উচ্চ মাধ্যমিকে পথ দেখাচ্ছে দেশের চার মিশনারি কলেজ
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:০৫ PM , আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:০৫ PM
দেশের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সেরা কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হলে সামনের দিকে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম আসবে তার মধ্যে অন্যতম রাজধানীর নটর ডেম, হলিক্রস কিংবা সেইন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দেশের স্বনামধন্য এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ধর্মযাজক ও সদস্যরা। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, দেশ-বিদেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান কিংবা সামনের সারিতে থাকা, শীর্ষ সরকারি-বেসরকারি চাকরি কিংবা অন্য যেকোনো সূচকে সামনের সারিতেই থাকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নাম।
মূলত ভিন্নধর্মী পাঠদান কৌশল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুসম্পর্ক, শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশসহ নানা কারণে প্রথম সারিতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষায়ও এগিয়ে রয়েছে এসব শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সুযোগ থাকে না কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততারও; ফলে শিক্ষাই হয় এখানকার মূল আয়োজন। হাতে-কলমে শেখার ধারণা কিংবা বাণিজ্যিকীকরণের বাইরে গিয়ে শিক্ষাকে জাতি গঠনের একটি বড় সেবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে মিশনারি সন্ন্যাস সংঘ পরিচালিত এ শিক্ষালয়গুলো।
বাংলাদেশে মিশনারি শিক্ষার ইতিহাস:
বর্তমান বাংলাদেশ এবং পূর্ববর্তী ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যায় ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ শতকের দিকে পর্তুগিজরা যখন এই উপমহাদেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসে তখন তাদের সাথে আসে একদল খ্রিষ্টান ধর্মযাজকও।
এরপর ১৪৯৮ সালের ২০মে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ভারতের কালিকট বন্দরে নোঙর করলে বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয় খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারও। এসময় ধর্মীয় প্রচার কৌশলের অংশ হিসেবে এবং প্রচলিত সমাজ বাস্তবতায় তারা বেশ কিছু সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ক্ষেত্রবিশেষে যাকে এই অঞ্চলের বিকাশের বড় পরিবর্তনের দিক বলা যায়; শিক্ষা তার অন্যতম।
১৫ শতকের দিকে ব্যবসাসহ বিভিন্ন কারণে উপমহাদেশে আসে ইংরেজরা
রাজধানী ঢাকায় প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই; ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়টি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম সরকারি স্কুল। এটি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ব্যাপস্টিক মিশনারি ওয়েন লিওনার্দোর। আর ১৮১৬ সালে ঢাকায় খ্রিষ্টান শিশুদের জন্য প্রথম প্রথাগত বিদ্যালয় চালু করা হয়। ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ মূলত একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে এবং যার প্রধান শিক্ষক ছিলেন রেডগে এবং তিনি একজন ইংরেজ ধর্ম যাজক।
পরবর্তীতে ১৮৪১ সালে একই স্কুল প্রাঙ্গণে ভিত্তি স্থাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী বর্তমান ঢাকা কলেজের। উপমহাদেশের বিচারে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আরও বেশকিছু স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ বিচারে উচ্চ মাধ্যমিক তথা কলেজ শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় পাকিস্তান আমলে নটর ডেম কলেজ, ঢাকা; হলিক্রস কলেজ; সেইন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়; সেইন্ট গ্রেগরীজ স্কুল(পরবর্তীতে ২০১৬ সালে কলেজ শাখা) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হচ্ছে সাফল্যের সাথে। মূলত হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারদের মাধ্যমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকায় প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই; ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়টি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম সরকারি স্কুল। ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ মূলত একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেছিল।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে সকল ধর্মের ছেলে-মেয়েদের। নটর ডেম কলেজ, ঢাকা; ছেলেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ, যা ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত। এছাড়াও ঢাকার তেজগাঁওয়ে মেয়েদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে হলিক্রস কলেজ। সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ঢাকার মোহাম্মদপুরে ও পুরান ঢাকার বকশি বাজারে খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে আরেক শিক্ষার্থী সেইন্ট গ্রেগরীজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় বরাবরই ইতিবাচক ফলাফল করছে ব্যাপিস্ট্যান্ট ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মাধ্যমে পরিচালিত এসব কলেজ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, বিভিন্ন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা ও প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষায় দেশে এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য রয়েছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে যে-সব কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তার মধ্যে নটর ডেম, হলিক্রস, সেইন্ট জোসেফ, সেইন্ট গ্রেগরীজের সাফল্যই অন্যতম।
