দুঃস্বপ্ন
- শারমিন আক্তার সাথী
- প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৪৩ PM , আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৪৩ PM
পর্ব ১
নিজের চোখকে বিশ্বাস করছে পারছে না রিদিকা। এত দিন যাকে এতটা ভালোবেসেছে এতটা বিশ্বাস করেছে তাকে এমন অবস্থায় দেখবে ভাবতেও পারেনি কখনো। যার বুকে শুয়ে এঁকেছে শত শত স্বপ্ন তার নগ্ন বুকে আজ অন্য একটি নগ্ন মেয়ে পরম আবেশে ঘুমিয়ে রয়েছে।
রিদির সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ কলিজাটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল, ওর গায়ে লেগে পাশের টেবিলে থাকা ফুলদানীটা মেঝেতে পরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ঠিক যেমন রিদির মনটা ভেঙেছে।
কাঁচ ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো বর্ণের। রিদিকে দেখে বর্ণ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। সাথে আরো বেশি স্তব্ধ হলো নিজের বুকে ইরিকে দেখে। নিজের বুক থেকে ইরিকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে রিদির কাছে গিয়ে বলল, রিদি তুমি যা ভাবছো তা সব ভুল।
রিদি কথা বলার মত কোন শক্তি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ গলাকে ভিতর থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছে। রিদির অ্যাজমার সমস্যা আছে খুব বেশি উত্তেজিত হলে ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সেটা বর্ণ বুঝতে পেরে ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা রিদির ইনহেলারটা এনে রিদিকে দেয়। দু বার স্প্রে নেবার কিছুক্ষন পর রিদি একটু শান্ত হয়।
বর্ণ আর রিদির কথা বলার টাইমে ইরি নিজের ঠিক করে নেয়। রিদি কিছুটা শান্ত হলো কিন্তু কিছু বলার মত মানুষিক ভারসাম্য কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে ফেললো।
বর্ণ রিদির বুকে পিঠে হালকা মালিশ দিয়ে দিচ্ছে। রিদি বারবার বর্ণের হাত নিজের শরীর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বর্ণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রিদির হাতদুটো নিজের ডান হতে চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে রিদির বুকে পিঠে হালকা করে মালিশ করে দিচ্ছে। কিছুক্ষন পর রিদি কিছুটা ঠিক হলো। কিন্তু কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষন বর্ণের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর শান্ত আর র্নিলিপ্ত গলায় বলল,
কেনো এমন করলে বর্ণ? বর্ণ মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। তাই রিদি আবার বলল, আমার ভালোবাসায় কী কোন খাঁদ ছিলো! নাকি আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি!
বর্ণ এবারও চুপ দেখে রিদির রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। রিদি চাইছিলো বর্ণ নিজের মুখে সত্যিটা বলুক। কিন্তু মৌনতা যে সম্মতির লক্ষন সেটা দেখে রিদি আর সহ্য করতে পারলো না চিৎকার করে বলল, এমন কেন করলে? ঐ প্রস্টিটিউডটার মধ্যে এমন কী দেখলে যে, তুমি ওর সাথে ফিজিক্যাললি ইনভলব হলে। ভুলে গেলে যে তোমার স্ত্রী আছে সংসার আছে।
রিদির কথা শুনে রেগে মেগে ইরা বলল, আমি প্রস্টিটিউড হলে তোমার স্বামী কি? নিজের স্বামীকে সামলাতে পারে না আবার আমাকে প্রস্টিটিউড বলছে। নিজের স্বামীকে আর্কষন করার ক্ষমতা তোমার নাই আবার আমাকে বলছো। ইরির কথা শুনে রিদি স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু বলার মত কোন কথা পাচ্ছে না। কী বলবে রিদি! ঠিকই বলছে ইরি। ও নিজেই নিজের স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারেনি, সে অন্য মেয়েকে দোষ কী করে দিবে! বর্ণ ইরিকে উদ্দেশ্য করে বলল,ইরি তুমি এখান থেকে চলে যাও।
ইরি তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল, বাহ্! নিজের বৌকে পেয়ে এখন আমাকে চলে যেতে বলছো! আমি কেন যাবো?
