রবীন্দ্রনাথ ও সৈয়দ মুজতবা আলী
- আলমগীর শাহরিয়ার
- প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৫২ AM , আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০২:২৭ PM
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়া প্রথম মুসলিম শিক্ষার্থী সিলেটের সৈয়দ মুজতবা আলী। একই বছরের পহেলা জুলাই দ্বারোদঘাটন হচ্ছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফসল, ভবিষ্যতে বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠবে যে প্রতিষ্ঠান সেই— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যদিকে, একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম নারী শিক্ষার্থী ছিলেন লীলা নাগ। তিনিও সিলেটের মেয়ে। সৈয়দ বংশের একজন ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না গিয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে। কারণ সেখানকার আশ্রমে ছিলেন তাঁর ‘গুরুদেব’।
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করার যে ‘হাওয়াই অভিযোগ’ উঠল তা সত্য হলে মুজতবা আলী বা তাঁর রক্ষণশীল শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের এ কথা অজানা থাকার কথা ছিল না। অজানা থাকার কথা না পেশায় সাব-রেজিস্ট্রার তাঁর পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলীরও। তখন মুসলমানদের একটা রাজনৈতিক জাগরণের কাল। মনে রাখা দরকার, কংগ্রেস থেকে শিক্ষিত মুসলমানেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। প্রবলভাবে ঝুঁকছেন মুসলিম লীগের দিকে।
যা হোক, ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণের সময় ‘আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামের বক্তব্য শুনে কিশোর মুজতবা আলী যার ডাক নাম ছিল সিতারা বা নক্ষত্র। সিতারা থেকে আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘সিতু’ হয়ে যায়। কিশোর সিতু বিমোহিত হলেন। জাদুকরেরা যেমন মন্ত্রমুগ্ধ করে অনেকটা তাই। কিশোর সিতু খুব মনোযোগ দিয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রাচ্যের জন্য গৌরব বয়ে আনা নোবেলজয়ী লেখকের বক্তৃতা শুনলেন। তারপর সাহস করে সপ্তাহখানেক পরে গোপনে এক চিঠি লিখলেন কবিকে। চিঠিতে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করতে হলে কী করা প্রয়োজন?’
সিলেট সফর শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আগরতলায়। আগরতলা থেকেই নীল রঙের খামে, নীল রঙের কাগজে কবির নিজ হাতে লেখা চিঠির উত্তর পেলেন মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, ‘আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে— এই কথাটার মোটামুটি অর্থ এই— স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়। দেশের মঙ্গলের জন্য ও জনসেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ কামনাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। তোমার পক্ষে কী করা উচিত তা এতদূর থেকে বলে দেয়া সম্ভব নয়। তবে তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে।’
খুব সঙ্গত কারণেই এ চিঠি তাঁকে তুমুল আলোড়িত করেছিল। তারপর সিদ্ধান্ত নেন শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন এবং গেলেন। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়তে না যেয়ে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন তাহলে সিলেট অঞ্চলের সেসময়ের ঐতিহ্যের ধারায় আমরা হয়ত একজন জাঁদরেল আমলা পেতাম, কালোত্তীর্ণ সুসাহিত্যিক একজন সৈয়দ মুজতবা আলী হারিয়ে যেতেন সে সময়ের আইসিএস বা আজকের মতো বিসিএসের পড়াশোনা ও রুটিন দায়িত্বের চাপে। রবীন্দ্রনাথের সহোদর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গুণী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নাম আজকাল আর শিক্ষিত লোকজনও জানেন না। কিন্তু মেট্রিক পাস দেন নি যে কবি সৃষ্টিশীলতার জন্য তাঁকে আজ গোটা বিশ্ববরণ করে নিয়েছে।