নটর ডেম কলেজ
দেশের অন্যতম ও সেরা নামকরা উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজ। ১৯৪৯ সালের ৩রা নভেম্বর মাত্র ১৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ধর্মযাজকদের দ্বারা পরিচালিত এ শিক্ষালয়টি। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার থেকে যাত্রা শুরু করা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল সেইন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল। পরবর্তীকালে রাজধানীর মতিঝিলে বড় পরিসরে নতুন ক্যাম্পাসে ১৯৫৫ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে মিশনারি এই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
নটর ডেম কলেজের প্রধান ফটক পার হলে স্বাগত জানাবেন মাতা মেরী
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) গঠিত হলে শিক্ষা বিস্তারে তৎকালীন সরকার ক্যাথলিক চার্চের প্রধানকে কয়েকটি কলেজ স্থাপনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাথলিক চার্চের প্রদান আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেনার ছেলেদের জন্য কলেজ স্থাপনের নির্দেশ দেন হলি ক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজক ও সিস্টারদেরকে। সে নির্দেশের প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালে লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ নামে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে ক্লাস শুরু করে।
১৯৪৯ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে হলিক্রস ফাদারগণ কর্তৃক ‘সেন্ট গ্রেগরি কলেজ’ নামে প্রথমে ক্যাথলিক কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা-লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৫০ সালে ৬১/১ সুভাষবোস এভিনিউর একটি ভবনে কলেজটি স্থানান্তরিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৯৫৪ সালে এটি মতিঝিলের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং মাতা মেরির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় নটর ডেম কলেজ। পবিত্র ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ফাদারদের নীতি ও আদর্শ দ্বারা কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে শুরু থেকে।
১৯৪৯ সালের ৩রা নভেম্বর মাত্র ১৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ধর্মযাজকদের দ্বারা পরিচালিত এ শিক্ষালয়টি। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার থেকে যাত্রা শুরু করা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল সেইন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল।
শুরুতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও ১৯৫৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগও চালু হয়েছিল। শুরু থেকেই বোর্ড ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় সাফল্য পায় এখানকার শিক্ষার্থীরা। সাফল্যের অগ্রযাত্রায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।
মূলত নটর ডেম কলেজ ব্যবহারিক নির্ভর মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষায় যুগের চাহিদা ও সময়োপযোগী মানুষ তৈরির ব্রত পালন করছে নিষ্ঠার সাথেই। আদিবাসী, সংখ্যালঘু, খ্রিষ্টান ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিয়ে বর্তমানে কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার ৫০০। মিশনারি কলেজ হলেও এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মুসলিম, শতাংশের হিসেবে যা ৮৫ শতাংশ।
ফাদার হ্যারিংটন ভবন: মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের প্রথম ভবন
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১৩টি বিভাগের অধীনে রয়েছেন মোট ৯১জন শিক্ষক। কলেজটির বর্তমান অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি। সুনির্দিষ্ট বাঁচাই ও ভর্তি পরীক্ষা, নিয়মিত কুইজ ও পরীক্ষা, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক ও শৃঙ্খলিত নিয়মের প্রতিপালনের ফলে প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের থেকে আলাদা হতে পেরেছে বলে মনে করেন কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞান বিভাগের ১৪টি বাংলা ও ২টি ইংরেজি, মানবিক শাখায় ৩টি ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ৬টি সহ মোট ২৫টি গ্রুপে শিক্ষাদান করা হয় কলেজটিতে। শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ও নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন করতে নটর ডেম কলেজে রয়েছে হচ্ছে ২৫টি ক্লাব।