ওকে তোমার জীবন থেকে চলে যেতে বলো। ওর মত আন্টি টাইপ মেয়েকে নিয়ে তোমার সারা জীবন ঘর করার কোন দরকার নাই।
বর্ণেন রিদির কাছ থেকে উঠে প্রচন্ড জোড়ে ইরিকে একটা চড় মেরে বলে কাল রাতে তোমার সাথে কী হয়েছে তার কিছুই আমার মনে নাই। আমার তো মনে হয় তুমিই কোন প্ল্যান করেছো। বাহ্ নিজের স্ত্রীকে দেখে কী নিপূন নাটক করছো তুমি বর্ণ! তোমাকে তো অস্কার দেয়া উচিৎ। জাস্ট সেটাপ এন্ড গেট লস্ট।ইরি রাগ করে চলে গেলো।
বর্ণ রিদির কাছে গিয়ে বলল, বিশ্বাস করো রিদি কাল রাতে ইরির সাথে কি হয়েছে আমার কিছু মনে নাই। তুমি যা দেখেছো তা সত্যি কিন্তু বুঝেছো ভুল। কি ভুল বুঝেছি বর্ণ? তোমার নগ্ন বুকে নগ্ন একটা মেয়ে শুয়ে আছে সেটা নাকি তুমি আমার এত দিনের বিশ্বাসকে নগ্ন করে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছো সেটা? বিশ্বাস করো রিদি, ইরি কিভাবে আমার বুকে এলো তা আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারছি ! কী?
কাল রাতে প্রচুর ঠান্ডা পড়েছিলো আর সে ঠান্ডায় ইরি হাইপোথ্রেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলো তাই তুমি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর শরীরে তাপ দিচ্ছিলে তাই তো। (দাঁতে দাঁত চেপে কঠিন গলায় তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে কথাগুলো বলল রিদি।) বর্ণ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, আমি জানি আমি এখন যাই বলবো তুমি অবিশ্বাস করবে তার থেকে বলো তুমি আমায় কি শাস্তি দিতে চাও। আমি মাথা পেতে নিবো। যা শাস্তি দিবো মাথা পেতে নিবা? হ্যাঁ। তাহলে আমাকে মুক্তি দাও। আমি তোমার মত কোন বিশ্বাস ঘাতকের সাথে থাকতে চাইনা। প্লিজ রিদি এভাবে বলো না। আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না। আমাকে ধোঁকা দেবার আগে সেটা মনে ছিলো না! রিদি হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না। মানছি আমি ভুল করছি।
কাল রাতে তুমি বাড়ি ছিলে না তাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় ড্রিংক করেছিলাম। যতদূর মনে পরে ইরি আমায় বাড়ি নিয়ে আসে হয়তো নেশার ঘোরে কোন ভুল করে ফেলছি। তার জন্য তুমি আমায় যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো। কিন্তু এভাবে আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলো না প্লিজ।
রিদি কোন কথা না বলে চুপচাপ ওখান থেকে উঠে নিজের ব্যাগ গোঁছাতে লাগলো। বর্ণ বার বার বাঁধা দিচ্ছে কিন্তু রিদি বর্ণের কোন কথাই কানে তুলছে না। ব্যাগ গুছিয়ে সোজা চলে গেলো। আর বর্ণ নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে স্তব্ধ হয়ে বসে কান্না করছে।
পর্ব ২
তিন মাস পর... আজ ওদের ডিভোর্স। বর্ণ শত চেষ্টা করেও রিদির রাগ ভাঙাতে পারেনি। রিদি বলছে , ভাঙা আয়না কখনো জোড়া লাগে না বর্ণ। তুমি আমার হৃদয় আয়নাকে এমন ভাবে ভেঙেছ যা আর জোড়া লাগবে না। বর্ণ রিদির কথার উপর আর কোন কথা বলেনি। উদ্ভ্রান্তের মত ডিভোর্স পেপারে সাইন করে রিদির ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
আজ রিদির দ্বিতীয় বিয়ে
হ্যাঁ রিদির আবার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে হবার ঠিক আগে বিয়ের আসরে কোথা থেকে যেনো বর্ণ আসল। বর্ণকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা হতাসাগ্রস্ত, নিঃশ্ব আর পরাজিত মানুষ সে আজ। বর্ণ রিদির দিকে মায়াবি চোখে তাকিয়ে দু ফোটা অশ্রু ফেলে হাতে থাকা ধারালো ছুড়িটা দিয়ে নিজের গলায় নিজে টান দিলো। সব কিছু কয়েক মুহূর্তের জন্য যেনো নিঃস্তব্ধ হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পরলো বর্ণ।
