ভারত থেকে দূরে, চীন–পাকিস্তানের কাছে, সরকারের কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ কী?

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছে
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়েছে  © সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলের পতনের পর গত বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে দেশটির কূটনীতিতে। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয় দীর্ঘ দিনের মিত্র ভারতের সাথে।

আগের ভারতকেন্দ্রিক বৈদেশিক নীতির ধারা থেকে সরে এসে গত এক বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা দৃশ্যমান হচ্ছে। সাথে পাকিস্তানের সাথেও এক ধরণের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এদিকে, গত এক বছরে বাংলাদেশের সাথে ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে অবনতি যেমন দেখা গেছে, তেমনি সীমান্তেও সৃষ্টি হয়েছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। ভারত থেকে দফায় দফায় পুশব্যাকের ঘটনা ঘটে চলেছে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই।

কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট দেশ কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসা ছিল গত এক বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকার আগের চেয়ে অনেক প্রাকটিক্যাল হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দেশ কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে আসার কারণে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বটাও বেড়েছে।’

গত বছরের জুলাই অগাস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময় বাংলাদেশে হওয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত ও প্রতিবেদনের বিষয়টিকে অধ্যাপক ইউনূসের বড় একটি কূটনীতিক সফলতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে, নতুন মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায়আসার পর সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশ তা কীভাবে সামলায় সে নিয়েও নানা আলোচনা দেখা গেছে। তবে, মিয়ানমারে মানবিক করিডোর ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের নানা সমালােচনাও হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের কূটনীতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা সফল সে প্রশ্নও সামনে আসছে।

ভারতের সাথে সম্পর্কে শীতলতা

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত দেড় দশকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছানোর কথা বলা হতো, ২০২৪ সালের পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে পতন হয়েছে সেই সম্পর্কেরও। এবং সম্পর্কে উন্নতির বদলে ক্রমে অবনতি দেখা গেছে।

সম্পর্কের অবনতির শুরুটা হয়েছিল, বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যালঘু ও হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম অপতথ্য এবং গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখার মাধ্যমে।

সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে যখন বিচার চলছে, তখন দিল্লিতে বসে বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যও দিতে দেখা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলেছে।’

চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাথে বৈঠকের সময়ও এ বিষয়টি আলােচনা হতে দেখা গেছে। এছাড়া দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে গত এক বছরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গত এক বছরে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে।

সাথে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কড়াকড়ি করেছে ভারত। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর পর্যটন ভিসা দেয়া এক প্রকার বন্ধ আছে বলা যায়। মেডিকেল বা চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশির খুব কম মানুষকেই ভিসা দেয়া হচ্ছে। আগে চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, ভ্রমণ -এমন নানা কাজে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি ভারতে যেতেন। অথচ আগের তুলনায় ভিসা অনুমোদনের হার ৮০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে এখন। সর্বশেষ ডিসেম্বরে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার পর ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটি অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের ভারত বিরোধী একটা অবস্থানেরও প্রকাশ দেখা গেছে।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে?

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরুতে চীন সফর করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর, মার্চে তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ছিল সেই চীনে।

সেই সফরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, নদী ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, এবং দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আলোচনায় মোংলা বন্দরের উন্নয়নে কাজ করার কথা বলেছে চীন। যদিও আগে থেকেই চীন ও ভারত আলাদাভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিল।

এখন পুরো কাজটাই চীন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। সাথে ভারতে যেতে ভিসা জটিলতা তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে এখন বাংলাদেশি রোগীদের নতুন গন্তব্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে চীন। চীনের কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতালকে বাংলাদেশিদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে দেশটির সরকার।

বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের নেয়া নানা পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং নানা পেশার মানুষকে দেশটিতে সফরে নিয়ে যাওয়া। এর অংশ হিসেবে গত এক বছরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও বাম সংগঠনের নেতৃত্বকে নিজের দেশে সফরে নিয়ে গেছে চীন। অর্থাৎ ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনীতিক সম্পর্কের ঘাটতি তৈরি হওয়ার পর চীন সেই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ভারত নির্ভরশীলতা কমার কারণে ভূরাজনৈতিক কারণেই বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘চীনের কাছে অতীতেও বাংলাদেশের যে গুরুত্ব ছিল, বর্তমানেও তাই আছে। তবে ভারত নির্ভরশীলতা কমার কারণে বাংলাদেশকে আলাদা করে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। শুধু সরকার না, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও চীন আলাদা সম্পর্ক তৈরি করছে বলে মনে হচ্ছে।’

বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল সেই জায়গাটিতে আসার চেষ্টা করেছে চীন। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশও চীনের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছে, যাকে অধ্যাপক ইউনূস সরকারের কূটনীতিক সফলতা হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।

পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই একটা সংবেদনশীল বিষয় ছিল। তবে, দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে আওয়ামী লীগ আমলে, বিশেষত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রেক্ষাপটে। তবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর যেমন ভারতের সাথে সম্পর্কের শীতলতা বেড়েছে, তেমনি পাকিস্তানের সাথে জটিল সম্পর্কের বরফ গলেছে।

গত এপ্রিলে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক আনুষ্ঠানিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেড় দশক পর হওয়া এই বৈঠককে ইসলামাবাদের সাথে সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

বৈঠকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার অভিযোগে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি বিষয়ের সুরাহা চেয়েছিল বাংলাদেশ। দুই দেশের সম্পর্কের মজবুত ভিত্তির স্বার্থে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।

গত জুনে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের একটি বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় একটি জোট গঠনেরও আলোচনার খবর এসেছিল। তবে পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয় সে জোটে থাকছে না বাংলাদেশ।

গত ২৮শে জুলাই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে ফাঁকে বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টার হলেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এটিকে 'অলংকারিক' হিসেবেই দেখছেন।

অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেক বেশি রেটরিক। ভবিষ্যতে হয়তো বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সম্পর্কটা লাভবান হতে পারে। যেটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’ তবে তিনি এও বলছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি অনুসারে বিশ্বের যে কোন দেশের সাথেই স্বাভাবিক কূটনীতিক সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

 


সর্বশেষ সংবাদ