বাংলাদেশের প্রথম ডিবেটিং (বিতর্ক) ক্লাব নটরডেম ডিবেটিং ক্লাবও নটর ডেম কলেজেরই। যাকে বলা হয় ‘ফাদার অব ডিবেটিং’ ক্লাব (Father of debating). এছাড়াও রয়েছে বিজ্ঞান ক্লাব, গণিত ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এন্ড রিলেশন ক্লাব, ইংলিশ ক্লাব, চেজ ক্লাব, আইটি ক্লাব ইত্যাদি।
কলেজের বার্ষিক প্রকাশনা ‘ব্লু অ্যান্ড গোল্ড’, দ্বিমাসিক প্রকাশনা ‘ঢাক-ঢোল’, যা শিক্ষার্থীদের কলেজ জীবন ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে। নটর ডেম কলেজের রয়েছে সামাজিক শিক্ষা কার্যক্রম, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষার্থীরা ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা খরচে পড়তে পারে ‘নটরডেম লিটারেসি স্কুল’ এ। আর উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ‘কাজের বিনিময়ে পড়াশোনা’ করার মতো সামাজিক শিক্ষা কার্যক্রমও।
ফাদার টিম ভবন: নটর ডেম কলেজ, ঢাকা
বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী, সংবিধান প্রণেতা ও রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, সালমান এফ রহমান, মাহফুজ আনাম, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, হাসানুল হক ইনু, গোলাম দস্তগীর গাজী, জাহিদ মালেক, সমশের মুবিন চৌধুরী, ড. মুরাদ হাসান, তাহসান রহমান খান, ওয়াহিদ ইবনে রেজাসহ আরও অনেকেই রয়েছেন কলেজটির কৃতী শিক্ষার্থীদের তালিকায়।
‘‘আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলেই নটর ডেম কলেজের এতো সাফল্য। আজকের এই অবস্থান। আমি আশা করছি, নটর ডেম কলেজের সকল শিক্ষার্থীরা আর্ত-মানবতার সেবায় কাজ করবে। আমরা আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো’’—জানান কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি।
হলিক্রস কলেজ
বাংলাদেশে হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজকদের দ্বারা পরিচালিত আরেকটি মিশনারি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষালয় হলিক্রস কলেজ। মেয়েদের জন্য পরিচালিত দেশের খ্যাতনামা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ এটি। ক্যাথলিক যাজকদের মাধ্যমে পরিচালিত এই কলেজে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শিক্ষা শাখায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের ভিত্তিতে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে মোট ২৫০০ শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়।
মাত্র ৫জন শিক্ষার্থী (ছাত্রী) নিয়ে ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজক সিস্টার শিখা গোমেজ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ঢাকার আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেইনার সিএসসি, সিস্টার আগষ্ঠিন মারীকে কলেজটি পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। ১ নভেম্বর ১৯৫০ থেকে তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং তাকে সহায়তা করেন সিস্টার রোজ বার্নার্ড, সিএসসি।
হলিক্রস কলেজ
হলিক্রস কলেজের যাত্রার শুরুতে শুধু মানবিক শিক্ষা শাখা ও পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে বিজ্ঞান এবং সর্বশেষ গত ২০০৬ সালে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় পাঠদান শুরু করা হয়। বর্তমানে ৪৫জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পাঠদান করা হচ্ছে কলেজটির ছাত্রীদের। শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোর পাশাপাশি কলেজটির রয়েছে একটি কার্যকর অ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন, যা ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত। কলেজটি দ্বিতীয় শিফট চালু করা হয় বিগত ২০০৮ সালে।
হলিক্রস কলেজের বার্ষিক প্রকাশনা স্ক্রাইব ও জ্যোতি। বিজ্ঞান ও বিতর্ক ক্লাবের পাশাপাশি কলেজটিতে বছরে একবার আয়োজন করা হয় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার। হলিক্রস কলেজের কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম নারী স্পিকার ড.শিরীন শারমিন চৌধুরী, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, বিমান বাহিনীর প্রথম নারী পাইলট নাঈমা হক, বিএনপির সাংসদ ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও বিশিষ্ট অভিনেত্রী সূবর্ণা মুস্তফার মতো অগ্রণী নারীরা।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
খ্রিষ্টান মিশনারি তথা হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজকদের দ্বারা পরিচালিত আরেকটি মিশনারি বিদ্যাপীঠ সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্বে ‘সেইন্ট জোসেফ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল। এটি প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকান খ্রিষ্টান যাজেরা। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ক্যাম্পাস ছিল পুরান ঢাকার নারিন্দায়, পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে ঢাকার আসাদ এভিনিউয়ে স্থানান্তর করা হয়।
