হাত খরচের টাকায় করোনা মোকাবিলায় রোবট বানাল দশম শ্রেণির ছাত্র

রোবটরে সঙ্গে শাওন
রোবটরে সঙ্গে শাওন  © সংগৃহিত

মহামারি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেক সময় স্বজনরাও করোনা আক্রান্ত রোগীর কাছে যেতে চান না। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে রোবট উদ্ভাবন করেছে দশম শ্রেণির ছাত্র শাওন সরদার সোলাইমান।

শাওন সরদার সোলাইমানের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার উপজেলার ভদ্রপাড়ায়। তার বাবা দেলোয়ার সরদার স্থানীয় বাজারে জুতার ব্যবসা করেন। সে উপজেলার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির ছাত্র। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় শাওন।

জানা গেছে, করোনার এই দুঃসময় প্রযুক্তির মাধ্যমে মোকাবেলা করার চিন্তা থেকে এক বছর আগে রোবট বানানোর কাজে হাত দেয় শাওন। সে নিজের উদ্ভাবিত রোবটের নাম দিয়েছে ‘মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট’। তার উদ্ভাবিত রোবট করোনা রোগীর বেডের পাশে গিয়ে তার চিকিৎসায় প্রাথমিক পরামর্শ দিতে পারবে। এছাড়াও রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা, রোগীর অবস্থান থেকে চিকিৎসক দূরবর্তী কোথাও থাকলে তাকে সরাসরি দেখাতে পারবে। রোগীর অবস্থান থেকে রোবটের পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসক নতুন কোনো পরামর্শ দিলে বা করোনা রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রোবট কথা বলিয়ে দেবে।

রোবটের উদ্ভাবক শাওন জানান, ২০২০ সালের মার্চ মাসে চূড়ান্তভাবে রোবট বানানোর কাজ শুরু করি। আমি মূলত ভিন্ন কিছু নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। যে রোবট আমাদের বড় ধরণের সমস্যার সমাধান করতে পারবে তা নিয়েই কাজ করছি। গত বছরের মার্চ মাসে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয় তখন মা ছেলের কাছে যান না, ছেলে মা-বাবাকে ফেলে রেখে যান এমন অনেক খবর পাই। তখনই সিদ্ধান্ত নিই আমি করোনা প্রতিরোধে রোবট তৈরি করবো। এরপর অনলাইনে রোবট উদ্ভাবনের ভিডিও দেখে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করতে শুরু করি।

শাওন আরো জানায়, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন করোনার চিকিৎসা দিতে পারে সেই প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছেন। এতে করে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। সেই সঙ্গে চিকিৎসকরাও ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।

রোবট বানাতে পরিবার থেকে বিশেষ কোনো সহায়তা পায়নি জানিয়ে সে জানায়, যা করেছে তা নিজের চেষ্টায়। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের সিস্টেম ডেভেলপ করলে দেশে করোনা মোকাবেলায় এটি কাজে আসবে বলেও জানায় সে।

বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে রোবট উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় আসে তার। ভবিষ্যতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় শাওন।

ছেলের এই উদ্ভাবনে খুশি বাবা দেলোয়ার সরদার। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করতো শাওন। নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই নিজে নিজে বলতো সে রোবট তৈরি করবে। আমরা তখন বিষয়টি হাস্যরস করে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু ওর স্কুলে যাওয়ার জন্য যে হাত খরচ দিতাম সেই টাকা জমিয়ে দিনে দিনে দেখছি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে একটি রোবট তেরি করেছে।

তিনি আরও বলেন, শাওনের রোবট সব ভাষায় কথা বলতে পারে। এর সব সিস্টেমই মোবাইল দিয়ে করেছে সে। তবে আমার আফসোস ছেলেকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে পারিনি। পারলে আরও দারুণ কিছু আবিষ্কার করতে পারতো।

গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল হক জানান, শুধু শাওন সরদারই নয়, ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের আরও দুই ছাত্র ইতোমধ্যে ‘রবিন’ ও ‘বঙ্গ’ নামে দুটি স্বয়ংক্রিয় রোবট উদ্ভাবন করে যথারীতি হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শুভ কর্মকার ২০১৮ সালে উদ্ভাবন করে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলা রোবট রবিন। ওই একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সুজন পাল চলতি বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের মাসে উদ্ভাবন করে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলতে পারা রোবট।

প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল হক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করছি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছে। ওদের উদ্ভাবন ও এগিয়ে যাওয়ায় আমরা গর্বিত।

এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, উপজেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এটি আনন্দের সংবাদ। আমরাও তাদের সহায়তা করতে চাই। এইসব ক্ষুদে প্রযুক্তিবিদরা এক সময়ে বড় বিজ্ঞানী হবে বলে আমার বিশ্বাস। যারা রোবট নিয়ে কাজ করছে তারা সহায়তার আবেদন করলে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সহায়তার চেষ্টা করব।


সর্বশেষ সংবাদ