‘চাকরিতে কোটা পুনর্বহালে ফাঁকফোকর রয়েই গেছে’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫১ PM , আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৮ AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের আইন ও আদালত সমন্বয়ক জালাল আহমদ অভিযোগ করেছেন, “ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হলেও উচ্চ আদালতের যে মামলার রায়ের কারণে বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, সে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ে শেখ হাসিনা কৌশলে কিছু ফাঁকফোকর রেখেছে যাতে পরবর্তীতে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করতে পারে।
আজ বুধবার (৬ আগস্ট) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব অভিযোগ করেন।
জালাল আহমদ জানান, মামলার রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে। কিন্তু কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসতে পারলে কোটা পুনর্বহাল করার সুযোগ রয়েছে!
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবুল কালাম আজাদ, চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ছাত্র এমরান উদ্দিন, মোস্তফা আল ইহজাজ প্রমুখ।
জালাল আহমদ এ সময় অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ কোটা সংস্কার কিংবা বাতিল কোনোটাই চায়নি। আওয়ামী লীগ চেয়েছে “কোটা ব্যবস্থার” মাধ্যমে প্রশাসনে 'আওয়ামী উপনিবেশ' তৈরি করতে। তাই সবসময় আওয়ামী লীগ শিক্ষার্থীদের দাবিকে উপেক্ষা করেছিল।২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোটাধারী প্রার্থীদের অতিরিক্ত অগ্রাধিকার দেওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সৃষ্ট “কোটা সংস্কার আন্দোলন” আওয়ামী লীগ মামলা- হামলার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে সেই আন্দোলন দমন করে। তবে আন্দোলনের মুখে পিএসসি থেকে জানানো হয় যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো কোটাধারী শিক্ষার্থীরা প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ভাইভা থেকে কোটার প্রয়োগ করা হবে। এটাই ছিল ঐ আন্দোলনের সফলতা।
তিনি আওয়ামী লীগের চালাকি সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন জানিয়ে বলেন, সারা বাংলার শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার না করে রাগে ও ক্ষোভে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।সেই বছর ১১ জুলাই তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি কোটা বাতিল করবেন না! আন্দোলন থামানোর জন্য তিনি এমনিতেই কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে আবারও আন্দোলনের কারণে সেই বছর ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিলেন।তখন ই আমি আমার সহযোদ্ধাদের বলেছিলাম -শেখ হাসিনার চাল বোঝা অনেক কঠিন। তিনি আমাদের কে কোটা বাতিল করে খুশি করবে।
‘‘অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা ফিরিয়ে আনার জন্য উচ্চ আদালতে পাঠাবে। তাই আমাদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অটল থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের সহযোদ্ধাদের অনেকেই টের না পেলেও আমি ঠিকই টের পেয়েছিলাম। আমার কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে ৫ বছর ৮ মাস ১ দিন পর।”
তিনি আরো বলেন, গত বছরের ৫ জুন কোটা বাতিলের পরিপত্র সংক্রান্ত মামলায় (হাইকোর্ট রিট নাম্বার ৬০৬৩/২০২১) হাইকোর্টের বিচারপতি খিজির হায়াত এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এর দ্বৈত বেঞ্চ কোটা পুনর্বহাল করে রায় প্রদান করেন।রায় প্রদান করার সাথে সাথেই আমি হাইকোর্টে গিয়ে মামলাটির আদেশ দেখে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহযোদ্ধা নুরুল হক নুর এবং ফারুক হাসানসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে আলোচনা করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা করি।
যুদ্ধাপরাধী মামলার রায়ের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলনের রায় গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠানো রায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১০ জুলাই ওই মামলায় চেম্বার জজ আদালত স্থগিতাদেশ জারি করেন। গত বছরের ২১ জুলাই তীব্র আন্দোলনের মুখে আন্দোলনকারীদের অংশগ্রহণ ছাড়াই ২১ জুলাই ৯৩% মেধা এবং ৭% কোটা রেখে আপিল বিভাগে মামলার নিষ্পত্তি হয়।
‘‘আমি ওদিন আদালতে আপিল বিভাগে শুনানিতে উপস্থিত ছিলাম একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে। মামলাটির শুনানি সকাল ১০টায় শুরু হয়ে দুপুর ১ টা ১৫ মিনিটে শুনানি শেষ হয়। আদালতের প্রধান বিচারপতি বললেন, শুনানি ১৫ মিনিটের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৫ মিনিট পরে আবার শুনানি শুরু হবে। ১৫ মিনিটের পরের কথা হলেও বিচারপতিরা আসেন ৩০ মিনিট পর। বিচারপতিরা এসেই রায় পড়া শুরু করেন। কোন শুনানি করেনি। রায় শুনে মনে হলো শুধু মাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য এই রায় দেওয়া হয়েছিল। আদালতের এই রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যুদ্ধাপরাধী রায়ের মতো গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠানো রায় বলে মনে হয়। ২০-২৫ মিনিটে চার পাতার রায় কীভাবে লেখা সম্ভব?’’
সংবাদ সম্মেলনে তিনি সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলার ত্রুটি- বিচ্যুতি তুলে ধরে বলেন, আপিল বিভাগের দেওয়া সংক্ষিপ্ত এই রায়ে অসংখ্য ভুল এবং ফাঁকফোকর রেখেছে তৎকালীন সরকার যাতে পরবর্তী সময়ে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করতে পারে। যেমন-এই মামলায় কিছু ভুল-ত্রুটি হচ্ছে মামলার বিচার্য বিষয় ১ম এবং ২য় শ্রেণীতে কোটা পুনর্বহাল না বাতিল। সেখান ৩য় এবং ৪র্থ শ্রেণীতে সংস্কারের বিষয়ে রায় নিয়ে 'প্রশ্ন' উঠতেই পারে।
সংক্ষিপ্ত মামলার রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা বাতিল,সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে। কিন্তু কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়নি।
‘‘অতীতে আওয়ামী লীগ সংবিধানের ৫ম সংশোধনী, ৭ম সংশোধনী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলা রায়ের অপব্যবহার করেছিল।কাজেই আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসলেই এই মামলার রায় অপব্যবহার করতে পারে।’’
তিনি আরো জানান, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আপিল বিভাগের রিভিউয়ের পর আইনের আর কোন ধাপ বাকি নেই। ফলে আন্দোলন এবং আইনী লড়াইয়ের সুযোগ থাকবে না। তখন সবকিছুই হাতছাড়া হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ রিভিউতে আদালতকে ব্যবহারের মাধ্যমে কোটা পুনর্বহাল করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তিনি আরো জানান, গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে কোটা সংক্রান্ত মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দ্রুত প্রকাশ করার জন্য একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছিলাম সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আজ এক বছর পূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। এটাকে আমরা ষড়যন্ত্র বলে মনে করি। আমরা কোটা পদ্ধতির মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবিতে অটল আছি এবং থাকবো।