অ্যা ট্রিবিউট টু মাসুদ রানা!

আমাদের পাবলিক লাইব্রেরিতে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ পাঠক। দুপুরের ঘুম বাদ দিয়ে ঠিক চারটার সময় নিয়মিত হাজিরা দিয়েছি সেই ক্লাস থ্রি থেকে। এমনও হয়েছে আমি বসে আছি কিন্তু লাইব্রেরিয়ান আসেন নি। এমন মেজাজ খারাপ হতো! আমার এখনও মনে আছে, লাইব্রেরিতে পড়া আমার প্রথম বই "নীল মানব"! লেখকের নামটা অবশ্য মনে নেই। বইটার প্রতি পৃষ্ঠায় সে যে কি থ্রিল, কি উত্তেজনা! বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত খোলা থাকতো লাইব্রেরি! কোন জায়গা থেকে যে সেই দুই ঘণ্টা সময় চলে যেত টেরই পেতাম না।

ধীরে ধীরে শেষ করেছি মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গী সাথি পশুপাখি, হাত কাটা রবিন, টুকুনজিল, আলী ইমামের পিকু সিরিজসহ আরও বই, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, উপেন্দ্রকিশোর রচনাবলী, বন্দে আলী মিয়া রচনাবলী, সুকুমার রায় সমগ্র আরও কত কিছু! ওই বয়সীদের পড়ার উপযোগী নয়, তাও পড়েছি জন্মনিয়ন্ত্রনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সচিত্র কামসূত্র, সুনীলের রাধা-কৃষ্ণ! মুক্তাদির নামক এক লেখকের একটা বই পড়েছিলাম, "বিবর্ণ বিবেক!" উফফ! কি লেখনী! সেই কাঁচা বয়সে এতো পাকা পাকা বই পড়ে স্কুলে গিয়ে বিশদ আলোচনা করতাম।

বন্ধুমহলে আগে থেকেই নিষিদ্ধ বিষয় বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ছিলাম, এবার কনসালটেন্সিও শুরু করলাম। আমাকে সবচেয়ে বেশি টানত এনসাইক্লোপিডিয়া। না না, অতো বড় মাপের আঁতেল তখনও ছিলাম না, এখনও হয়ে পারি নি যে এনসাইক্লোপিডিয়া মুখস্ত করে ফেলব। এনসাইক্লোপিডিয়া আমি পড়তাম না, পাতায় পাতায় যে ডাইনোসর, পাখি, বিচিত্র স্থানের ছবি দেয়া থাকতো, তাই দেখতাম দুচোখ ভরে। ইচ্ছে হতো, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ঘুরে আসি সেই সব জায়গা, দেখি বিচিত্র মানুষজন আর পৃথিবীকে। ক্লাস ফোরে উঠেছি সবে। আমি তখনও জানি না, "মাসুদ রানা" নামের এক অলৌকিক চরিত্র আমার জন্মের বহু বহু বহু আগে থেকেই এদেশে আছে, আমি এও জানি না সেবা প্রকাশনী নামের একটা স্বপ্নরাজ্য তার তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, হরর, ক্লাসিকসহ আরও নানান রহস্য নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

এলাকার সরকারি কোয়ার্টারে জেমস ভাই নামের এক ভাই থাকতেন। বয়সে তখনকার আমাদের চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের বড়ই হবেন বোধহয়! প্রচণ্ড আওয়াজ সৃষ্টিকারী একটা বাইক নিয়ে বাকের ভাইয়ের মতো তিনি ঘুরে বেড়াতেন আমাদের নিঝুম মফস্বলে। শুনতাম, মা-বাবা নেই তার, ভাই-ভাবির কাছে মানুষ হচ্ছেন। মেয়েরা তার জন্য বেজায় পাগল হলেও তিনি তাদের সম্পর্কে চরম উদাস। সে যাই হোক, সরকারি চাকুরে তার ভাই, কোন একদিন ট্র্যান্সফার হয়ে চলে গেলেন পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও। যাবার আগে, জেমস ভাই তার জমানো প্রায় ৭০-৮০টি মাসুদ রানা'র বই দিয়ে গেলেন পাবলিক লাইব্রেরিতে।

