লকডাউন শিথিলের পর নিজেকে রক্ষা করার কৌশল

  © সংগৃহীত

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বের নানা দেশে যখন লকডাউন ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হচ্ছে, তখন মানুষের মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন একটাই: কীভাবে সংক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। বিজ্ঞানীরাও প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন এবং জবাব খুঁজে বের করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।

সমস্যা হলো, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের চিত্রটি এখনও ঠিক পরিষ্কার না। আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু তারপরও জীবিকার প্রয়োজনে লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। এর পেছনে ব্যবসায়িক মহলের যেমন চাপ রয়েছে। তেমনি সাধারণ মানুষের একাংশও ভাবতে শুরু করেছেন যে এত কঠোর বিধিনিষেধের আদৌ কোন প্রয়োজন রয়েছে কিনা। তাহলে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর নিরাপত্তার মূল শর্তগুলো কী হবে?

সবচেয়ে সুস্পষ্ট শর্ত: নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা
সেই ১৯৩০ সালে একটি গবেষণা হয়েছিল যেখানে প্রমাণ পাওয়া যায় যে কেউ কাশি দিলে তার কাশির অণুগুলো এক মিটার দূরত্বের মধ্যে হয় বাতাসে মিলিয়ে যায় নয়তো মাটিতে ঝরে পড়ে। আর সেকারণেই করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, যে কোনভাবে এক মিটার (৩.২ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

কোন কোন দেশে ১.৫ মিটার দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রিটেনসহ কিছু দেশে জনগণকে দুই মিটার দূরত্ব রক্ষা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে। এসব পরামর্শের একটাই লক্ষ্য: আপনি মানুষ থেকে যত বেশি দূরে থাকবেন, আপনি তত বেশি নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে জনঘনত্ব অনেক বেশি সেখানে এই দূরত্ব রক্ষা করা বেশ কঠিন, স্বীকার করছেন ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলছেন, সেকারণেই ঘরের বাইরে পা দেয়ার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে বেরুতে হবে। রাস্তায় চলার সময় মাস্ক, গ্লাভস, চশমা, টুপি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। “এটা ঠিক না যে এই কাজে আপনাকে দামি মাস্ক কিংবা সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করতে হবে,” বলছেন রোগতত্ত্ববিদ ড. এ. এম জাকির হোসেন, “আপনি ঘরে বসে একাধিক কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে নিতে পারেন। এবং সেগুলো ধুয়ে, শুকিয়ে বারবার করে ব্যবহার করতে পারেন।”

তবে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষাই একমাত্র চাবিকাঠি না। নিরাপত্তার দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে সময়। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত কোন ব্যক্তির সান্নিধ্যে আপনি কতক্ষণ থেকেছেন, সেই সময়টুকু। ব্রিটিশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী, সংক্রমিত ব্যক্তির এক মিটারের মধ্যে ছয় সেকেন্ড থাকার যতখানি ঝুঁকি, সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দুই মিটার দূরে এক মিনিট ধরে থাকার ঝুঁকি একই। যেখানে দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন, যেমন অফিসে আপনার কোলিগের সাথে, সেখানে লক্ষ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের সাক্ষাৎ।

বাসে, রেলে ঝুঁকি কতখানি?
লকডাউন উঠে যাওয়ার পর গণপরিবহন বাংলাদেশের শহুরে বাসিন্দাদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন। রাজধানী ঢাকার মধ্যে যারা বাসে চলাচল করেন, তাদের জন্য এটা একটা গুরুতর সমস্যা। এক্ষেত্রে ড. এ. এম জাকির হোসেনের পরামর্শ: বাসে ওঠার পর অন্যান্য যাত্রীর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে বসতে হবে। মাস্ক ছাড়া যাত্রী থাকলে তাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে মাস্ক পরা যাত্রীদের কাছাকাছি থাকতে হবে।

রেলের কামরায় যেভাবে ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির দেহ থেকে অন্যদের মাঝে ছড়ায় তার একটি বৈজ্ঞানিক মডেল।

করোনাভাইরাস মহামারি মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে, বলছেন ড. নজরুল ইসলাম। এতে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি হচ্ছে। “শহরের গণপরিবহনে সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সাইকেল লেন তৈরি করা যেতে পারে। যারা বাসে ট্রেনে উঠতে রাজি না, তারা সাইকেল ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন,” বলছেন তিনি।

মুক্ত বায়ু চলাচল
করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার আরেকটি শর্ত হচ্ছে ঘরে মুক্ত বাতাস চলাচল। বাড়ির বাইরে থাকার ঝুঁকি এক দিক থেকে কম। কারণ হলো কারও দেহের ভাইরাস বাতাসের সংস্পর্শে এলে জলীয় বাষ্পর সাথে মিশে তা ভারী হয়ে যায় এবং মাটিতে ঝরে পড়ে। তবে এর ফলে কোন সংক্রমণ ঘটবে না এটাও ধরে নেয়া কঠিন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাড়ির বাইরেও সম্ভব হলে দুই মিটার দূরত্ব রক্ষা করুন। কারও সাথে কথা বলার সময় মুখোমুখি দাঁড়াবেন না। কিন্তু ঘরের মধ্যে তাজা বাতাসের অভাব সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। ঘরের মধ্যে মানুষের সংস্পর্শ এড়ানোও কঠিন।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঝুঁকি কোথায়?
সংক্রমণ কিভাবে ছাড়ায় তা জানার জন্য চীনের কোয়াংচৌ বিশ্ববিদ্যালয় জানুয়ারি মাসে এক তদন্ত চালিয়েছে। এক মিটার দূরত্বে সাজানো টেবিলে বসে কিছু লোক দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। এদের মধ্যে একজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ছিলেন। তার মধ্যে কোন লক্ষণ ছিল না।

তার কাশি থেকে পরের দিন নয় জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ ক’জন সংক্রমিত ব্যক্তির টেবিল থেকে বহু দূরে ছিলেন। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? ভাবতে ভাবতে বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন এর জবাব: সংক্রমণ ছড়িয়েছিল এয়ারকন্ডিশনের মাধ্যমে। ভাইরাস বহনকারী কণাগুলো এয়ারকন্ডিশনের বাতাসের সাথে মিশে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে কীভাবে ভাউরাস জীবাণু এয়ারকন্ডিশন দিয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।

 

ইউনিভার্সিটি অফ অরেগনের বিজ্ঞানীরা আরেকটা গবেষণা চালিয়েছেন। এতে ঘরের কোনায় বাস এক ব্যক্তি মুখ না ঢেকে কাশি দেন যার কণাগুলো বাতাসের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষায় দেখা যায়, ভারী কণাগুলো ঐ ব্যক্তির টেবিলের ওপর ঝরে পড়ে। কিন্তু হালকা কণাগুলো ঘরের বায়ুপ্রবাহের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর।

তবে এধরনের ‘সিমুলেশন পরীক্ষা’র মানে এই না যে ঠিক এভাবেই কেউ করোনায় আক্রান্ত হবেন। এটা নির্ভর করবে, বাতাসে মিশে যাওয়ার পর ভাইরাসটি কতক্ষণ জীবিত থাকে, আপনার রোগ প্রতিরোধ শক্তি কতখানি এবং কতখানি জীবাণু আরেকজনের দেহে ঢুকে পড়তে সমর্থ হয় তার ওপর। এই গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘরে মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা গেলে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

প্লেনে চড়বো নাকি চড়বো না?
লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিরাপদ বিমান চলাচল, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিমানের ভেতরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হলে অর্ধেক সিট খালি রাখতে হবে। যেটা এয়ারলাইন্স ব্যবসার জন্য সুখবর না। অন্যদিকে, বিমানে চড়ে বসার অর্থই হবে কেবিনের মধ্যে অন্য যাত্রীদের সাথে ১৫ মিনিটের বেশি সময় আবদ্ধ হয়ে থাকা।