রিদি চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে ধরপরিয়ে উঠে গেলো। রিদির সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। রিদি তারাতারি রুমের লাইট অন করল। টেবিলে থাকা পানির বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে এক নিশ্বাসে পুরো বোতলটা খালি করে ফেলল।
রিদি মোবাইলটা নিয়ে সময়ের দিকে তাকিয়ে দেখে রাত রাত ৩:৩৭ মিনিট । তারিখ ৬ । রিদি ভাবছে, আমার আর বর্ণের বিয়ে তো ছয় তারিখ মানে আজ দুপুরের দিকে। এখন রাত আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর ওদের বিয়ে। তাহলে বর্ণ আর ইরির অবৈধ সম্পর্ক, আমাদের ডিভোর্স আর আমার আবার বিয়ে এসব কখন হলো? তারমানে আমি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম। রিদি বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু মাথাটা প্রচন্ড ঘুরাচ্ছে। তাই বাথরুমে গিয়ে নিজের চোখে মুখে বেশ করে পানির ঝাপটা দিয়ে, মাথায় বেশ খানিক সময় পানি ঢালল। পুরো শরীর মনে হয় যেনো কাঁপছে। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে বর্ণকে ভিডিও কল দিলো। বর্ণ ঘুম ঘুম কন্ঠে ফোনটা রিসিভ করে বলল, রিদি এত রাতে ভিডিও কল দিলা কেন? তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছে তাই দিছি। রুমের লাইট জ্বালাও। বর্ণ লাইট অন করে ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলল,কী হয়েছে বলো?এমনি তোমায় দেখতে ইচ্ছা হলো তাই। রিদি তোমার মাথা ঠিক আছে তো। রাত প্রায় চারটা বাজে। বিয়ের ঝামেলায় সব কাজ করে ঘুমাতে এসেছি দুটোর পর। তুমিতো ঠিকই এগারোটায় ঘুমিয়েছিলে। তো! আমার মাথা ব্যথা করছিলো তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিলাম। আর তাছাড়া কালকে আমাদের বিয়ে আমি বৌ সাজবো ঠিকমত না ঘুমালে আমাকে কাল বধূ বেশে ফ্রেস লাগবে না।
তুমি তো ভারী মতলবি মেয়ে! কেনো? কাল নিজেকে বৌ হিসাবে ফ্রেস দেখতে চাও আমি বুঝি বর হিসাবে ফ্রেস লাগতে পারবো না। হাসি দিয়ে আচ্ছা ঘুমাও। শুভ রাত্রি। শুভ রাত্রি। আই লাভ ইউ। বর্ণের ঘুম ঘুম কন্ঠে আই লাভ ইউ শুনলে রিদি হৃদয়ে প্রতিবার শিহরন জাগলো। ফোন না কেটেই বর্ণ ঘুমিয়ে পড়লো। রিদি বুঝতে পারল ওদের বিয়ের আয়োজনে সারাদিন ওকে অনেক কাজ করতে হয়েছে তাই শরীর খুব ক্লান্ত হয়ে আছে।
রিদি ফোনটা কেটে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা বাজে তারমানে কিছুক্ষন পরই ফজরের আযান দিবে। রিদির মনটা খুব অস্থির লাগছে। ভোর হবার আগে এমন অশুভ স্বপ্ন দেখে মনটা কু ডাক ডাকছে। তাছাড়া রিদির কাজিন ইরিকে রিদি একদম পছন্দ করে না। মেয়েটা অনেকটা বেহায়া টাইপ। ছেলেদের দেখলে গা গলিয়ে কথা বলে মজা পায়। বর্ণের সাথেও বেশ রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে। এটা রিদির মোটেও পছন্দ না।
রিদি মনে মনে ভাবছে, সকালে দেখা এই হিজিবিজি অগোছালো অদ্ভুদ স্বপ্ন আবার সত্যি হবে নাতো? ওর বর্ণ সারা জীবন ওর কাছে থাকবে তো? নাকি এই দুঃস্বপ্নের মত দুর্বিষহ হবে রিদি আর বর্ণের জীবন
পরের পার্ট শিঘ্রই আসছে।
বি: দ্র: গল্পের কাহিনী, চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে আন্তরিক ভাবে দুঃখীত।