একদিন, বিকেলবেলা লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, ছোট ছোট বই ভর্তি একটা তাক। অমন বই এর আগে দেখি নি কোথাও। নিউজপ্রিন্টের ছাপা, দারুণ আকর্ষণীয় কাভার, পিছনে আবার এতো সুন্দর করে কাহিনী সংক্ষেপ লেখা যে, পড়তেই হবে বইটা এমন মনে হচ্ছে! আমি কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, কিন্তু মোটা বই দেখে পড়তে ইচ্ছে হল না। ইচ্ছে না হবার আরও একটা কারণ হল, বেশিরভাগ বই প্রথম খণ্ড আছে তো দ্বিতীয় খণ্ড নেই। আবার দ্বিতীয় খণ্ড আছে তো প্রথম খণ্ড হাওয়া। আর বাসায় আউট বই পড়ার উপরে ১৪৪ ধারা ছিল। তাই আর সাহস করিনি। আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড় রাকিব ভাইর সাথে পরিচয় হল এমন সময়।

তার ছিল গল্পের বইয়ের বেশ ভালো স্টক! তার কাছ থেকে নিয়ে পড়লাম জীবনের প্রথম তিন গোয়েন্দা'র বই, "ওকিমুরো কর্পোরেশন"! এরপর আর ঠেকানো গেলো না আমাকে। একে একে শেষ করেছি তিন গোয়েন্দার সকল বই। আব্বু-আম্মু মারত আর বলতো, “ভলিউম, তাই না? আজ বের করছি তোর ভলিউম পড়া!” ঘড়ির গোলমাল, ছিনতাই, ভীষণ অরন্য, অথৈ সাগর, দক্ষিণের দ্বীপ, কালো হাত, মূর্তির হুঙ্কার, জিনার সেই দ্বীপ, আরেক ফ্রাংকেনস্টাইন, হারানো জাহাজ, শ্বাপদের চোখ, তেপান্তর, সিংহের গর্জনসহ প্রতিটা বই আমার কমপক্ষে তিনবার করে পড়া!

কিন্তু যেটা ঝামেলা হল, একটু বয়স হবার সাথে সাথে এই পানসে বাচ্চাদের আর ভালো লাগলো না। ক্লাস ফোরে যে ছেলে রাধাকৃষ্ণ এবং কামসূত্র পড়ে ফেলেছে, তাকে আর কতদিন তিন গোয়েন্দায় আটকে রাখা যায়! সুতরাং ব্যাক টু দ্যা মাসুদ রানা অ্যাগেইন! প্রথম যে বইটি পড়লাম, তা হল পিশাচ দ্বীপ! ওই রাতে ভয়ে, উত্তেজনায় আর রোমাঞ্চে একফোঁটাও ঘুমাতে পারি নি।

জীবনের প্রথম রাত জাগা, শৈশব থেকে কৈশোরে ওঠার প্রথম ধাপ ছিল সেটি! আমার মনের ভিতরে কি যেন একটা নড়েচড়ে গেলো। এবার আর বাছাবাছি নেই, প্রথম-দ্বিতীয় হাতের কাছে যে খন্ডই পাই, পড়ি- কিন্তু কেন জানি মন ভরে না। জানতাম, ডাকে বই চেয়ে পাঠালে আসবে- কিন্তু সমস্যা দুটো। এক, আম্মু পিঠের ছাল তুলে রোদে শুকাতে দেবে আর দুই, টাকা পাবো কোথায়? শুরু হল স্বেচ্ছায় বাজারে যাওয়া আসা, বাপের পকেট, মায়ের ব্যাগ থেকে আগের চেয়েও বেশি টাকা চুরি। পেপসি আইসক্রিম, ঝালমুড়ি কিংবা, চানাচুর-মাখার মায়া ছেড়ে যা কিছু টাকা পাওয়া যায়, সঞ্চয় করা! আমার খুব কাছের বন্ধু মিরাজের বাসা ছিল বেশ ওপেন।

