যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা আইন প্রণয়ন করবো

ডা. দীপু মনি এমপি। সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে গত ৭ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— সাইফুল ইসলাম।

প্রশ্ন: শিক্ষা খাত নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনায় কী কী রয়েছে? মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা ও উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?

ডা. দীপু মনি: গত দশ বছরে দেশে যে বিশাল উন্নয়ন হয়েছে, শিক্ষা খাত এর ব্যতিক্রম নয়। সে উন্নয়নের ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি। সেক্ষেত্রে আমাদের যে নির্বাচনী ইশতেহার, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। আমরা সেটিকেই অনুসরণ করব। ইশতেহারে শিক্ষার মানের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। আমাদের একটি শিক্ষানীতি রয়েছে, এর বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েছে। শিক্ষা আইন করার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একটি খসড়াও প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটির কোথাও কোথাও বিদ্যমান কয়েকটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় সেটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এখন আমাদের প্রচেষ্টা হলো যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা, সে লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের উচ্চশিক্ষা খাতের তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ১৯৭৩ সালে ইউজিসি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬টি, এখন সেটি প্রায় দেড়শ। তাই বর্তমানে ইউজিসিকে শক্তিশালী করে এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমাদের একটি অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করার উদ্যোগ ছিল, সেটির আইন করা হয়েছে, চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছে। এখন আমাদের কাজ হবে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা ও সামনে এগিয়ে নেয়া। আমাদের ২০১২ সালে তৈরি করা যে পাঠ্যক্রম, সেটির কোথাও কোথাও কিছু ভুল রয়েছে বা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বছর সেটি রিভিউ করার একটি সুযোগ এসেছে। আমরা সেটি সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ করছি। এছাড়া দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি রয়েছে দীর্ঘদিনের। গত বছর এর একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সে প্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ করছি।

প্রশ্ন: আপনি শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বললেন। সেটি কীভাবে করবেন?

ডা. দীপু মনি: যখনই আপনি শিক্ষার মানের কথা বলবেন, তখন অবশ্যই মানসম্মত শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। এখন আমাদের শিক্ষকদের চাকরিতে যোগদান করার পরও প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কারণ আগের ব্যাকলগ রয়েছে। তাই নায়েমের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাই। আমাদের যেসব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে সেগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে চাই। যেন নিয়োগ পাওয়ার পরপরই শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়। প্রশিক্ষণ পেয়েই যেন একজন শিক্ষক পাঠদান শুরু করতে পারেন। আবার নতুন চিন্তাও হচ্ছে। এখন শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার পর বিএড অথবা এমএড করছেন। আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি, এটিকে চাকরির আগে নিশ্চিত করা যায় কি না। কারণ যোগদানের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষকদের লম্বা সময়ের জন্য ছাড়তে চান না। এছাড়া পাঠ্যবইয়ের মান উন্নয়নেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আমাদের শিক্ষকদের অনেকগুলো কাজের জন্য সরাসরি মন্ত্রণালয়ে চলে আসতে হয়। আগে হয়তো এসব কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীয়করণ ছিল। কিন্তু সেগুলো কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সে ধরনের কিছু কাজ আংশিক হলেও বিকেন্দ্রীয়করণ করা যায় কি না সে বিষয়ে ভাবছি। এর ভালো-মন্দ সব দিকই আছে। সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। মোটকথা যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ায় সরকারের সব সেবা এখন মানুষের দৌরগড়ায় পৌঁছে দিচ্ছি। শুধু দৌরগড়ায় নয়; এখন তো ফোনের মাধ্যমে হাতের মুঠোয় পৌছে দিতে পারছি। অথচ নিয়োগ, বদলি, বিদ্যালয়ের পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি— এসব নানান কাজের জন্য শিক্ষকদের ছুটে আসতে হয় মন্ত্রণালয়ে। এ কাজগুলোকে আমরা তাদের কাছেই পৌছে দিতে পারি কি না— এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও আমরা কাজ করছি।

শিক্ষা কমিশনের ব্যাপারে শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। আমরা একটি শিক্ষানীতি করেছি। এখন চাই সেটার সফল বাস্তবায়ন। এছাড়া শিক্ষা আইন ও শিক্ষা কমিশন বাস্তবায়ন হলে, ইউজিসি এবং নায়েমের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং পাঠদানের মান বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদের যে লক্ষ্য—গুণগত মান, সেটি অর্জন সম্ভব।

প্রশ্ন: প্রাথমিক পরবর্তী স্তরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এসব প্রতিষ্ঠানে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ সরকারের পক্ষে কতটুকু সম্ভব?

ডা. দীপু মনি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে, এটি ঠিক। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের অবদান বিশাল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বই, অবকাঠামো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ— সবই কিন্তু সরকার করে থাকে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম প্রক্রিয়াগতভাবেই মনিটর করা হয়। যেমন, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে এক ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার মান খারাপ হলে ফলাফলে তা ফুটে উঠবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ কিংবা পাঠদানের অনুমতি— এমন বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই মনিটর করা হয়। আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ওই অর্থে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না, কিন্তু তাদের সব তথ্যই আমাদের কাছে রয়েছে। এছাড়া ব্যানবেইস তো সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ধরনের জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে। তাই এটা বলা যাবে না যে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নজরদারির একদম বাইরে রয়েছে।

প্রশ্ন: গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে দুর্বল অবকাঠামো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?