ভাগ্যিস আমাদের মুজতবা আলীও সেসময় শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। না হলে বাংলা ভাষায় এমন বিরল প্রতিভার এক সাহিত্যিক জন্ম নিতেন না। বলা হয় রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে ছাত্র হিসেবে যে দুজন রবীন্দ্র-উত্তর কালে নাম করেছিলেন তাদের একজন সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্যজন প্রমথনাথ বিশী। শান্তিনিকেতনে পড়ার গৌরব পেয়েছিলেন জীবনভর। একই সঙ্গে বৈষয়িক জীবনে হয়ত দুঃখও। দুঃখ কেন?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দুই বোন’ উপন্যাসে বলেছিলেন, ‘মুর্খেরা লাভ করে উন্নতি, জ্ঞানীরা লাভ করে গৌরব।’ গৌরব গৌণ হয়ে যে সমাজে উন্নতি মুখ্য হয়ে যায় সেখানে দুঃখ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেটা মুজতবা আলীর জীবনেও সত্য। রবীন্দ্রনাথকে যিনি ভালোবেসেছিলেন, সাহিত্য-সাধনাকে যিনি জীবনের ধ্রুবতারা করেছিলেন জীবনের দুঃখসমুদ্রে তাঁর কভু পথহারাবার কথা নয়। হারানও নি। বিষয় বাসনায় উন্নতি লাভ না করলেও ঠিকই গৌরব লাভ করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়া শেষে কাবুলে চাকরিসূত্রে গেলে তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়।
মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসেবে ছিলেন ১৯২১-১৯২৬ পর্যন্ত। পড়াশোনা শেষ আলীগড়ে পড়াশোনা করেছেন কিছুদিন। জনপ্রিয় ছিলেন বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখানকার ছাত্র ইউনিয়নে ভিপি। তারপর তিনি আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধে শিক্ষা বিভাগে এক চাকরি নিয়ে সেখানে যান। মাত্র ২৩ বছর বয়সে। কাবুল কৃষি কলেজে ফারসি এবং ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়েই লিখলেন তাঁর বিখ্যাত ‘দেশে বিদেশে’ নামক ভ্রমণকাহিনী। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সালের আফগানিস্তান ভ্রমণের উপর রচিত এটি। এই বইটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনি হিসেবেও গণ্য করা হয়। দেশে বিদেশের মতো অন্য কোনো ভ্রমণ কাহিনি আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এতোটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বইটি সাহিত্য মানোত্তীর্ণ সুখপাঠ্য একটি রচনাই শুধু নয়, একই সঙ্গে আফগানিস্তানের সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের একটি অনবদ্য দলিল।
লেখক কাবুল গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা নিতে জার্মানি যাওয়ার বছর দুয়েক আগে। মুজতবা আলীর নিজ বয়ানে, “ইউরোপে যাওয়ার জন্য অর্থসংস্থান করতে গিয়েছিলুম কাবুলে। ফারসি ও ফরাসী জানি বলে অনায়াসে চাকরি পেয়েছিলুম। তখনকার দিনে বিশ্বভারতীই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ফরাসী, ফারসি, জর্মন একসঙ্গে শেখা যেত।
দুশো টাকা মাইনেতে গিয়েছিলুম; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই কাবুল সরকার আবিষ্কার করলেন যে আমি জর্মনও জানি। মাইনে ধাঁ করে একশো টাকা বেড়ে গেল। পাঞ্জাবি ভায়ারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওজিরে মওয়ারিফের ( শিক্ষামন্ত্রী ) কাছে ডেপুটেশন নিয়ে ধরনা দিয়ে বললেন, সৈয়দ মুজতবা এক ‘অনরেকগনাইজড’ বিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাধারী। আমরা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ; এমএ। আমাদের মাইনে দেড়শো; তাঁর মাইনে তিনশো, এ অন্যায়।
শিক্ষামন্ত্রীর সেক্রেটারি ছিলেন আমার বন্ধু। তিনি আমার কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করেছিলেন ফারসিতে। — জানো, বন্ধু, শিক্ষামন্ত্রী তখন কী বললেন?
খানিকক্ষণ চুপ করে জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বললেন,
বিলকুল ঠিক! কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, তোমাদের ডিগ্রিতে দস্তখত রয়েছে পাঞ্জাবের লাটসাহেবের। তাঁকে আমরা চিনি না, দুনিয়াতে বিস্তর লাটবেলাট আছেন— আমাদের ক্ষুদ্র আফগানিস্তানেও গোটা পাঁচেক লাট আছেন। কিন্তু মুজতবা আলীর সনদে আছে রবীন্দ্রনাথের দস্তখত—সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি সমগ্র প্রাচ্যের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।’
রবীন্দ্রনাথের সুযোগ্য শিষ্য সৈয়দ মুজতবা আলীর জ্ঞান-গরিমার গৌরবও ছিল কিংবদন্তিতুল্য। তিনি জানতেন সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ পনেরোটির মতো ভাষা। বিশ্বভারতীর ডিগ্রির স্বীকৃতি ইউরোপের সব প্রতিষ্ঠানে না থাকায় দর্শনশাস্ত্র পড়তে গিয়েছিলেন জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য, দর্শন শাস্ত্র পড়ার জন্য তখন জার্মানিই শীর্ষে। কিন্তু বার্লিনের ভীড় বাট্টা নাগরিক হুজ্জত ভালো লাগেনি বলে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তাঁর পিএইচডিও তুলমামূলক ধর্মতত্ত্বে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “The Origin of Khozhas and Their Religious Life To-day”.
পিতা সিকান্দার আলী পুত্রের পিএচডি নিয়ে নাকি খুব গর্বিত ছিলেন। বড় ভাই সাহিত্যিক মুর্তাজা আলীর এক লেখায় জানা যায়, পিতা পুত্রের থিসিসের একটা কপি সবসময় সঙ্গে রাখতেন। গর্ব করারই কথা। সেসময় গ্রামেগঞ্জে কেউ মেট্রিক পাস করলে লোকজন দেখতে আসত। কিন্তু দুঃখের বিষয় পিতা পুত্রের সাহিত্যখ্যাতি দেখে যাবার আগেই গত হয়েছিলেন। লেখালেখি শুরু করেছিলেন কিছুটা পরিণত বয়সে। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও লেখালেখিই ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর পেশা বা আয় উপার্জনের মাধ্যম।
বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কায়রোর আল-আজহারে পড়ার সময়। মুজতবা আলীর জ্ঞানগরিমার পরিচয় পেয়ে পরবর্তী কালে মহারাজা বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানান। বছর আটেক সুনামের সঙ্গে দায়িত্বে ছিলেন সেখানে। এমন প্রাচ্যতত্ত্ববিদ এই কাঁটাতারে বিভক্ত ভূগোলে ও বিশেষজ্ঞ তৈরির যুগে আর কেউ হবেন না। যেমন আমরা আর পাব না রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বপ্রতিভা। সৈয়দ মুজতবা আলীর মধ্যেও সেই বীজ রোপন করেছিলেন তাঁর গুরু।
সৈয়দ মুজতবা আলীর স্মৃতিচারণে, “প্রথম সাক্ষাতে গুরুদেব জিজ্ঞাসা করলেন, কি পড়তে চাও? আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনো একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই। তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী? আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনো জিনিস বোধ হয় ভালো করে শেখা যায় না। গুরুদেব আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, একথা কে বলেছে? আমার বয়স তখন সতেরো– থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল। গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়।
কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম। গুরুদেবের সঙ্গে তখন সাক্ষাৎ হতো ইংরেজি ও বাংলা ক্লাসে। তিনি শেলি, কীটস আর বলাকা পড়াতেন।” ভাগ্যিস নান্দনিক বিষয় বৈচিত্রে তাঁর প্রবল ইচ্ছা উসকে দিয়েছিলেন কবিগুরু। না হলে বাংলা ভাষায় আমরা একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতাকে হয়ত পেতাম না।
রবীন্দ্র-গবেষক আবদুশ শাকুর সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য রচনার দিকে বিশেষ করে ইঙ্গিত করে তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ‘হাস্যরসের যেন অফুরান এক ডেটা-ব্যাংক মুজতবা—যেখানে পাঠক রসটির সব রকমের ভ্যারাইটির মজুদ পায়। তাঁর কাছে আছে পরশুরামের প্রসন্ন হাস্যরস, বঙ্কিমচন্দ্রের বিষণ্ণ হাস্যরস, ত্রৈলোক্যনাথের হৃদয়বৃত্তি, প্রমথ চৌধুরীর বুদ্ধিবৃত্তি— আর চাই কি।… সে সূত্রে মুজতবা আলী একজন মহৎ শিল্পী। তাঁর অন্তরঙ্গরচনার শৈলী নজিরবিহীন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক