যে তিন কারণে কখনো বিয়ে করেননি কবি হেলাল হাফিজ

হেলাল হাফিজ
হেলাল হাফিজ  © সংগৃহীত

প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে পরিচিত হেলাল হাফিজ ৭৬ বছর বয়সে আজ পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। দীর্ঘজীবন তিনি একাকিত্বেই কাটিয়েছেন। মাত্র তিন বছর বয়সে মা হারানো হেলাল হাফিজের জীবন কেটেছে বৈরাগ্যের মাঝেই। প্রেম নিয়ে কবিতা লিখলেও কখনো সংসার করেননি তিনি। তার এ বৈরাগী জীবন বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি তিনটা ঘটনার উল্লেখ করেন, যেগুলো জগৎসংসার তার কাছে তুচ্ছ করে তোলে।

এ সম্পর্কিত এক লেখায় তিনি বলেন, ‘প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকি। ওই দিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের দিকে আড্ডা দিয়ে রাতে হলে ফিরেছি। ক্যানটিন বন্ধ। খেতে গেলাম মেডিকেল গেটের কাছে পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে মনে হলো, ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহ থাকে, ওর সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। গেলাম ফজলুল হক হলে। হাবিবুল্লাহর কক্ষে গিয়ে আমি আড্ডা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর, রাত তখন পৌনে ১০টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। আমরা হলের ছাদে উঠে দেখলাম, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।’

‘২৭ মার্চ সকালে ইকবাল হলে গিয়ে দেখি, মাঠের মাঝখানে, এখানে-ওখানে শুধু লাশ আর লাশ। নিজের কক্ষে গিয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। এখান থেকে পালাতে হবে, না হলে বাঁচা সম্ভব নয়। হলের গেটে এসে দেখি নির্মলেন্দু গুণ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, ‘আমি ভেবেছি তুমি মারা গেছো, তোমার লাশ নিতে এসেছি।’ বলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমিও সজোরে কাঁদতে লাগলাম। তারপর সেখান থেকে আমার বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলাম।’

‘এই ঘটনা আমার হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেলল। আমার তখন কেবলই মনে হতো, ওই রাতে যদি আমি ফজলুল হক হলে না গিয়ে নিজের হলে ফিরতাম, তাহলে তো বাঁচতাম না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছি—এই উপলব্ধি আমার ভেতর বিরাট বৈরাগ্য এনে দিল। এক ধরনের সন্ন্যাস জীবনযাপন শুরু করলাম আমি।’

পরের ঘটনা তিনি জানান, ‘৭৩ সালের জুনের। ১৯ জুন আমার পিতার মৃত্যু হলো। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আব্বাই ছিলেন আমার সবকিছু। তাঁর মৃত্যু প্রবলভাবে ধাক্কা দিল আমাকে। মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। আমার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।’

তৃতীয় ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পরই ঘটনা ঘটাল হেলেন, আমার প্রেমিকা। হেলেন হঠাৎ ডেকে বলল, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। সে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’ ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।’

‘এই তিনটি ঘটনা আমাকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেলল। আমার আর ঘর হলো না, সংসার হলো না, অর্থকড়ি হলো না, প্রতিষ্ঠা হলো না।’

‘এখন জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। এখন কেবলই আমার মনে হয়, জীবনের সময়গুলো বৃথাই অপচয় করেছি। কত সুন্দর সুন্দর কবিতার পঙ্​ক্তি এসেছে মাথায়, আমি টেবিলে বসিনি, লিখিনি। জীবনটা অপচয়ই করেছি বলা যায়। এ জন্য আমি এখন ভীষণভাবে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এই দীর্ঘ জীবনে যাঁরা আমাকে ভালোবেসেছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আর যাঁরা আমাকে ভালোবাসেননি, তাঁদের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাঁদের অবহেলা, অনাদর, প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণাই আমাকে কবি বানিয়েছে।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence