক্ষেত্রে সে যদি কোনো ক্লাব বা ইভেন্টের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে, তাহলে তা তার জীবনবৃত্তান্তকে শক্তিশালী করবে। 

এ ধরনের কাজ শিক্ষার্থীদের গ্রেড উন্নয়ন, নম্বর ও অ্যাকডেমিক দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং নতুন আগ্রহ ও আবেগের ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করে। এগুলো শিক্ষার্থীদের বেশি করে শিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়, এবং আগ্রহের ক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের নতুন মানবীয় দক্ষতা বা  সফট স্কিল অর্জনেও ইসিএ সহায়তা করে, যেমন- দায়িত্বশীলতা, আত্মবিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, দলগত কার্য সম্পাদনের উপযুক্ততা, সীমিত সুযোগ ও সম্পদের সদ্ব্যবহারের দক্ষতা, একসাথে একাধিক কাজ সম্পাদনের দক্ষতা, শৃঙ্খলা, নেত্বত্ব ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।

এগুলো শিক্ষার্থীদের সবলতা, দুর্বলতা  ও লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করে। এছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক দক্ষতা যেমন, নতুন বন্ধু তৈরি, সংগঠক হওয়া, নানা ধরনের মানুষের সাথে মিথস্ক্রিয়া, মূল্যবোধ গঠন, এবং গোষ্ঠী চেতনা জাগ্রত করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ, সহযোগিতা ও দ্বন্দ্ব নিরসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও এগুলোর ভূমিকা রয়েছে। ইসিএ অনেকের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনন্য করে তোলে, কারণ এগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব, অর্জন, প্রভাব, পেশাগত দক্ষতা, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতার সমাহার, ও সম্ভাবনা দেখাতে পারে। আত্মনিবেদন, আত্মসম্মান, উদ্যোগ ও বিভিন্নতাও এসব কাজের মাধ্যমে তারা তুলে ধরতে পারে। পেতে পারে উদ্ভাবনশীল উদ্যোক্তা হওয়ার শিক্ষা।

এছাড়াও, এগুলো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, যেমন, মানসিক চাপ হ্রাস, মেজাজের উন্নয়ন এবং মানবজীবনের লক্ষ্য অনুধাবন ও তা পূরণের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ইসিএ-এর মাধ্যমে তারা আরও বেশি পরস্বপরের সাথে একাত্বতা ও সংযুক্ততা অনুভব করে। মোটকথা, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিনির্মানে এদের ভূমিকা অপরিসীম। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নিজেদের অঞ্চলে বিভিন্নভাবে, পছন্দ এবং লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে অংশগ্রহণের জন্য ইসিএ-এর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। প্রথমে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখতে হবে কোনো ক্লাব, দল বা কর্মসূচি আছে কিনা যেখানে শিক্ষার্থীরা যোগদান করতে পারে। সহপাঠী বা শিক্ষকরা এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।

এরপর, স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা, অনলাইনে তাদের ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে- কোনো স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম, ওয়ার্কশপ, সেমিনার বা প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড আছে কিনা, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে পারে। এর বাহিরে, আজকাল শুধু অনলাইনেও বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে থাকে। সেখানে নানা ধরনের অনুষ্ঠান, অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা রয়েছে, যারা শিক্ষার্থীর দক্ষতা ও নেটওয়ার্ক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

এমন কিছু পাওয়া না গেলেও উপায় আছে। নিজেই উদ্যোগী হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এলাকায় ক্লাব বা দল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। অথবা, নিজে নিজে অনলাইন কোর্সে অংশগ্রহণ করে, ইউটিউবে সংশ্লিষ্ট ভিডিয়ো দেখে, বই পড়ে বা চর্চা করে অনলাইন/ অফলাইনে সেগুলোর প্রকাশ ঘটানো বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশেও অনলাইন ও অফলাইনে নানা কার্যক্রম রয়েছে। যেমন, বিতর্ক, গ্রাফিক ডিজাইন, গান করা, নাচ করা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, গবেষণা করা, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, ইন্টার্নশিপ, শিক্ষামূলক ও সামাজিক সচেতনতামূলক কন্টেন্ট তৈরি, ইত্যাদি।

এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কুইজ প্রতিযোগিতা ও অলিম্পিয়াড সর্বজনবিদিত। বাগান করা, আর্ট ফিল্ম তৈরি, ফ্রিল্যান্সিং, লেখালেখি করা, প্রোগ্রামিং শেখা ও অ্যাপস তৈরি করা, গেমিংয়ে দক্ষতার মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। কেউ কেউ গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। কেউ টেন মিনিট স্কুলে ভলন্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনেও অনেকে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়ের তরুণ, দয়াল চন্দ্র বর্মণ তো গ্রামীণ জনপদ ও কৃষির উপর ইংরেজিতে ভ্লগ তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে গেছে।

অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ না থাকলেও অনুসন্ধিৎসু মন ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারে ইসিএ খুঁজে পাওয়া ও তাতে ব্যস্ত হওয়া কোনো কঠিন বিষয় নয়। এক্ষেত্রে এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ বাংলাদেশ, ইয়ুথ অপরচুনিটিস বা এ জাতীয় সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ বা ওয়েবসাইটের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। তবে, শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের ইসিএ বেছে নিবে, এটা সম্পূর্ণই তাদের দক্ষতা ও পছন্দের উপর নির্ভর করবে। কোনো পছন্দ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।  

ইসিএ কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উপকারী হলেও যথাযথভাবে সম্পাদন করা না গেলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। অনেক বেশি ইসিএ শিক্ষার্থীদের চাপে ফেলতে পারে, করতে পারে শক্তি ক্ষয়; এমনকি অ্যাকাডেমিক অর্জনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসিএ-এর সংখ্যা সীমিত রাখা, এবং নিজের সময়সূচি ও পছন্দের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় শিক্ষক, কোচ, মাতা-পিতা ও সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগের ঘাটতি সংশয় ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে।

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উচিত সবাইকে তাদের বাধ্যবাধকতা, সময়সীমা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে অবগত করানো ও প্রয়োজনে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা, বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ, ও অগ্রাধিকার ঠিক করার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ, সময়সীমা অতিক্রম ও নিম্নমানের অর্জনকে এড়ানো যেতে পারে। অনেকে শিক্ষার্থী অন্যের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে যেয়ে নিজের পছন্দকে দূরে ঠেলে দেয়, এতে করে তাদের মধ্যে অবসাদ, হতাশা ও বিষণ্ণতা ভর করতে পারে। এক্ষেত্রে, ইসিএ ঠিক করার ক্ষেত্রে নিজের আগ্রহ, লক্ষ্য, কর্মজীবন পরিকল্পনা, মূল্যবোধ, অনুপ্রেরণা ও আত্মতুষ্টির প্রবণতা ও ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

সবসময় ইসিএ ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম, এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সময় ব্যবস্থাপনা ও নিজের যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষার গুরু কাজটি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের তাদের পছন্দ, লক্ষ্য ও সময়সূচির উপর ভিত্তি করে ইসিএ পছন্দ করতে হবে। সব ধরনের ইসিএ সবার পছন্দ নয়, আবার করাও সম্ভব নয়। যেগুলো পছন্দ নয়, সম্পাদন করা কঠিন ও কম উপভোগ্য সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, পড়াশোনা বা ইসিএ, যখন যেটা করা হোক, তাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করতে হবে। শুধু নামকাওয়াস্তে ইসিএ-এর জন্য ইসিএ নয়, ইসিএ ও পড়াশোনা, দুটোই যাতে সমানভাবে ভালো হয় সে চেষ্টা করতে হবে।

এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, একটার জন্য যেন অন্যটির ব্যাঘাত না ঘটে। অপ্রয়োজনীয় ও অসংলগ্ন কাজে সময় নষ্ট না করে, অলস সময়কেও কাজে লাগাতে হবে। নেতৃত্বের গুণাবলী যেমন, দায়িত্বশীলতা, উদ্যোগ, দলগত সহযোগিতা, ও নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নেতাকে অনুসরণের মাধ্যমে অন্যরা এক্ষেত্রে উপকৃত হতে পারে। পূর্ব-পরিকল্পনা, সময় বিভাজন, প্রতিশ্রুতি ও সময়সীমা স্মরণ রেখে পড়াশোনা ও ইসিএ সম্পাদন করতে হবে। এটাও খেয়াল রাখতে হবে, ইসিএ শুধু কিছু করার সাথে জড়িত নয় বরং চিন্তা করা, ধারণা গঠন, শিখন ও এগুলোকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার সাথে জড়িত।

অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও অর্জনের প্রতিফলনের পাশাপাশি,  দক্ষতা বৃদ্ধি, শৈল্পিক সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তিগত সৃজনশীলতার প্রকাশ ও সমাজে ভূমিকা রাখার উপর চিন্তা করার পেছনে সময় ব্যয় করতে হবে। তবে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিতে হবে। সুষম খাদ্য গ্রহণ, ব্যায়াম করা, শখ পূরণ ও প্রয়োজনীয় ঘুম ও বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, সময়সূচি পরিবর্তন ও খাপ খাওয়ানের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হওয়া যেতে পারে। মাঝে মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ঠাণ্ডা মাথায় প্রস্তুত থাকতে হবে। 

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসিএ-এর গুরুত্ব তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষকরে, গ্রামীণ জনপদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যেখানে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, সেখানে ইসিএ-এর চর্চা খুবই সীমিত। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু খেলাধুলা হয়তো অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সারা বছর ধরে চলার মতো আর কোনো কর্মসূচি সাধারণত থাকে না। গ্রামীণ জনপদগুলোতেও কাছাকাছি অবস্থা। বিদ্যমান সামাজিক পরিবেশে সেখানে ইসিএ চর্চার সুযোগ বেশ কম। আবার উদাহরণও যথেষ্ট নয়। ইসিএ-এর সীমিত চর্চার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীর প্রবণতা উপলব্ধি করা যায় না, অন্যদিকে শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে যায়।

আবার, ইসিএ-এর অভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার বাহিরের অলস সময়টুকু নষ্ট করছে। তারা অসৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৃথা সময় নষ্ট করছে। জড়িত হয়ে পড়ছে অসামাজিক কার্যকলাপে। ফলে, তাদের অ্যাকাডেমিক অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানবিকতা বোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। যথাযথ চরিত্র ঘটিত হচ্ছে না। ফলে, পড়াশোনা শেষে অনেকে উদ্যোগ ও উদ্যম হীনতায় ভোগে এবং বেকারত্বের অন্ধ-প্রকোষ্ঠে হাঁসফাঁস করে। আবার, অনেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়ছে। গ্রহণযোগ্য ও যথেষ্ট পরিমাণে ইসিএ দেখাতে পারছে না বলে, অনেকে ভর্তি কার্যক্রমের সাথে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছে না।

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু এককভাবে পড়াশোনায় ভালো, এমন শিক্ষার্থীদের নয়, বরং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানায়। এক্ষেত্রে, নানাবিধ প্রতিভার প্রমাণত হিসেবে শিক্ষার্থীদের স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পদক বা সনদপত্র থাকলে ভালো, না হলে রিকমেন্ডেশন লেটারে ইসিএ-এর উল্লেখ থাকা অপরিহার্য। তবে, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং শিক্ষক অযৌক্তিক কারণে রিকমেন্ডেশন লেটার প্রদান করতে অনীহা দেখান বা গড়িমসি করেন। এক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীদের ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের নমনীয় আচরণ আকাঙ্ক্ষিত। 

অতএব কারণে, নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারা বছর ধরে চলা ইসিএ কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবক ও স্থানীয় জনসমাজকেও এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করতে হবে; যাতে তারা ইসিএ-এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে এবং সকল শিক্ষার্থীর ইসিএ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়তা করে।

মনে রাখতে হবে, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের শুধু তত্ত্ব শেখানোয় ব্যস্ত না রেখে, ইসিএ-এর মাধ্যমে বাস্তব জীবনে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোর সুযোগ করে দিতে হবে। এতে তারা বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা অর্জন করে, ভবিষ্যতে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে উপযুক্ত জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারবে।  

লেখক: ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার, ইউজিসির পোস্টডক্টরাল ফেলো 


সর্বশেষ সংবাদ