গল্প: জন্মদিন

সন্তোষ রায় অজয়
সন্তোষ রায় অজয়

কলেজ শেষ করে কাঁচাবাজারে গেছিলাম। বাসায় এসে দরজায় নক করতেই মেয়ে এসে দরজা খুলল। ফ্রেশ হয়ে বসে ফোনটা চাপতেছিলাম। মেয়ে এসে সামনে হাজির...
-মিতু আন্টিকে কার্ড দেয়া হয়েছে?
-হয়েছে।
-নিপা আন্টিকে?
-পাঠানো হয়েছে।
-বাদল আংকেলকে?
-সবাইকে নিমন্ত্রণ দেয়া হয়েছে মা।
-হিরামণির দাদুকে?
-ইস্! ভুলে গেছিলাম যে। উনাকে তো বলাই হয় নি।
-আজকেই বলবে তুমি।

ঠিক এভাবেই আমাকে কাটগড়ার আসামীর মতো জেরা করছিল মনিকা। ওহ হ্যাঁ, মনিকা আমার একমাত্র মেয়ে। এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পাঁচ পেয়েছে। আগামী রবিবার তার জন্মদিন। মেয়ে এবার বায়না ধরেছে তার জন্মদিনটা যেন আড়ম্বরপূর্ণ হয়। তার জন্যই নিমন্ত্রণের এত তোড়জোড়। আমিও না করতে পারি নি। একমাত্র মেয়ে, মা হারা মেয়ে কিভাবে তাকে উপেক্ষা করি?

মেয়ের আমার বয়স কম, কতই বা হবে ১১ কি ১২ বছর হবে। কিন্তু তার মানসিক বয়স দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। সেজন্যই মাঝে মাঝে তাকে বুড়ি মা ডাকতে বাধ্য হই। আমি আমার লেখার রাজ্যেই বসে ছিলাম।
-বাবা, খাবার রেডি। আসো খাবে...
-আসতেছি মা।

একটা লেখা পড়ছিলাম। উত্তর দিয়েই আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ আর থাকতে পারলাম না। মেয়ের ডাকে আবার ছেদ পড়ল। এবার বাধ্য হয়েই খাবারের টেবিলে আসতে হলো। মেয়ে মুখে হাসি, তার কারণটা আগেই বলেছি। মেয়ের হাসিমুখ দেখলে মনে তৃপ্তি পাই। কাজ করার একটা আমেজ খুঁজে পাই। মা হারা মেয়ে, জন্মের পর থেকে মাকে দেখে নি, তাই মেয়ের কোন দিকেই কমতি রাখি নি। যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন সেই তো আমার মেয়ে। গল্পটা অনেক পুরনো....

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম। তখনই পরিচয় হয় জয়ন্তীর সাথে। তারপর থেকেই তাকে ভালবেসে ফেলি। শুরুটা সেখান থেকেই, শুভ পরিণয় তারপর থেকেই। তার সাথে অবশ্য পরিচয়টা এক বান্ধবীর মাধ্যমে। সে ছিল মা বাবা হারা মেয়ে। বড় হয়েছে মামার কাছে। ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে, ১১ বছর বয়সে মা-কে। সে জন্য তার প্রতি কেমন জানি একটা মায়া কাজ করে। রাগ করলেও বেশিক্ষণ সেটাকে ধরে রাখতে পারিনি। সবারই বুঝেছিলাম অচেনা মানুষের প্রতি কীভাবে টানের সৃষ্টি হয়। মানুষ বলে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া নাকি কেউ আপন হয় না। কথাটা আমার কাছে সত্য মনে হয় না। কারণ আমার জয়ন্তী। সে আমার আপনের চেয়ে আপন হয়ে গিয়েছিল। এ সময় তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারতাম না। এখনো পারিনা কিন্তু কিছু করার নাই। যখন তার কথা মনে পড়ে, নিজের অব্যক্ত কথাগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখি। এতেই একটা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করি। তার বাবা মারা গিয়েছিল ব্লাড ক্যান্সারে, মা আত্মহত্যা। বাবা বিয়ে করেছিল তার দাদুর অমতে তাই বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল বিয়ের পরপরই। কিন্তু বরাত মন্দ, বাড়ি ছাড়ার কিছু কাল পরেই যে এই দুনিয়া ছাড়তে হবে সেটা কি তার জানা ছিল? চাকরি করতেন বেতন নেহায়েত কম পেতেন না; তাই বাড়ি ছেড়ে আসলেও সংসার চালাতে অসুবিধে হয়নি। মা বাবার একমাত্র মেয়ে ছিল জয়ন্তী। সে ছিল অনেকটা রাগী আর জেদি কিন্তু তাকে কখনো বকাঝকা করিনি। কোন কিছু বলার আগেই মনে হতো সে মাতৃহীনা মেয়ে। তাই তাকে ভালবাসতাম অনেক বেশি। জয়ন্তী ছিল আমার বছর তিনেক ছোট। ফাইনাল ইয়ার পাশ করলাম ভালোভাবেই কিন্তু মাস্টার্সে এসে এক অসুবিধায় পড়তে হলো। তার পড়ালেখার খরচ চালাতেন তার মামারা, মামারা বলতে তার তিন মামা। কিন্তু তাদেরও তো সংসার আছে। তাই সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিল যে জয়ন্তীকে বিয়ে দিয়ে দিবে। এমন কি গোপনে পাত্র দেখাও শুরু করেছিল। জয়ন্তী তা জানত না অবশ্য। একদিন তাকে বাড়িতে ডেকে নেয়া হলো। পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসছে। একথা শোনা মাত্র অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। যাকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারতাম না তার সম্পর্কে এমন কিছু শোনা সত্যিই হৃদয়বিদারক। এক সময় বিয়ের কথা মোটামুটি পাকা।আমাদের কথা তার মামারা জানে। কিন্তু মেনে নেন নি। কারণ টা ছিল তাদের মতো আমার পরিবারের অবস্থা ভাল ছিল না।

- মামা বিয়ে ঠিক করেছে। আমি এ বিয়ে মানতে পারবো না৷
- আমি কি মানতে পারবো?
- জানি না। আমি কিছু জানি না। কিছু একটা করো।
- তুমি তো জানো আমার পরিবারের অবস্থা। একটু কষ্ট করতে হবে তোমায়।পারবে?
- এই চিনলে আমায়?
- তোমায় জানি,তোমায় বুঝি পাগলি।
- তাহলে এমন বলছো কেন?

উত্তরটা আমার জানা ছিল না। সেদিনই তার কথা বাড়িতে বলেছিলাম আমি, আমি আমার মা বাবাকে চিনতাম। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল। তারা জানতেন এমন কোন কাজ করবো না যেন তাদের সন্মানের সামান্যতম ঘাটতি হয়। পরিবারের মতেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তাই অনেক ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিলাম। তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। জানি সেও পারবে না। তাকে তার পরিবারকে বিসর্জন দিতেই হলো। জানি অনেক কষ্ট হবে কিন্তু কিছু করার ছিল না। আমি সব মেনে নিয়েছি নিজের সুখের জন্য আমি এই সামান্য একটু কষ্ট করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। টিউশন করিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। জয়ন্তীও নিজেকে গুছিয়ে নিছে। আমার পরিবার আমায় কোন কাজে বাধা দেননি। বাবা সবসময় আমায় বলতেন বড় হয়েছিস, বুঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে, যা করবি ভেবে চিনতে করবি। যখনই বাবার এ কথা মনে পড়ে তখন আর কোন খারাপ বা উল্টোপালটা কিছু করতে পারিনি বিবেকের তাড়নায়।

এভাবে মাস্টার্স শেষ করলাম, এখন তো অগ্নি পরীক্ষা। নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটা চাকরির আবশ্যক ছিল। জয়ন্তীর অনার্স শেষের দিকে। ভাগবান মুখ ফিরিয়ে নেননি। প্রথমে এস আই কিছুদিন পর সাধারণ শিক্ষা মানে সরকারি কলেজের শিক্ষকতা দুটো চাকরিই হয়ে গেল। আমি ছোটবেলা থেকেই দ্বিতীয়টিকেই পছন্দ করলাম তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে একটুকুও দ্বিধা করিনি। সেদিন যে জয়ন্তী খুশি হয়েছিল বুঝাতে পারবো না। এতদিনের দুঃখের অবসান হতে যাচ্ছে। কিন্তু সুখ তো গরীবের কপালে সয় না। পোস্টিং হলো রংপুরে। নিজ এলাকাই বলা যায়।

-হ্যাপি বার্থডে মামনি।
-থ্যাংকু আন্টি।
-তোমার নিপা আন্টি আসছে?
-না আন্টি, আসেনি এখনো। চলে আসবে হয়তো।

হাতে গোনা কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। মনিকার বন্ধু-বান্ধবীসহ তার মা বাবা আর আমার কয়েকজন কলিগ। মেয়ের আবদার ফেলতে পারিনি। খুব বেশি আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান নয়, ঘরোয়া পরিবেশে ছোট পরিসরে আয়োজন। মেয়ে তাতেই খুশি, মেয়েকে খুশি রাখাই আমার কাজ। রাত ন'টার দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে সবাই বিদায় নিল। এমন খুশি মেয়েকে কখনো দেখিনি।তাই নিজের অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রু চলে আসল।

ঘরের দেয়ালে তোমার ছবি টানানো ছিল। তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি নি। স্মৃতির পাতায় উঁকি দিল অনেক কিছু।

জয়ন্তী,
জানি না কেমন আছো তুমি। শুধু এটুকুই জানি তুমি ভাল থাকতে পারো না। পারবেনা কখনো এই বিশ্বাসটুকু আমার আছে তোমার প্রতি। জানো আজকে তোমার মনিকার জন্মদিন। হ্যাঁ তোমার মনিকা। মনে পড়ে তোমার সেদিনের কথা যেদিন মনিকাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলে তোমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম তুমি সামলাও এবার। আমি সেদিন বুঝি নি এই কথার মাহাত্ম্য। তোমার মনটা কি আগেই ডেকেছিল সেদিন? তুমি জানতে আগে থেকেই সব? তুমি যদি জানতেই তাহলে বলোনি কেন? আমি তোমায় কখনো একা ছেড়ে দিতাম না। মনিকা আমার একার নয়, মনিকা তোমারও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেদিনের সেই হাসিটাই যে তোমার শেষ হাসি ছিল তা কি আমি জানতাম? যদি ভগবান আমায় বলতো আমার একটা চাওয়ার কথা তাহলে আমি তোমায় ফিরে পেতে চাইতাম। কিন্তু জানি সেটা অসম্ভব। কিন্তু তোমার সেই আশা কে নিয়েই বেঁচে আছি এখনো। জানো এখনো আমার হাতে অনেক সময়। কলেজে যাই ক্লাস নেই, আড্ডা দেই, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি। নিয়মিত এই কাজ করেই চলছে জীবনটা। জানো, মেয়ে এবার বায়না ধরেছে ঘটা করে জন্মদিন পালন করবে। আমি না করতে পারি বলো? জানি আজকে তুমি থাকলে তোমার মতো আর কেউ এতটা খুশি হতো না। মনিকা ঠিক তোমার মতোই হয়েছে। তোমার মনে আছে একবার তুমি কতটা রাগ করেছিলে আমার উপর। একগুয়ে হিসেবেই মানতাম তোমায় কিন্তু তুমি এতটা ছিলে না। মনিকাও তোমার মতোই হয়েছে। আমার উপর রাগ করে, অভিমান করে কিন্তু বাবা উপর রাগ করে থাকতে পারে না। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তুমি এসেছিলে আমার পরিবারে। তোমায় দেখার পর মা আমায় বলেছিল জয়ন্তীকে সুখে রাখিস, ওকে কষ্ট দিস না। আমি মায়ের কথা রাখতে পারিনি। তোমায় নিজের কাছে রাখতে পারিনি। জানো, তুমি যাওয়ার কয়েকবছর পর মা বলেছিল নতুন করে সবকিছু শুরু করতে। কিন্তু আমি কিভাবে এটা করবো বলো? আমি পারবো না। এতদিন মনিকা জানেনি কোনকিছুই। আমিও বলি নি। কাউকে বলতেও বলি নি। আজকের দিনটা তার কাছে অতি আনন্দের কিন্তু সে এটা কখনো জানবে না আজকের দিনটা আমার জন্য কতটা বেদনাদায়ক। মেয়ের মুখে হাসিটা সবসময় দেখতে চাই। আমি বলবোও না কখনো। মনিকার মুখে হাসি দেখতে পেলে আমি তোমার মুখে হাসি দেখতে পাই। তুমি যেখানেই থাকো ভাল থেকো জয়।

রাত ১০ টা বেজে গেছে। বেলকনিতে দাড়ালাম। হালকা দক্ষিণা সমীরণের ছোয়া লাগছে। শরীর হীম হয়ে আসছে ক্রমে। টেবিলে ফোন টা বেজে চলছে।

পাশের ফ্লাটের ফোন। ফ্লাট নিয়ে যেন ঝামেলা চলছে সেটা নিয়ে কথা বলতে চায়।
-মনিকা, মা ঘুমাইছো?
-না বাবা, গুছাইলাম সবকিছু। তুমি ঘুমাবে?
-না, আমি একটু তোমার বিজন আংকেলে কাছে যাচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়ো তুমি?
- আজকে তোমার কাছে ঘুমাবো বাবা। বিছানা গুছিয়ে দেই?
- হবে। তুমি গুছাও। আমি আসতেছি...

বিজন দার সাথে কথা বলতে বলতে একবার মনে পড়লো। জয়ন্তীকে লিখা ডায়েরি টা আলমারিতে ঢোকানো হয় নি। মামণি গেছে রুমে।

চোরের মতো করে রুমে প্রবেশ করলাম। যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো। মেয়ে আমার বিছানায় পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে আছে অশ্রুসিক্ত চোখে। আমি রুমে যেতে না যেতেই মেয়ে আমার অঝোরে কান্না শুরু করল।
বসে থাকতে পারল না সে, অশ্রুসিক্ত কান্নার চোখে আমার দিকে ধেয়ে আসলঃ

-বাবা, তুমি এতটা পাষাণ কেন বাবা? তুমি এতটা পাষাণ কেন? তুমি আমায় আগে বলোনি কেন? আমি চাই না আমার এই জন্মদিন। আমার মা-কে ফিরিয়ে এনে দাও বাবা। আমার মা-কে ফিরিয়ে এনে দাও। আমি আর কখনো আমার জন্মদিন পালন করবো না বাবা। আমার মা কে এনে দাও।

মেয়েকে অশ্রুসিক্ত চোখে জড়িয়ে ধরে ভাবছি, কি করে আমি বলবো মা তোমায় যে, আজকে তোমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। আজকে তোমার জন্মদিন যে...


সর্বশেষ সংবাদ