ডা. দীপু মনি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে আমরা একটি জরিপ চালিয়েছি। কোন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো কেমন, কোথায় কী ঘাটতি রয়েছে, সে তথ্য সংগ্রহ করেছি। যাতে সময়মতো আমরা তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের পেছনে দৌড়াতে না হয়, আমরাই যাব তাদের কাছে।

প্রশ্ন: সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও সেটির সফল বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ পদ্ধতিতে কোনো ধরনের পরিবর্তনে পরিকল্পনা রয়েছে কী?

ডা. দীপু মনি: সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে— তা নিয়ে নানান জায়গায় নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। সেটা নিয়ে আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করছি। এ পদ্ধতি বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে বাস্তবায়ন করছে, আমরা কীভাবে করছি। দুটার মধ্যে তফাত কোথায়, সেগুলো খতিয়ে দেখছি। যাতে সত্যিকার অর্থে নোটবই, গাইডবই, কোচিং— এগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা যায়। আমরা গত কয়েক বছরে এত উন্নতি করা সত্ত্বেও এ একটি জায়গায় পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। এখানে অনেক অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য আছে। আমরা যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি মানের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, তাহলে এসব অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্যও স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।

প্রশ্ন: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বিশ্ববাজারের দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে। সেটি লক্ষ্য অর্জনে আপনারা কী কাজ করছেন?

ডা. দীপু মনি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের যে কাজ করছে, সেক্ষেত্রে শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমরা যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি। সে শিল্প বিপ্লব হবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্সের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে আমাদের মতো দেশ যেন কোনোভাবে পিছিয়ে না পড়ে আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। সে শিল্প বিপ্লবের জন্য আমাদের যে জনসম্পদ তৈরি করা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। ঠিক সময়ে যেন আমরা ঠিক ইন্টারভেনশনটি করতে পারি, সেটিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের আরো বেশি যোগ্য জনশক্তি লাগবে। তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই মোকাবেলা করতে পারব।

এছাড়া শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক ইনোভেশন ও গবেষণা দরকার রয়েছে। আমরা এ খাতগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি। এসব খাতের উন্নয়নে আমার এবং উপমন্ত্রীর মাইন্ডসেট রয়েছে। এছাড়া বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে কারিগরি শিক্ষায়। কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ ভাগে উন্নীত করার কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতেও কারিগরি শিক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে করে এ শিক্ষা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যায়।

প্রশ্ন: সম্প্রতি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া নুসরাতের ঘটনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেটির বাস্তবায়নের হার খুব কম।

ডা. দীপু মনি: নুসরাতের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ঘটনায় আমরা শোকাহত। এ ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য লজ্জাজনকও। যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়ছে কি না, সেটি পরিসংখ্যানের বিষয়। তবে আমার সাধারণ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আগে এসব বিষয় সামনে আনা হতো না। ধামা-চাপা দেয়া হতো। এখন অনেক বেশি সামনে আসছে। এটি ভালো। যত বেশি সামনে আসবে, আমরা তত প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জায়গায় এগোতে পারব। আসলে যৌন হয়রানির ঘটনা সারা দুনিয়ায় এমনকি উন্নত বিশ্বেও ঘটে। আমাদের দেশে এটি আগে থেকেই ছিল। এমনকি পারিবারিক পর্যায়েও অনেক ধরনের যৌন হয়রানি ঘটত, সেগুলো কখনো আলোর মুখ দেখত না। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন তারা এসব ঘটনা সামনে নিয়ে আসছে,প্রতিবাদ করছে। আগে এসব বিষয় আলোচনায় আনার কিংবা পত্র-পত্রিকায় আনার কোনো চিন্তাই করত না। এখন মানুষ অধিকার সচেতন। বর্তমানে একজন বাবা কিংবা একজন মা বিশ্বাস করেন যে, তার মেয়ের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, সেটি আমার মেয়ের অপরাধ নয়, তার অধিকার রয়েছে এর বিচার পাওয়ার। এ সচেতনতাবোধ কিংবা অধিকারবোধ থেকেই প্রতিবাদ বেশি হচ্ছে।

উচ্চ আদালত থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধে যে কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। সে আলোকে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কমিটি করার বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। কীভাবে কমিটি করা হবে, কারা থাকবে, কী পদ্ধতিতে সেটি বাস্তবায়ন হবে সে নির্দেশনা আদালতের রায়ে রয়েছে। সে আলোকে কমিটি গঠনের জন্য বলা হয়েছে। নির্দেশনার বাস্তবায়ন বিষয়েও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মনিটর করা হবে।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কী?

ডা. দীপু মনি: আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিকের পাশাপাশি এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। এজন্য মাঝে-মধ্যে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। সে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে আমাদের একটি পরিকল্পনা হচ্ছে, শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কাউন্সিলর কিংবা সাইকোলোজিস্ট নিয়োগ দেয়ার। শুরুতে সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করব প্রতিটি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে একজন করে নিয়োগ দিতে। তিনি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বা একাধিক শিক্ষককে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন।

আসলে শিক্ষায় নৈতিকতা, বিবেকবোধ, মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম— এসব ক্ষেত্রে আরো অনেক উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। এক সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে মূল্যবোধের একটি গাঁথুনি তৈরি করা হতো। যেমন, সদা সদ্য কথা বলিব। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। এসব কথা শিশুর মস্তিষ্কে প্রোগ্রামিং হয়ে যায়। একেবারে গোড়া থেকেই এ শিক্ষাকে জোরদার করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন আগে যেমন ছিল, সে কাঠামো অনেক বদলে গেছে। আগে বড় পরিবারের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে বাড়িতে দাদা-দাদী, নানা-নানিসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে অনেক কিছু জানার-শেখার ছিল।

এখন জীবনযাপনের পদ্ধতি পরিবর্তনের ফলে একক পরিবারের শিশু ইট-কাঠের শহরে একা একা বড় হচ্ছে। গ্রামেও চিত্র ভিন্ন নয়। এ পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে একটা তফাত তো নিশ্চয় হচ্ছে। এখন বাচ্চারা সারাদিন স্মার্টফোন দিয়ে নানা অ্যাপসে ঢুকছে, ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করছে। এর মাধ্যমে সারা দুনিয়ার ভালো জিনিসের পাশাপাশি খারাপ জিনিসও শিশুদের সামনে আসছে। তাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের সমস্যা বিষয়ে জানতে হবে। বিশেষ করে কোন শিশু যদি বিপর্যস্ত পরিবার থেকে আসে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক ও পরিবারের সদস্যদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

প্রশ্ন: শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন, শিক্ষার্থী ভর্তি ও সনদ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে শিক্ষা খাত নিয়ে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার যে ঘোষণা দিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এর বাস্তবায়ন কতটুকু?

ডা. দীপু মনি: প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিষয়ে শূন্য সহনশীলতার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি অনেক আগ থেকেই চর্চা হয়ে আসছে। আমাকে এখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এখানে একজন উপমন্ত্রীও আছেন। আমাদের সবার চাওয়া এখানে যেন কোনো দুর্নীতি না থাকে। দুর্নীতি দূর করবার জন্য আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। ইতোমধ্যে ছোট-খাটো কিছু পরিবর্তন এনেছি। আরো কিছু পরিবর্তন আনা হবে। আমরা দুইটি উপায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করছি। একটি হচ্ছে পুরো ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা। অন্যটি যখনই কোনো অনিয়মের তথ্য আসে, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বলব,দুর্নীতিগ্রস্থ কেউ আমার কাছে, আমার উপমন্ত্রীর কাছে কোন ধরনের  সহযোগিতা পাবে না, আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে চাই। সংবিধান আমাদের পথ দেখায়, আইন আমাদের পথ দেখায়।

জনগণকে দেয়া ইশতেহার বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। তাই কেউ যদি কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতির পথ বেছে নেয় তাহলে আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি, দুর্নীতি সে অগ্রযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ব্যাঘাত ঘটাবে। আমরা সেটি সহ্য করব না, বরদাশত করব না। যেখানেই দুর্নীতি পাব সেখানেই ব্যবস্থা নিব। এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে। অন্যান্য কাজগুলোতেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। প্রশ্নফাঁস বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে মন্ত্রণালয়। গত তিন মাসে একটি পাবলিক পরীক্ষা হয়েছে, আরেকটি চলছে। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। আগামী দিনেও আমরা সে ধারাবাহিকতা রাখতে পারব।

প্রশ্ন: স্থায়ী ক্যাম্পাসে না গিয়ে অননুমোদিত ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, ভর্তি ও অবৈধ সনদ বাণিজ্যসহ নানা আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব অনিয়ম বন্ধে আপনারা কি উদ্যোগ নিচ্ছেন?

ডা. দীপু মনি: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত যে আইনটি রয়েছে, তা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই অনুসরণ করে না। আবার আইনটিরও কোথাও কোথাও আরো যুগোপযোগী করার প্রয়োজন রয়েছে। এ আইনটির বয়স প্রায় দশ বছর। আবার গত এক দশকেই দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। তাই এ আইনটির সংশোধন ও পরিমার্জন রয়েছে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি ইউজিসির যে সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছি, সেটি করতে পারলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে।

প্রশ্ন: দেশে উচ্চশিক্ষা খাতের বড় একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও অবকাঠামো সংকট প্রকট।

ডা. দীপু মনি: গত দশ বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সেশনজট নিরসন হয়েছে। এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমার মতে,কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ করার চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের আটটি বিভাগে আটটি ক্যাম্পাস করতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিবেশ পাবে। কারণ ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে শুধু ডিগ্রি নেয়া নয়; শিক্ষার জন্য প্রয়োজন একটি ক্যাম্পাস। কেননা মানুষ যতটা না পড়ে শেখে এর চেয়ে বেশি শেখে পরিবেশ থেকে। সেটি করলে খুবই ভালো হয়।


সর্বশেষ সংবাদ