বর্তমানে এখানে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় পাঠদান করা হয়। শুরুতে ইংরেজি মাধ্যম থাকলেও পরবর্তীতে বাংলা এবং আবারও ১৯৯৯ সালে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এখানে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই পাঠদান করা হয় এই শিক্ষালয়ে। বর্তমানে বছরান্তে সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শাখা থেকে ১৬৫ জন ও কলেজ থেকে ৬৫০-৭৫০ জন শিক্ষার্থী তাদের স্তরভিত্তিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে রয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, হ্যান্ডবল, টেবিল টেনিস ও দাবার মতো বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সুযোগ। এখানকার কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দাবার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, বাংলাদেশের দাবার দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান, দাবার তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার, গায়ক, গীতিকার ও সুরকার তাহসান রহমান খান, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় শাহরিয়ার নাফীস, সাবেক সাংসদ আন্দালিব রহমান, অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী অরুণ সাহা, রাজনীতিবিদ তারেক রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অভিনেতা ও কমেডিয়ান নাভিদ মাহমুদের মতো তারকারা।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. ব্রাদার জেমস পিরাইরা মনে করেন শিক্ষার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতি, যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের কারণে এখানকার শিক্ষার্থীরা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমরা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। সেজন্য আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে শিক্ষার মানসম্মত ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে আমরা কাজ করছি। এখানে আমাদের লুকানো অথবা একদমই ভিন্ন কোনো কিছু নেই; আমরা শিখন-শিখানোর মাধ্যমে শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।
সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বাংলাদেশের অন্যতম আরেকটি ক্যাথলিক উচ্চ বিদ্যালয় সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বাংলাদেশ পূর্ববর্তী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে বেলজিয়ামের বেনেডিক্টাইন ধর্মযাজক গ্রেগরি ডি গ্রুট এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষালয়েই জন্ম হয়েছিল ঢাকার নটর ডেম কলেজের এবং পরবর্তীতে নটর ডেম কলেজ মতিঝিলে স্থানান্তরিত হয় ১৯৫৩ সালে।
বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শিক্ষালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীদের তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংবিধান প্রণেতা ও আইনজীবী ডা. কামাল হোসেন, জামিলুদ্দিন হাসানদের মত গুণীজনেরা।
সেইন্ট গ্রেগরীতে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের একসাথে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল ১৯১২ সালে সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত। পরবর্তীতে এটি বয়েজ স্কুল এ পরিণত হয় এবং ১৯১৪ সালের দিকে এখানেই সূচনা হয় বাংলাদেশ স্কাউটসের। দেশ বিভাগের আগে শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা হতো সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান শুরু করে শিক্ষালয়টি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের দেক ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পর বিগত ২০০৮ সালের দিকে আবার ইংরেজি ভার্সনে পাঠদান চালু করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করা হয় ২০১৬ সালের দিকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ শিক্ষালয়টির প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্র, শিক্ষকসহ মোট ৩০ জনকে জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। এদিন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক পি ডি কস্তাসহ একাধিক শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা অর্পণ করে সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শিক্ষালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীদের তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংবিধান প্রণেতা ও আইনজীবী ডা. কামাল হোসেন, জামিলুদ্দিন হাসানদের মত গুণীজনেরা।
এছাড়াও এ শিক্ষালয়েরই ছাত্র ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দিন আহমদ,বিখ্যাত ব্যান্ড শিরোনামহীনের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জিয়া। দেশের দুই গুণী ব্যক্তিত্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫০ সালে এবং জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৫৭ সালে এখান থেকে পাস করেন।
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। আর একাধারে লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপকও নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক।