সপ্তাহে চার দিন কাজ শরীর ও মনের জন্য ভালো, কিন্তু আমরা তা করছি না কেন?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ০৫:৫২ PM , আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩২ AM
টানা পাঁচ দিন কাজ করো, তারপর দুই দিন ছুটি কাটাও, এরপর আবার পরের সপ্তাহের জন্য প্রস্তুতি নাও। কিন্তু বিষয়টি যদি এমন না হতো, তাহলে কেমন হতো? ন্যাচার হিউম্যান বিহেভিয়ার জার্নালে প্রকাশিত বড় এক গবেষণায় দেখা গেছে, চার দিনের কর্মসপ্তাহ মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।
বস্টন কলেজের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের ১৪১টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছ থেকে চারটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো হলো––ক্লান্তি, কাজের সন্তুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য।
ট্রায়ালের বিষয়ে প্রধান গবেষক ওয়েন ফ্যান বিবিসিকে বলেন, “আমরা দেখেছি, কর্মীদের সুস্থতা বেড়েছে। কোম্পানিগুলোও উৎপাদনশীলতা ও আয়ের ক্ষেত্রে উন্নতি দেখেছে। তাই, ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর ৯০ শতাংশ কোম্পানি চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে কর্মসপ্তাহ ছোট থাকাটা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এটি কাজ-জীবনের ভারসাম্য উন্নত করে এবং জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি বাড়ায়। এর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা মস্তিষ্কের গঠনেও প্রভাব ফেলতে পারে। ছোট কর্মসপ্তাহ শরীরের জন্য এত ভালো, তা জানার পরও এটি বাস্তবায়নে বাধা কোথায় তাহলে?
অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি
চীন ‘৯৯৬’ ওয়ার্ক কালচার বা কাজের সংস্কৃতির জন্য সুপরিচিত। এর মানে হলো সেখানকার মানুষ সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করেএবং সপ্তাহে ছয় দিনই এভাবে কাজ চলে। ভারতের প্রযুক্তি ও আর্থিক খাতের অনেক কর্মীকে বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে দীর্ঘ ও অস্বাভাবিক সময়ে কাজ করতে হয়। “চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে দীর্ঘ সময় কাজ করাকে গৌরবের ব্যাপার হিসেবে দেখা হয়,” বলেন প্রফেসর ফ্যান।
জাপানের মানুষ তো কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এতটাই বেশি কাজ করে যে অতিরিক্ত কাজের কারণে মৃত্যুর জন্য সে দেশে আলাদা একটি শব্দ আছে, কারোশি। জাপানের শ্রমবাজার ও কাজের সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ হিরোশি ওনো বলেন, “জাপানে কাজ শুধু কাজ নয়, এটা যেন সামাজিক রীতি। কোনো কাজ না থাকলেও মানুষ সময়ের আগেই অফিসে আসে ও দেরিতে যায়। কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখানোর জন্য তারা এটি করে থাকে।”
হিরোশি ওনো বলেন “এটা আসলে প্রদর্শনমূলক। মার্শাল আর্টে যেমন নির্দিষ্ট ভঙ্গি বা কৌশল মেনে চাল দিতে হয়, এখানেও তেমনি কাজ করলে তা দেখানোর একটি বিষয় আছে।” তিনি বলেন, জাপানের সমষ্টিবাদী সংস্কৃতি এই প্রবণতাকে উসকে দেয়। “কেউ যদি শুক্রবার ছুটি নিতে শুরু করে, অন্যরা ভাবে- ও কেন আজ কাজ এড়াতে পারছে?” ব্যাখ্যা করেন তিনি।
জাপানে আইনগতভাবে এক বছরের পিতৃত্বকালীন ছুটি সুবিধা আছে। কিন্তু সেটিও অনেকে নেয় না। “কারণ তারা সহকর্মীদের অসুবিধায় ফেলতে চায় না,” বলেন হিরোশি ওনো।
অধ্যাপক ওয়েন ফেন বিশ্বাস করেন যে তাদের এই গবেষণার মতো আরও ট্রায়ালে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। এমনকি যেসব দেশে অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি রয়েছে, সেখানেও। আইসল্যান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখন তুলনামূলক কম সময় ধরে কাজ করেন এবং তাদের এখন সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমিয়ে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন, ডোমিনিকান রিপাবলিক ও বতসোয়ানাসহ আরও কয়েকটি দেশেও এই একই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে বা হয়ে গেছে। এ বছরের শুরুর দিকে জাপানের টোকিওতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য চার দিনের কর্মসপ্তাহের পাইলট কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
দুবাইও সম্প্রতি তাদের সরকারি কর্মীদের জন্য একই ধরনের গ্রীষ্মকালীন উদ্যোগ চালু করেছে। এছাড়া, ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে দক্ষিণ কোরিয়া পরীক্ষামূলকভাবে ৬৭টি প্রতিষ্ঠানে সাড়ে চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করবে।
ভারসাম্য নেই কাজ ও জীবনে
“কোভিডের পর থেকে অনেকেই মনে করছেন, তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য নেই এবং এই ট্রেন্ড বদলানোও সম্ভব না,” বলেন ফোর ডে উইক গ্লোবাল-এর সিইও ক্যারেন লো।
ব্রাজিল থেকে নামিবিয়া কিংবা জার্মানি, মোদ্দাকথা ‘চার দিনের কর্মসপ্তাহের মডেল পরীক্ষায়’ পুরো বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করে তার সংস্থা। সংস্থাটির বড় সাফল্যের একটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর গোল্ডেন শহরে ২৫০ জনের সমন্বয়ে গঠিত পুলিশ বিভাগ। চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করার পর অতিরিক্ত সময় কাজ করানোর যে খরচ, তা প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে এবং পদত্যাগের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে।
“এই মডেল যদি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা পুলিশ বিভাগে কাজ করে, তবে এটি সবখানেই কাজ করতে পারে” বলে মনে করেন ক্যারেন লো। “২০১৯ সালে যখন মডেলটি পরীক্ষা করা হচ্ছে, তখন হাতে গোণা অল্পকিছু কোম্পানি এতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এখন সেই সংখ্যাটি কয়েক হাজার,” যোগ করেন তিনি।
“এটি এখন প্রমাণিত। এখন শুধু বোঝার ক্ষমতার অভাব আছে” উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট কর্মসপ্তাহ মানে কম উৎপাদনশীলতা, এই ধারণা আসলে ভুল।
২০১৯ সালে মাইক্রোসফট জাপান চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করে। দেখা যায় যে আগের বছর প্রত্যেক কর্মী যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করতেন, চার দিন কাজ চালুর পর সেই বিক্রি ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে মাইক্রোসফট জাপান এটিকে আর স্থায়ীভাবে চালু করেনি।
অধ্যাপক ফ্যানের গবেষণায় দেখা গেছে, কম প্রভাব রাখে, এমন কিছু কাজ বাদ দেওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনশীলতা প্রায় একই রকম ছিল। যেমন, অপ্রয়োজনীয় মিটিং-এর বদলে তারা ফোনকল বা মেসেজকে বেছে নিয়েছে।
আরেকটি ভুল ধারণা হলো, সাপ্তাহিক ছুটি কাটানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে কর্মীদেরকে কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে, বলছিলেন লো। “মূল বিষয়টা হলো পাঁচ দিনের কাজ জোর করে চার দিনে চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং অপ্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ করা। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আমাদের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে, ফলে অদক্ষতা শনাক্ত করাটাও সহজ হয়ে যাচ্ছে।”
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে স্টেলেনবশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সেন্টারের পরিচালক চার্ল ডেভিডসের জন্য চার দিনের কর্মসপ্তাহ ছিল একটি আশা জাগানিয়া সুযোগ। তার দলটি ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দেয়। কর্মসপ্তাহে এই পরিবর্তনের আগে কাউন্সেলিং সেন্টারের কর্মীরা অতিরিক্ত চাপ ও ক্লান্তিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন।
