কোটা আন্দোলন— ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট, ২০২৪
- ফাইয়াজ উদ্দিন স্মরণ
- প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০৪:৫২ PM , আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩৮ PM
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রজনতার নেতৃত্বে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলন অন্যতম। ন্যায় অধিকার আদায়ে এ আন্দোলন ধীরে ধীরে সরকার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে সরকার দেশ ত্যাগ করেন। দুই ধাপে এই আন্দোলন হয়েছিল।
২০১৮ সাল:
২০১৮ সালে প্রথম ধাপে সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা বিদ্যমান ছিল। এ্রর মধ্য মুক্তিযুদ্ধা কোটা ৩০%, নারী কোটা ১০ %, জেলা কোটা ১০%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫% ও প্রতিবন্ধী কোটা ১% ছিল। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা আর ৪৪% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে এই বৈষম্যে দূর করতে মাঠে নামেন।
২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল ছাত্র ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ গঠন করে ৫ দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন।দাবিগুলো হলো— কোটার হার ১০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা, বিশেষ কোটার যোগ্য প্রার্থী না থাকলে তা মেধার ভিত্তিতে পূরণ, একাধিক কোটাভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ বাতিল, জেলা কোটা বাতিল ও কোটার স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রকাশ নিশ্চিত করা। এই দাবিগুলো নিয়ে নিয়মিত আন্দোলন হতো। এই আন্দোলন এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
৮ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ ও টিএসসি এলাকায় বিক্ষোভে নামে শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে শাহবাগ মোড়ে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ, জলকামান ব্যবহার ও রাবার বুলেট ছোড়ে—যার ফলে বহু শিক্ষার্থী আহত হন।
পরদিন ৯ এপ্রিল আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে। ক্লাস বর্জনের ডাক দেয় শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হয় বিক্ষোভ ও একাত্মতা প্রকাশ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশ্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কোটা বহাল ছিল ও আছে।
এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে ২০২৪ সালের ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায় (৫ জুন, ২০২৪):
চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে ২০২৪ সালের ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। এতে বলা হয়, সেই সিদ্ধান্ত আইনগতভাবে সঠিক ছিল না—অর্থাৎ কোটা পুনর্বহাল করতে হবে। এ রায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যার ফলে আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়।
ঢাবিতে বিক্ষোভ মিছিল (৬ জু্ন, ২০২৪):
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ' ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানায়।
বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি (৯ জুন, ২০২৪):
জুন মাসের মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানায়ে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টর দিকে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে একত্রিত হয়ে মিছিল নিয়ে কলা ভবন, প্রশাসনিক ভবন, উপাচার্যের কার্যালয়ের প্রবেশপথ ঘুরে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন। সমাবেশ শেষে তারা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি দেন।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক (২৯ জু্ন, ২০২৪):
কয়েক দফা আন্দোলনের পর ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ২৯ জুন শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয়
পাঠাগারের সামনে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সর্বাত্মক আন্দোলনের পূর্বে নিজেদের প্রস্তুতি হিসেবে করা এই মতবিনিময় সভায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সামনে ৪টি দাবির প্রস্তাব করেন আন্দোলনের নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ে থাকা শিক্ষার্থীরা।
.jpg)
নতুন কর্মসূচি ঘোষণা (১ জুলাই, ২০২৪):
কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকায় সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ৪ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার সব কলেজে একযোগে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় ।
চার দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাবিতে গণ পদযাত্রা, শাহবাগ অবরোধ (২ জুলাই, ২০২৪):
শিক্ষার্থীরা বেলা ৩টার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে জড়ো হতে থাকেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে’ মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত-নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাব-কাটাবন হয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন তারা। বিকেল ৪টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত তারা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করে রাখেন ।
