চাকরিতে ‘রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই’ প্রথা এখনো বহাল, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই সংস্কার সুপারিশের

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়  © ফাইল ছবি

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই’ এখনো এক অঘোষিত বাস্তবতা। প্রার্থী বা কর্মকর্তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সম্পৃক্ততা যাচাইয়ের  প্রথা দশকের পর দশক ধরে বহাল রয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত এ তথ্যানুসন্ধানের কারণে অনেক সময় প্রার্থীরা মেধা ও যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হলেও ‘বিরূপ মন্তব্য’-এর কারণে নিয়োগ বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। এ অবস্থায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ‘রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই’ বাতিলের সুপারিশ করে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয়টি এখনোও বাস্তবায়নের তেমন উদ্যোগ নেই।

জানা গেছে, বহু বছর ধরে  ‘রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই’ প্রথা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে তীব্র সমালোচনা থাকলেও পরিবর্তন আসেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই শুধু প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট করে না, বরং যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। এমনকি এটি সরকারি প্রশাসনে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা বৃদ্ধির পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।

আরও পড়ুন: প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক’ তিন বাহিনীর প্রধানের, জনমনে কৌতূহল

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়, পরে আরও পাঁচটি যুক্ত হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।

কমিশন ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। এর চেয়ারম্যান করা হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে। প্রথমে কমিশনের সদস্য ছিল আটজন, পরে আরও তিনজন যোগ করা হয়। কমিশনকে প্রাথমিকভাবে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হলেও পরে তিন দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন তার সুপারিশ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়।

কমিশনের প্রতিবেদনে মোট ১৭টি অধ্যায় ও ১৪টি শিরোনামে দুই শতাধিক সুপারিশ দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সরকারি চাকরিতে ‘রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই’ প্রথা বাতিলের প্রস্তাব।

কমিশনের প্রস্তাবে যা আছে

প্রতিবেদনের নবম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানার প্রথা বাতিলের সুপারিশ করা হলো। কারণ জনপ্রশাসনে রাজনীতিকীকরণ এ স্তর থেকেই শুরু হয়।’

সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নিয়োগের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শুধু সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশের প্রতিবেদন চাইতে পারবে। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও প্রতিবেদন নেওয়া যেতে পারে।’

আরও বলা হয়েছে, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পাদন করবে। পাশাপাশি পাসপোর্ট, দ্বৈত নাগরিকত্ব বা এনজিওর বোর্ড গঠনসহ অন্যান্য নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যাচাই বা পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রথা বাতিল করারও সুপারিশ করা হলো।’

কমিশন প্রস্তাব করেছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এসব সুপারিশ স্বল্পমেয়াদি (ছয় মাস), মধ্যমেয়াদি (এক বছর) ও দীর্ঘমেয়াদি (এক বছরের বেশি) সময়ে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ কী

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কমিশন তার সুপারিশ প্রস্তাব করলেও বাস্তবায়নের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিভাগ ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় প্রস্তাবটি এখন কার্যত ‘ফাইলে বন্দী’ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কিছু প্রশাসনিক ক্যাডার এই প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাদের আশঙ্কা, এই ব্যবস্থা তুলে দিলে ‘রাষ্ট্রবিরোধী বা উগ্রপন্থী চিন্তাধারার’ ব্যক্তিরা সহজে প্রশাসনে প্রবেশ করতে পারে। ফলে বিষয়টি নিয়ে ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তিনটি অনুবিভাগের (নিয়োগ, প্রশাসন ও বিধি) কর্মকর্তাদের কেউই এ বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।

নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের যুগ্মসচিব রহিমা আক্তার বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এখনো এমন কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে কিছু শুনিনি।’ বিধি অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মো. মোস্তফা জামান বলেন, ‘এমন কোনো বিধিমালা তৈরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিষয়টি নতুন মনে হচ্ছে।’ একই সুরে কথা বলেছেন প্রশাসন অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মো. তৌফিক ইমাম। তিনি সংক্ষেপে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’

জনপ্রশাসনবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই প্রথা শুধু নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বৈষম্য তৈরি করছে না, বরং প্রশাসনে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। একজন মেধাবী কর্মকর্তা বা প্রার্থী তার মতামত প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, যাতে তা ‘বিরূপ’ হিসেবে ধরা না হয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি সংবেদনশীল একটি বিষয়। রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে বাস্তবায়ন কঠিন হবে। তবে প্রশাসনে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা আনতে হলে এই সংস্কার অপরিহার্য।’


সর্বশেষ সংবাদ