এই দুই বিবেচনায় বিমান ভ্রমণে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে অনেক বেশি। কিন্তু সুখবর হলো বিমানের এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেমে যে ধরনের ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয়, তা অত্যাধুনিক। এর ‘ফিলট্রেশন ব্যবস্থা’ সংক্রমণকে অনেকখানিই ঠেকিয়ে দিতে পারে।

অফিসের ভেতরে কোথায় বিপদ?
অফিস-আদালত ও কলকারখানায় নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করা বেশ কঠিন হবে। ইংল্যান্ডের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. জুলিয়ান ট্যাঙ একটি ‘সহজ শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা’ উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে আপনি জানতে পারবেন মানুষের খুব বেশি কাছে চলে এসেছেন কিনা যার মাধ্যমে আপনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন।

“আপনি যদি কারো মুখ থেকে পেঁয়াজ, রসুন কিংবা তরকারির গন্ধ পান, তবে বুঝবেন আপনি তার খুব কাছে চলে এসেছেন। তিনি প্রশ্বাসের মাধ্যমে যা ছেড়ে দিচ্ছেন, আপনি নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে তা গ্রহণ করছেন। আর গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারার মত যথেষ্ট পরিমাণ বাতাস নিয়ে নিলে বুঝতে হবে সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জীবাণুও তার প্রশ্বাসের মধ্য দিয়ে আপনার কাছে চলে আসছে,” বলছেন ড. ট্যাঙ।

একারণেই সহকর্মীদের সাথে একেবারে মুখোমুখি বসে কথা বলা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব পরামর্শ দেয়া হচ্ছে তার মূল ভিত্তি হলো এই সংক্রমণে কারো হাঁচি বা কাশি থেকে ছড়ানো ড্রপলেট বা কণিকা নাক, মুখ কিংবা চোখ দিয়ে অন্য একজনের দেহে প্রবেশ করবে। এর অন্য একটি দিক হলো বস্তুর ওপর লেগে থাকা জীবাণু হাতের স্পর্শের মাধ্যমে অন্য একজনকে সংক্রমিত করবে। সেকারণেই বার বার করে হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে এধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থার বাইরে আরেকটি দিকে বিশেষজ্ঞরা নজর দিচ্ছেন। সেটি হলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। “রোগ নিয়ন্ত্রণের একটা কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে সুস্থ দেহ,” বলছেন ডা. এ. এ. জাকির হোসেন,“নিয়মিত শরীর চর্চার পাশাপাশি ভিটামিন সি, ডি কিংবা তার পরিবর্তে সূর্যের আলোর সংষ্পর্শে আসা, এবং জিঙ্ক -এগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ভাইরাস ঢুকে পড়লেও সুবিধে করতে পারে না।”

করোনা মহামারি মোকাবেলায় ড. হোসেন একই সাথে কমিউনিটির শক্তিকে ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। তার জানা মতে, ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যার ২০% থেকে ২৫% মানুষ এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতন। তাদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কম। নজর দিতে হবে এদের বাইরে।

কিন্তু এরা কারা? সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, আইইডিসিআর-এর একজন উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলছেন, এরা হলেন ঘনবসতিপূর্ণ শহরের বিভিন্ন পকেটে বসবাসকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বস্তিবাসী। এদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ।
এখন পর্যন্ত এদের মধ্যে সংক্রমণ কম। কিন্তু কোনভাবে এদের মধ্যে সংক্রমণ বিস্তার লাভ করলে করোনাভাইরাস মহামারি বাংলাদেশে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে, বলছেন তিনি।

(তথ্য সূত্র: ডেভিড শুকম্যান, সম্পাদক, বিবিসি সায়েন্স।)


সর্বশেষ সংবাদ