তৌকির-ফাহিমের কী হবে?

সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের দুই ছেলে
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের দুই ছেলে  © সংগৃহীত

বিকেলের রোদটা যেন সেদিন একটু বেশি ধূসর ছিল। গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন আর ফিরবেন না; এই সত্যটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাঁর দুই সন্তান, তৌকির ও ফাহিম। মাত্র পাঁচ ও তিন বছর বয়স তাদের। বয়সটা এমন, যখন বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়ার কথা, প্রথম ঈদে নতুন পাঞ্জাবি পড়ে বাবার সঙ্গে মসজিদে যাওয়ার কথা। অথচ এই বয়সেই তাদের শিখতে হচ্ছে; বাবা আর নেই, বাবা ফিরে আসবে না।

পিতা হারানোর বেদনায় স্তব্ধ দুটো শিশুমুখ তৌকির ও ফাহিম। পাঁচ বছরের তৌকির এখনো ভাবে, বাবা শুধু বাইরে গেছেন, বিকেল হতেই ফিরবেন। তিন বছরের ছোট ভাই ফাহিমও চায় বাবার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াতে, আবার শুনতে চায় সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর।

তুহিনের মৃত্যুর সংবাদ প্রথম যখন আসে, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, এতটা নির্মম হতে পারে এই পৃথিবী। গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রকাশ্য  কুপিয়ে এবং জবাই করে হত্যা, এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়, বাস্তব। যে মানুষটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতেন, সাহসের সঙ্গে সত্য তুলে ধরতেন, তার জীবন এমন নৃশংসভাবে কেড়ে নেওয়া হবে, তা ভাবা যায় না। কিন্তু আরও বেশি হৃদয়বিদারক যে বিষয়টি; তিনি রেখে গেছেন দুটো নিষ্পাপ শিশু, যাদের জীবনের আশ্রয় ছিল সেই বাবাই।

তৌকির আজও মায়ের কাছে প্রশ্ন করে ‘মা, বাবা কোথায়?’ ছোট্ট ফাহিম কেবল জানে, বাবা কাজ করতে যান। তার এখনো বোঝার বয়স হয়নি, কবরের মানে কী। তারা জানে না, তাদের বাবা এখন নিথর, শুয়ে আছেন মাটির গভীরে, যেখানে থেকেও তিনি আর কখনও বলতে পারবেন না, ‘আমার রাজপুত্র কেমন আছো?’ এই শূন্যতা, এই বিষণ্নতা তাদের ছোট্ট মন বুঝে না, কিন্তু তারা টের পায়। বাবার ঘরটা এখন সবার চোখে খালি, কিন্তু তাদের চোখে ভাঙা স্বপ্নের মরুভূমি।

আসাদুজ্জামান তুহিন শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগ্রামী মানুষ, একজন পিতা, একজন স্বামী, একজন বন্ধু। তার মৃত্যুতে পরিবার হারিয়েছে তাদের জীবনের মূল ভরসাকে। এখন প্রশ্ন উঠছে এই দুই শিশুর ভবিষ্যৎ কী হবে? কে হবে তাদের পথচলার সাথী, কে দেবে তাদের শিক্ষার খরচ, বেঁচে থাকার নিরাপত্তা, আর একটু হাসির জায়গা?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নিন্দার ঝড়, কিন্তু এদের ক্ষুধার জবাব কী হবে? তাদের অসুস্থ হলে হাসপাতাল নিতে কে যাবে? ঈদের সকালে নতুন জামা কিনে দেবে কে? এ প্রশ্ন এখন আর শুধু একটি পরিবারের নয়; এটি রাষ্ট্রের, সমাজের, আমাদের সকলের।

সাংবাদিক সমাজ ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়িয়েছে, তুহিনের পরিবারের জন্য সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সাময়িক সহানুভূতি নয়, প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনই নিশ্চিত করতে হবে শহীদ সাংবাদিকদের পরিবারের ভবিষ্যৎ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে একটি স্থায়ী কল্যাণ তহবিল গঠন করা, যার আওতায় এমন পরিবারগুলো নিয়মিত সহায়তা পাবে। তৌকির ও ফাহিম যেন না হয় আরেকটি ‘সংবেদনশীল স্টোরি’র চরিত্র; তাদের গল্প যেন বদলায়, নতুন সম্ভাবনার দিকে।

সমাজের কাছে তুহিনের স্ত্রীর একটাই অনুরোধ এই দুটি শিশুর জন্য ভালোবাসা আর সহানুভূতির পাশাপাশি বাস্তব সহায়তা চাই। আমরা কি পারি না, এই দুই শিশু যেন অন্তত মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তাদের বাবার মতো সাহসী, মানবিক, সত্যবাদী হয়ে।


সর্বশেষ সংবাদ