“আগে অনুপস্থিতির হার ছিল খুব বেশি। মানুষ অসুস্থতার কথা বলে বারবার ছুটি নিচ্ছিলো। এটা আলসেমির জন্য নয়, বরং তারা টিকে থাকার চেষ্টা করছিলো,” বলেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেশগুলোর একটি। চার্লের টিমে ৫৬ জন ছিলেন। সীমিত লোকবল দিয়ে বেশি কাজ করানোর কারণে তারা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন। সিনিয়রদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি তখন চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালু করেন। “তারা ভেবেছিলো, এটি কাজ করবে না। কিন্তু আমি করলাম এবং চমকপ্রদ ফলাফল পেলাম,” বলেন তিনি।
আগের বছরে অসুস্থতাজনিত ছুটি ছিল ৫১ দিন। আর ছয় মাসের ওই পরীক্ষামূলক সময়ে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র চার দিনে। আর কর্মীরাও জানায় যে তাদের এসময় ভালো ঘুম হয়েছে, তারা বেশি সময় ধরে ব্যায়াম করতে পেরেছে, নিজেদের শখ পূরণ ও পরিবারের সাথে ভালোভাবে সময় কাটিয়েছে।
চার্ল ভেবেছিলেন, কর্মীদের ছুটি একদিন বাড়িয়ে দেওয়ায় কর্মীরা বাড়তি আয়ের জন্য ওই অতিরিক্ত সময়েও কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে কেবল একজনই তা করেছে। তার মতে, কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বাড়ায় তারা কাজে আরও ভালো হয়েছে। “তারা আরও মনোযোগী, আরও সহানুভূতিশীল হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দেওয়া সেবামানেও এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিলো,” জানান তিনি।
সবার জন্য নয়
তবে এই ধরনের পরিবর্তন সবার জন্য কার্যকর না। অধ্যাপক ওয়েন ফ্যান বলেন, একটি দেশের শিল্প কাঠামো এবং উন্নয়নের ধাপ, দু'টোই গুরুত্বপূর্ণ। “আফ্রিকার অনেক মানুষ কৃষি, খনি বা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাই সেখানে শ্রমের এসব নমনীয়তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম,” বলেন ক্যারেন লো।
লো বলেন, নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন কাজগুলোকে পুনর্গঠন করা কঠিন এবং এসব ক্ষেত্রে মালিকরা সময়সূচি পুনর্বিবেচনা করতে চান না। তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে, অল্পতে অধিক মুনাফা। তবে সেসব দেশেও কিছু অগ্রগতি হচ্ছে।
অধ্যাপক ফ্যানের গবেষণায় নির্মাণ, উৎপাদন ও হসপিটালিটি খাতের কোম্পানিগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের মধ্যে কিছু সফলতার কথা জানা গেছে। তিনি বলেন, “এটি বিভিন্ন খাতের জন্য কার্যকর হতে পারে, কিন্তু আমি চার দিনের পরীক্ষামূলক কর্মসপ্তাহকে সবার জন্য সমান সমাধান হিসেবে দাবি করছি না।”
পরিবর্তনের চালিকাশক্তি তরুণ প্রজন্ম
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হবে তরুণ প্রজন্ম। ২০২৫ সালের এক বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বেতন নয়, বরং কাজ ও জীবনের ভারসাম্যকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক তরুণ কর্মী বলছেন, কম বেতনের বিনিময়ে ছোট কর্মসপ্তাহ মেনে নিতে রাজি।
অধ্যাপক ফ্যান বলেন, কাজের উদ্দেশ্য ও জীবনের কাছে প্রত্যাশা নিয়ে তরুণদের ধারণা ভিন্ন। তিনি আরও বলেন, 'গ্রেট রেজিগনেশন' (মহামারির পর গণপদত্যাগ), 'কোয়ায়েট কুইটিং' (শুধু দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করা) এবং চীনের 'লাইং ফ্ল্যাট' (অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান) এর মতো আন্দোলনগুলো এটিই প্রমাণ করে যে এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেছে।
তিনি মনে করেন, সময়ের সাথে সাথে এই পরিবর্তনগুলো কর্মক্ষেত্রের প্রচলিত নিয়মকানুনকে পাল্টে দিতে পারে। জাপানে হিরোশি ওনো ইতোমধ্যেই কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। তিনি বলেন, জাপানের ৩০ শতাংশ পুরুষ এখন পিতৃত্বকালীন ছুটি নেন, আগে এটি ছিল প্রায় শূন্য।
ক্যারেন লো এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, “যাদের বয়স যত কম, তাদের পরিবর্তনের দাবি তত বেশি।” তার বিশ্বাস, এই পরিবর্তনের গতি বাড়ছে, "কোভিড আমাদের প্রথম বাঁকবদলের মুহূর্ত দিয়েছিলো। আমি আশা করি, পরেরটি হবে চার দিনের কর্মসপ্তাহ।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা