বিশ্বখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে এক তৃষ্ণার্ত যাত্রা

মোহাম্মদ রেজাউল কবির
মোহাম্মদ রেজাউল কবির  © টিডিসি ছবি

‘আল্লাহ যাকে হিদায়াত দিতে চান, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন।’— এই হাদিস হৃদয়ে ধারণ করেই যাত্রা শুরু হয়েছিল মোহাম্মদ রেজাউল কবিরের। বর্তমানে তিনি মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক থিওলজিতে অধ্যয়নরত। পিরোজপুরের সেহাংগল গ্রাম থেকে উঠে আসা রেজাউল স্বপ্নের সিঁড়িতে উঠলেও, যাত্রা ছিল অনেক কঠিন।

অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপ হয় মোহাম্মদ রেজাউল কবিরের। এ সময় তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প বলেন।

রেজাউল কবির ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসা থেকে ২০২০ সালে দাখিল সম্পন্ন করেন। এরপর ২০২২ সালে আলিম সম্পন্ন করেন ছারছিনা দারুসসুন্নাহ কামিল মাদ্রাসা থেকে। সরকারি মাদ্রাসা-ই-ঢাকা (ঢাকা আলিয়া) মাদ্রাসায় ফাজিল শ্রেণিতে ভর্তি হন ২০২২-২৩ সেশনে। প্রতিটি ধাপেই ছিল দুর্দান্ত ও স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার লড়াই।

শৈশব থেকে কেমন স্বপ্ন ছিল? এমন প্রশ্নে রেজাউল কবির বলেন, ‘আল আজহারে যাত্রার শুরু কেবল একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, এটা ছিল আত্মবিশ্বাস, প্রার্থনা ও অধ্যবসায়ের সম্মিলিত একটি সাধনা। বাংলাদেশে আল আজহারের প্রতিনিধি দলের আয়োজিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কোরআন তিলাওয়াত, হাদিস, আরবি ভাষা ও মৌলিক ফিকহ বিষয়ে নিজের প্রস্তুতি যাচাই করি। নির্বাচনের পর শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত সেই চিঠির জন্য প্রতীক্ষা—যা হাতে পেয়েই হৃদয় উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এরপর ভিসা প্রক্রিয়া, কাগজপত্র, দূতাবাসের আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে, জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রমণে পা রাখি জ্ঞাননদী নীলের দেশ, মিসরের কায়রো শহরে।

আরও পড়ুন : ‘আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে, এভাবে কাজ করতে পারব না’

কায়রোর বুকে নতুন জীবনের সূচনা, অনুভূতি কেমন? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কায়রো শুধু একটি শহর নয়—এ যেন জ্ঞানের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ মঞ্চ। শতাধিক দেশের শিক্ষার্থী, হাজারো ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বপ্ন এখানে মিলেমিশে এক উম্মাহর প্রতীক হয়ে ওঠে। এখানকার প্রতিটি অলিগলি, মসজিদ ও মজলিস যেন জ্ঞানের স্পন্দনে নড়েচড়ে ওঠে। এই শহরের বুকে পা রেখে আমি যেন নিজেকেই নতুনভাবে চিনতে শিখি।’

রেজাউল বলেন, ‘বর্তমানে আমি আল আজহারে ইসলামিক থিওলজি ফ্যাকাল্টিতে অধ্যয়নরত, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য—তাফসিরুল কোরআনে বিশেষায়িত হওয়া। প্রতিটি ক্লাস যেন কুরআনের গভীরতা বোঝার এক নতুন জানালা। আয়াতের ভাষ্য, শানে নুজুল, ব্যাকরণ ও দর্শন—সবকিছুই আমাকে করে তোলে আরও অনুগত, আরও অনুসন্ধানী।

আরবি ভাষার চ্যালেঞ্জ থেকে ভালোবাসা, উল্লেখ করে কবির বলেন, ‘প্রথমে আরবি ভাষা ছিল অচেনা এক নদীর মতো—জল ছিল, প্রবাহ ছিল, তবে বুঝে ওঠা কঠিন। সময়ের সঙ্গে সেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি। এখন প্রতিটি তরঙ্গে যেন কোরআনের সুর, হাদিসের সৌন্দর্য। আল আজহারে আরবি ভাষা কেবল শেখানো হয় না, বরং জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।’

ভবিষ্যতের লক্ষ্য কী? বিশ্বখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আহরিত জ্ঞানের আলোয় সমাজে অন্ধকার দূরীকরণের লক্ষ্য আছে কি না? জানতে চাইলে রেজাউল বলেন, ‘আমার স্বপ্ন একটাই—এই পবিত্র শিক্ষাকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া এবং একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। আমি চাই এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে, যারা কোরআন ও সুন্নাহর আলোয় আলোকিত হবে, চিন্তাশীল হবে, চরিত্রবান হবে। আমি নিজেকে আল্লাহর দ্বীনের একজন নীরব খাদেম হিসেবে নিযুক্ত করতে চাই।’

আরও পড়ুন : এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধ: পথ পাড়ি দেওয়া কতটা কঠিন?

তরুণদের উদ্দেশে কী পরামর্শ দেবেন? অথবা আল আজহারে সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি কী হতে পারে?

রেজাউল বলেন, ‘আল আজহারে পড়ার পথ সহজ নয়। তবে অসাধারণ সুন্দর। প্রয়োজন নিষ্ঠা, ধৈর্য, আরবি ভাষার দক্ষতা ও শুদ্ধ নিয়ত। এটি কেবল একটি সার্টিফিকেট নয়—বরং একটি জীবনদর্শন, একটি আদর্শিক অভিযাত্রা। যারা এই পথে পা বাড়াতে চান, তাদের বলব, এই পথ আপনাকে কেবল জ্ঞান দেবে না, আপনাকে গড়ে তুলবে আদর্শবান মানুষ হিসেবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আল আজহার আমার কাছে কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়— এটি আত্মার আলোকিত যাত্রা। আমি এখানে এসে উপলব্ধি করেছি, জ্ঞান কেবল জানার নয়, এটি অন্তরকে আলোকিত করার এক মহামার্গ। আমি কৃতজ্ঞ আল্লাহর প্রতি, যিনি আমাকে এই পথে আহ্বান করেছেন।’


সর্বশেষ সংবাদ