‘সি’ ক্যাটাগরির যোদ্ধা, ‘এ’ ক্যাটাগরির অপরাধী!
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৫, ১০:০৮ PM , আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০১:১১ PM
২০২৪ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষে বহু আন্দোলনকারী আহত হন। আন্দোলনে আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে সরকার ‘জুলাই যোদ্ধা’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই প্রেক্ষিতে সরকারিভাবে তিনটি ক্যাটাগরিতে ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকা প্রকাশ করা হয়। ক্যাটাগরি ‘এ’-তে গুরুতর আহত, ক্যাটাগরি ‘বি’-তে মাঝারি আহত এবং ক্যাটাগরি ‘সি’-তে সামান্য আহতদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। এ তালিকার ‘সি’ ক্যাটেগরিতে স্থান পান বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সাবেক (বহিষ্কৃত) যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপু।
চলতি বছরের ৩ মার্চ প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী, জানে আলম অপু তালিকার ‘সি’ ক্যাটেগরির গেজেটে ৯২ নম্বরে রয়েছেন। তার মেডিকেল কেস আইডি ৩৬১০৪। এ গেজেটের মাধ্যমে তিনি একটি আনুষ্ঠানিক জুলাই যোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেন। আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকায় আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে সামান্য আহত হন। পরে আন্দোলনের সময়কার চিকিৎসাপত্রের নথি ও অন্যান্য বর্ণনা অনুযায়ী সরকার তাকে ‘ক্যাটাগরি সি’ অর্থাৎ সামান্য আহত হিসেবে ‘জুলাই যোদ্ধা’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
তবে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার কয়েক মাসের বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) দাপট ও জুলাই যোদ্ধার প্রভাব খাটিয়ে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে শো-অফ এবং এসবের প্রভাব বিস্তার করে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করতেন তিনি। এছাড়াও রয়েছে চাঁদাবাজি ও পরীক্ষায় প্রবেশপত্র জালিয়াতি করার মতো গুরুতর ঘটনা।
‘অপুর সহপাঠীরা ইতোমধ্যে অনার্স সম্পন্ন করলেও সে এখনও তৃতীয় সেমিস্টার শেষ করতে পারেনি। শিক্ষার্থী হিসেবে অপুকে কখনো মনোযোগী মনে হয়নি। বেশিরভাগ পরীক্ষায় সে অনুপস্থিত থাকত, আর যে ক’টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত, সেগুলোর ফলাফলও সন্তোষজনক না।’ শিক্ষক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি
অপুর বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা জানে আলম অপু; যদিও এর চেয়ে তার শো-অফই বেশি ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন নেতা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ছবি শেয়ার করা ছিল তার অনেকটা নিত্যনৈমিত্যিক কাজ। তারা জানান, আন্দোলন চলাকালে ২০২৪-এর ১৭ জুলাই পায়ে আঘাত পান অপু। সে সময় তার জন্য ফান্ডিংও সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে করা যায়, এমন কোনো অপরাধ নেই যে অপু করেননি। সর্বশেষ ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে গুলি করার হুমকি দিতে চেয়েছিলেন অপু; যার একটি অডিও রেকর্ডও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও ক্লাসে অংশ না নিয়েও জোর করে পরীক্ষায় বসা, কর্মকর্তা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিয়মিতভাবে নেতিবাচক প্রচারণা ছিল তার রেগুলার রুটিন-ওয়ার্ক। সূত্রের তথ্য, জুলাই যোদ্ধা হিসেবে গেজেটেডভুক্ত হওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধাও (সেমিস্টারের বকেয়া ফি মওকুফ) নিতে চেয়েছিলেন অপু। প্রশাসন তাতে রাজি না হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে বিবৃতিও দিয়েছিল জানে আলম অপু।
এদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সাবেক এই নেতার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেকর্ড ঘেঁটে মিলেছে হতাশাজনক চিত্র। ২০২১ সালে প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেও গত চার বছরেও তিনি দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করতে পারেনি। সূত্রে জানা গেছে, চার বছরে অপু মোট ৩২টি কোর্সের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেন। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন মাত্র ১৮টি কোর্সে। বাকি পরীক্ষাগুলো তিনি অংশগ্রহণ করেননি। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৮টি কোর্সের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, জানে আলম অপু ৪টি কোর্সে সম্পূর্ণভাবে অকৃতকার্য হয়েছেন। এছাড়া ৬টি কোর্সে তিনি পেয়েছেন ‘সি’ গ্রেড। কেবল ৮টি কোর্সে তিনি ‘বি’ গ্রেড পেলেও ১৮টি কোর্সের কোনটিতেই ‘এ’ গ্রেড বা তার ওপরে যেতে পারেননি তিনি।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে (গ্রিন ইউনিভার্সিটি) এডমিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় এক সেমিস্টার বহিষ্কার হন অপু। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে এডমিট কার্ড জালিয়াতির মত ঘটনা কখনও ঘটেনি, যেটা জানে আলম শুরু করেন। এছাড়া ২০২৪ সালের ১২ জুন রাস্তা আটকে বাস ভাঙচুর ও অসদাচরণের কারণে গ্রিন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জানে আলম অপু গেজেটভুক্ত আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে টিউশন ফি মওকুফের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকৃত। গত ৫ মার্চ এ বিষয়ে প্রকাশিত গেজেট এবং তৎপরবর্তীতে জানে আলমের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ও যথাযথভাবে কার্যকর করে। কিন্তু জানে আলম তা না মেনে পূর্ববর্তী বকেয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং সেগুলোকেও ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে মওকুফ পাওয়া টিউশন ফি সুবিধায় আনার অযৌক্তিক দাবি তুলেন; যা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গ্রিন ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক বলেন, ‘অপুর সহপাঠীরা ইতোমধ্যে অনার্স সম্পন্ন করলেও সে এখনও তৃতীয় সেমিস্টারও শেষ করতে পারেনি। শিক্ষার্থী হিসেবে অপুকে কখনো মনোযোগী মনে হয়নি। বেশিরভাগ পরীক্ষায় সে অনুপস্থিত থাকত, আর যে ক’টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করত, সেগুলোর ফলাফলও সন্তোষজনক ছিল না। আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে অপু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করত। এসব করতে নিষেধ করায় একাধিক শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার অশোভন আচরণ করেছে।’
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপত্র জালিয়াতির মূল হোতা ছিলেন অপু, ছবি ছিল রিয়াদের চাঁদাবাজির অস্ত্র
সম্প্রতি সমন্বয়ক পরিচয়ে রাজধানীর গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে রিয়াদ ও জানে আলম অপুর নেতৃত্বে একদল যুবক। শাম্মী আহমেদ দেশের বাইরে থাকায় তার স্বামী সিদ্দিক আবু জাফরকে জিম্মি করে তারা। ১৭ জুলাই সকালে বাসায় গিয়ে মব সৃষ্টি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা নিয়ে আসে চক্রটি। পরে শনিবার সন্ধ্যায় ফের গুলশানের ওই বাসায় চাঁদার টাকা আনতে গিয়ে গুলশান থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন পাঁচ চাঁদাবাজ। একই ঘটনায় পলাতক থাকা গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক জানে আলম অপুকে ওয়ারী থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২৬ জুলাই চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয় জানে আলম অপুর বিরুদ্ধে। সেদিনই গুলশান থানায় ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন শাম্মীর স্বামী আবু জাফর। মামলার দুই নম্বর আসামি করা হয় অপুকে।