এদিকে কোটা বহালসহ সাত দাবিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ’ রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন, (৩ জুলাই, ২০২৪):
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্ৰন্থাগারের সামনে থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দোয়েল চত্বর ও সুপ্রিম কোর্টের সামনে দিয়ে বিকেল পৌনে চারটায় শাহবাগ মোড়ে সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
'বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়' ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তাঁতীবাজার রাস্তা অবরোধ করেন।আন্দোলানে শামিল হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় আন্দোলনকারীরা।
একই দাবিতে চট্টগ্রাম খাগরাছড়ি ও রাঙামাটি মহাসড়ক অবরোধ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীরা। ট্রেন অবরোধ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ সমাবেশ জব্বারের মোড়ে রেলপথ অবরোধ করে তারা। এতে প্রায় এক ঘন্টা আটকে থাকে মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেন।
ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, (৪ জুলাই ২০২৪):
২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে আলাদা ব্যানারে মিছিল নিয়ে কোটা আন্দোলনে যোগ দেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে তারা শাহবাগে আন্দোলন করেন। তবে এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্যসেন হলের মূল ফটকে তালা দেয় ছাত্রলীগ। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে তালা খুলে দেওয়া হয়।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, কবি জসীম উদ্দীন হল ও বিজয় একাত্তর হলের মূল ফটকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীরা অবস্থান নেন। স্যার এ এফ রহমান হলে আন্দোলনে ডাকার জন্য শিক্ষার্থীদের মাইকিংয়ে বাধা দেয় ছাত্রলীগ। এদিন শাহবাগে আন্দোলন চলাকালে নেতাকর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয় ছাত্রলীগ।
সারজিস আলমকে হলছাড়া করার চেষ্টা (৫ জুলাই, ২০২৪):
আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরিতে অনলাইন ও অফলাইনে প্রচারণা চালানো হয়। ফলে অনেককেই ছাত্রলীগের তোপের মুখে পড়তে হয়। এছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সারজিস আলমকে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টার করা হয়। সারজিসকে হলছাড়া করার চেষ্টা চালাতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা (৬ জুলাই, ২০২৪):
বিকেল ৩টায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন। সেখান থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করেন। পরে মিছিল নিয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। এক ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। তবে অবরোধ প্রত্যাহারের আগে ৭ জুলাই বিকেল ৩ টা থেকে 'বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা। এছাড়া সারা দেশে বিক্ষোছ মিছিল কর্মসূচি পালন করেন তারা।
‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি (৭ জুলাই, ২০২৪):
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা। অন্যদিকে বিকেলে ৩ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে 'বাংলা ব্লকেড' কর্মসূচির শুরু হয়। পরবর্তীতে রাজধানীতে শাহবাগ সহ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।
চার দফা থেকে এক দফা (৮ জুলাই, ২০২৪):
শিক্ষার্থীরা বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে শুরু করে শাহবাগে অবস্থান নেয়। সেখানে থেকে কিছু শিক্ষার্থী ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় , কাওরান বাজার, মিন্টু রোডে অবস্থায় নেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সাইন্সল্যাবে মোড়ে অবস্থান নেয়। নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেয় ইডেন কলেজ ও হোম ইকোনমিক্স কলেজের শিক্ষার্থীরা । এদিকে চানখারপুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজগেইট মোড় , হানিফ ফ্লাইওভার অবরোধ করে অমর একুশে হল ও ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলের শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও সাড়া দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান নেয়।
কোটাবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও স্থায়ী সমাধানের দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবির পরিবর্তে এক দফা দাবির কথা বলেন। দাবিটি হলো, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করা।
সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা (৯ জুলাই, ২০২৪ ):
সরকারি চাকরিতে সব গ্ৰেডে মোট ৫% কোটা রাখার দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে।
তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন আবাসিক হলে লিফলেট বিতরণ করে।
এক মাসের জন্য কোটা বাতিল (১০ জুলাই, ২০২৪):
কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর একমাসের স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছিল আপিল বিভাগ। এদিকে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে মানুষের অংশগ্রহণ করে।
পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ (১১ জুলাই, ২০২৪):
পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সারা দেশে বাংলা ব্লকেড পালন করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা হয় । ছত্রভঙ্গ করতে শর্টগানে গুলি ও কাদানো গ্যাস প্রয়োগ করে। এসময় অন্তত ২০ জন আহত হয়।অন্যদিকে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করলে ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখা ও কোটা ইস্যুতে যৌক্তিক সমাধানের দাবিতে ছাত্রলীগ রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করে ।
কোটা পুনর্বহালের দাবিতে জুম শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন (১২ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দিনভর সতর্ক অবস্থানে ছিল ছাত্রলীগ। এদিকে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করেছে জুম শিক্ষার্থীরা। ছুটির দিনেও সারাদেশে শিক্ষার্থীরা অবরোধ চালায়। আন্দোলনে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে আন্দোলনকারীরা।
২৪ ঘন্টার মধ্যে মামলা প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম (১৩ জুলাই, ২০২৪):
কোটা বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যানবাহনে ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের উপর হামলা ও মারধরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করে পুলিশ। এদিকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মামলা প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দেয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে কোটা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাব সংগ্ৰহে ডোর টু ডোর কর্মসূচি ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ।
'রাজাকার' স্লোগানে উত্তাল ঢাবি (১৪ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কারেল দাবিতে আন্দোলনকারীরা সকাল ১১ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণপদযাত্রা শুরু করে এবং রাষ্ট্রপ্রতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিকে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সাংবাদিকের প্রশ্নর জবাবে বলেন, মুক্তিযুদ্ধার নাতিপুতিরা চাকরি পাবে নাকি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে ? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে উত্তাল হয় ঢাবি ক্যাম্পাস সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির হলে হলে 'রাজাকার' স্লোগান শুরু হয় ১০ টার দিকে। হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। মেয়েরাও হলগেইটের তালা ভেঙে মিছিলে অংশ নেয়। জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন। ঢাবির পাশাপাশি জাবি, জবি, রাবি, চবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।
ছাত্রলীগের হামলা (১৫ জুলাই, ২০২৪):
সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগ নেতারা বিভিন্ন হলে গেটে অবস্থান করে আন্দোলন যেতে বাধা দেয়। তাদের উদ্ধারে আন্দোলনকারীদের একাংশ রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে হল পাড়ার দিকে যায়। পরবর্তীতে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের চারদিকে থেকে বাইরে থেকে ভাড়া করা হেলমেট বাহিনী এনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের উপর তারা হামলা চালায়। ঢাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ ও হ্যালমেট পড়া একজনকে গুলি ছুড়তেও দেখা যায়।এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্রলীগকর্মী গিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। অন্যদিকে ঢাবি ছাড়াও চবি, ইবি, জাবি, রাবি, শবি, বেরোবিসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ হামলা চালায়।
.jpg)
রংপুরে আবু সাইদ গুলিতে নিহত (১৬ জুলাই, ২০২৪):
আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ঢাবিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পদত্যাগ করেন। দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এদিকে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
.jpg)
ঢাবি বন্ধ ঘোষণা, কফিন মিছিলে পুলিশের হামলা (১৭ জুলাই, ২০২৪):
দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি এক সিন্ডিকেট সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশে এ সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়ে ২১ জন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহতদের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৪টার পর ভিসি চত্বরে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছয়টি কফিন রেখে পূর্বঘোষিত এ গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। গায়েবানা জানাজা শেষে শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে এগোতে চাইলে সেখানে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোঁড়ে। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
সারা দেশে সংঘর্ষে নিহত অন্তত ২৭ জন (১৮ ই জুলাই, ২০২৪):
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে সুনসান নিরবতা , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখগুলোতে ব্যারিকেড বসিয়ে পাহারা দিয়েছিল পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ জরুরি কাজে যুক্ত লোকজন ছাড়া কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নি ক্যাম্পাসে।সব হলের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সারাদেশে কারফিউ জারি, ইন্টারনেট সেবা সম্পুর্ণ বন্ধ (১৯ জুলাই, ২০২৪):
ঢাবির জরুরি সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আন্দোলনকারীরা জানান, ৯ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত চলবে ‘শাটডাউন'। ১৯ জুলাই এক দিনেই নিহত হন ১৪৮ জন। এর মধ্যে ৫৪ জনকে মাথায় বা গলায় গুলি করা হয়েছিল।
নির্বাহী আদেশে ২ দিন ছুটি ঘোষণা ও শিক্ষার্থীদের আট দাবি উপস্থাপন (২০ জুলাই, ২০২৪):
নির্বাহী আদেশে ২ দিন ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এদিন তিন মন্ত্রীর কাছে আট দফা দাবি পেশ করা হয়। এ দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাসহ সারাদেশে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে, ৩১ জন নিহত হন।
কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ (২১ জুলাই, ২০২৪):
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ৫৬ % এর পরিবর্তে তা কমিয়ে ৭% নির্ধারণ করা হয়। মেধা কোটা ৯৩%, মুক্তিযুদ্ধা কোটা ৫%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ %, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১%। কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদে মেধা তালিকা থেকে পূরণের রায় দেয় আপিল বিভাগ। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে আগের মতোই কোটা বহাল থাকবে। সেই কারণে কোটার যৌক্তিক সংস্কার হয় নি বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাই উচ্চ আদালতের রায়ের পরেও আন্দোলন থেকে সরে আসে নি আন্দোলনকারীরা। তাদের দাবি , যতক্ষণ পর্যন্ত সংসদ আইন পাস করে কোটা সংস্কার ও আন্দোলনকারীদের হত্যার বিচার কাজসহ তাদের দাবিগুলো মেনে না নেওয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
কালো পতাকা বেঁধে মৌন সম্মতির আহ্বান (২২ জুলাই, ২০২৪):
চার সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আব্দুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার, রশিদুল ইসলাম রিফাতের খোঁজ পেতে ২৪ ঘন্টার সময় বেঁধে দিয়েছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা। এই সময়ের মধ্যে তাদের সন্ধান না মিললে অফিস ও বাসা বাড়ির সামনে কালো পতাকা বেঁধে মৌন সম্মতির আহ্বান জানানো হয়।
চার দফা দাবিতে সরকারকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম (২৩ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জরুরি চার দফা দাবি জানিয়ে তা বাস্তবায়ের জন্য ৪৮ ঘন্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। দাবিগুলো হলো : ইন্টারনেট চালু করতে হবে, কারফিউ প্রত্যাহার করতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সরিয়ে নিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে আবাসিক হল খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতেন হবে; সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
চার সমন্বয়কের খোঁজ পাওয়া যায় (২৪ জুলাই, ২০২৪):
দুই সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে চোখ বেঁধে ফেলে যাওয়া হয়। কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়।
আট দফা দাবি উপস্থাপন (২৫ জুলাই, ২০২৪):
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আটটি বার্তা দেওয়া হয়ে। এর মধ্যে রয়েছে হতাহতদের তালিকা তৈরি, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়ার চাপ তৈরি করা।
এসব বার্তা সংবলিত একটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন স্বমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশিদ।
হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়ক আটক (২৬ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অন্তত ৩০০ টি রুম ভাঙচুর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছ থেকে আর্থিক বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা যাবে সবকিছু মেরামত শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানান ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল। এদিকে শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসারত অবস্থায় থাকা তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সমন্বয়কদের খোঁজে ১২ শিক্ষক ডিবি কার্যালয়ে (২৭ জুলাই, ২০২৪):
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারের খোঁজে ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১২ প্রতিনিধি দল। অন্যদিকে সন্ধ্যায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়।
ডিবি কার্যালয় থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা (২৮ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরও দুই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম ও আরিফ হোসেনকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ডিবি কার্যালয়ে থাকা বৈঠক বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন এমন একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করা হয়। তবে অন্য সমন্বয়করা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
.jpg)
‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ (২৯ জুলাই, ২০২৪):
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের পরেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন তারা। সেখান থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রামে ছাত্রদের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় লাঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রীসহ বিভিন্ন রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের নারী নেত্রীরা বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণ ভবনে সাক্ষাৎ করেন। শিক্ষার্থীদের হয়রানিমূলক গ্ৰেফতার বন্ধ ও আটককৃতদের দ্রুত মুক্তির দাবিতে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাবেশ' ব্যাপারে সমাবেশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে এক সংগঠন।
চোখে মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা কর্মসূচি (৩০ জুলাই, ২০২৪):
আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় সরকারিভাবে শোক পালন করা হয়। তবে আন্দোলনকারীরা এই রাষ্ট্রীয় শোক পালনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান। তারা চোখ-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে নিজেদের অবস্থান জানান দেন।
এদিকে আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ শিক্ষার্থীকে থানা থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। এছাড়া শিক্ষার্থীরা যদি হয়রানির শিকার হন, সে ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দুইজন সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশনা দেয়। অন্যদিকে, চলমান আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'সাদা দল'।
‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি (৩১ জুলাই, ২০২৪):
৯ দফা দাবির পক্ষে সারাদেশে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন আদালত, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং রাজপথে এই কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট অভিমুখে মিছিল নিয়ে এগোলে শিশু একাডেমি এলাকায় পুলিশ তাদের পথরোধ করে এবং কয়েকজনকে আটক করে। তাদের ছাড়াতে এগিয়ে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ড. শেহরীন আমীন ভূঁইয়ার ওপর এক পুলিশ সদস্য শারীরিকভাবে আঘাত করে—তার হাত মুচড়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠে। একই দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশি বাধা, বিক্ষোভ ও আটক অভিযান চলে।
‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি পালন (১ আগস্ট, ২০২৪):
অনশনেরত অবস্থায় আটক ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তারা অভিযোগ করেন, সেখানে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তারা জানান, সেই চাপের মুখেই ২৮ জুলাই আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারা দেশে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণে শিক্ষার্থীরা ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ শিরোনামে কর্মসূচি পালন করেন। এতে সংহতি জানিয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন, মৌন মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন। এই ঘটনায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার দাবি জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
‘দ্রোহযাত্রা’ সমাবেশ (২ আগস্ট, ২০২৪):
গণগ্রেফতার বন্ধ, হত্যা ও নিপীড়নের বিচার, আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুর দাবিতে ‘দ্রোহযাত্রা’ নামক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও মানবাধিকারকর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও শ্রমজীবী মানুষেরা অংশ নেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে প্রেসক্লাব থেকে যাত্রা শুরু করে বিক্ষোভকারীরা টিএসসি হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যান এবং সেখানে অবস্থান নেন। পথিমধ্যে আশপাশের এলাকা থেকে আরও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশগ্রহণ করেন।
সরকার পতনের একদফা ঘোষণা (৩ আগস্ট, ২০২৪):
শহীদ মিনারে আয়োজিত ছাত্র-নাগরিক সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা দাবি তুলে ধরেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য হল ও ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার আল্টিমেটাম দেন। পাশাপাশি আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ জানান, ৪ আগস্ট থেকে শুরু হবে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। এদিকে চলমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে আন্দোলনকারীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন—সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার মতো কোনো পরিবেশ এখন আর নেই। অন্যদিকে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত গণভবনে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে সরকারপক্ষের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা (৪ আগস্ট, ২০২৪):
আন্দোলনকারীদের ‘মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দিয়েছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।তিনি ৫ আগস্টেই সারা দেশের ছাত্র জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, ছাত্র-জনতার বিজয় (৫ আগস্ট, ২০২৪):
এ দিন সকাল থেকেই রাজধানীর শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় জনতার ঢল নামতে থাকে। যদিও সকালবেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ও বিধিনিষেধ আন্দোলনকারীদের রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দুপুর গড়াতেই চিত্র পাল্টে যায়। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, টিএসসি ও শাহবাগ চত্বরে। এ দিকে গণঅভ্যুত্থানের জেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা গনভবন ত্যাগ করেন। দুপুরের পর পরই শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।