সুতরাং, ঠিকানা দিলাম ওর বাসার, এবং একই সাথে ভয়ে ভয়ে জীবনে প্রথমবার পোস্ট অফিসে গিয়ে মানি অর্ডার করলাম ১০০ টাকা। সেই একসপ্তাহ আমার যে কিভাবে কেটেছে... ভুল লিখলাম, এরপর যতবার যত বই যতদিন দেরি করে এসেছে, আমি যে কিভাবে ওই দিনগুলো পার করেছি! মাসুদ রানা সিরিজের সবচেয়ে ভালো বইগুলো পড়েছি এসএসসি আর এইচএসসির চার বছরে। হুহু করে কেঁদেছি আই লাভ ইউ, ম্যান, মুক্ত বিহঙ্গ, শ্বাপদ সংকুল, নরপিশাচ, অগ্নিপুরুষ পড়ে।

এমন লেখাও কেউ লিখতে পারে! আজীবনের স্বপ্ন ছিল, ২৪/৪ সেগুনবাগিচায় যাওয়া! ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম, স্বর্ণমৃগ, কালকূট, বিষচক্র, শান্তিদূত, শ্বেতসন্ত্রাস, আবার উ সেন, জাপানি ফ্যানাটিক, কর্কটের বিষ, সার্বিয়া চক্রান্ত, শেষ চাল, হিরক সম্রাট, কালপুরুষ, হারানো আটলান্টিস... চারশোর উপরে বই এবং প্রায় সবই আমার পড়া এবং সংগ্রহে! আমার ল্যাপটপে, ফোনে কিংবা রুমে- সবজায়গায় এখনও মাসুদ রানা রাজত্ব করে! আমার শৈশবে-কৈশোরে-তারুণ্যে সেবা প্রকাশনী কাজ করেছে পথপ্রদর্শক হিসেবে।

তবে সে সময়ে আমি যে শুধু সেবা’র বইই পড়েছি, তা কিন্তু নয়। দেদারসে শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, রবি ঠাকুর, জসীমউদ্‌দীন, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, আলি ইমাম, কিশোর ক্লাসিক সবই পড়েছি! এখনও পড়ি, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সুনীল, তসলিমা, হুমায়ূন আযাদ, আরজ আলি মাতুব্বরসহ অনেককেই! তবে মাসুদ রানা আমাকে যেভাবে চারদিক চিনিয়েছে, ভাবিয়েছে, দেখিয়েছে- অন্য বই পড়ার ক্ষেত্রে সেই বেইজটাই কাজে লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ, কিন্তু মাসুদ রানা’র আবেদন শেষ হয়নি, হবেও না। খুব কষ্ট লাগে যখন বাসায় গিয়ে দেখি, আমার প্রিয় সেই পাবলিক লাইব্রেরী খোলা হয়না, কাড়াকাড়ি করে বই পড়া হয়না, ভাগাভাগি করে কেনা হয়না টারজান সিরিজের বই।

তবে মাসুদ রানা যখন পড়ি, প্রতিবারই আমার টিনেজ বয়স ফিরে আসে, শৈশব থেকে কৈশোরে কিংবা, কৈশোর থেকে তারুণ্যে উত্তরণের সেই শিহরণ আবার ফেরত পাই! যতবারই পড়ি, “বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দু:সাহসী স্পাই- গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর এক অন্তর। পদে পদে তার বিপদ-শিহরন-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি।”...ততবারই নতুন মনে হয়! কাজী আনোয়ার হোসেন, দ্যা গ্রেট কাজি’দা- এখনও তাঁকে সমান ভালোবাসি! কিছু বই রেখে দিয়েছি, সব শেষ করে ফেললে পরে পড়ব কি?

আজ বায়ান্ন পেরিয়ে তিপ্পান্ন বছরে পা রেখে ফেলেছে মাসুদ রানা সিরিজ! তিন অথবা চার প্রজন্মের মেলবন্ধন এই সেগুনবাগান প্রকাশনী! একটি প্রতিষ্ঠান, একজন লেখক, একটি সিরিজ, একজন নায়ক, এক মলাটে পুরো বিশ্ব, একটি একটি কিশোরকে তারুণ্য ছোঁয়ার হাতছানি- যে বা যারা করতে পেরেছে গত পঞ্চাশ- একান্ন- বায়ান্ন বছর ধরে, তাদের সে ক্ষমতাও তুচ্ছ করার মতো নয়!
— বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও, বাবা?
— মাসুদ রানা হতে চাই!
কাজি’দা কিংবা, সেবা প্রকাশনী অথবা, মাসুদ রানার আর কি কিছু পাওয়ার দরকার আছে?

 

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশান


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence