প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মনপুরা

দ্বীপ ভোলার মনপুরা
দ্বীপ ভোলার মনপুরা  © টিডিসি ফটো

তিনদিকে প্রবল মেঘনার ঢেউ আর একদিকে বিশাল বঙ্গোপসাগর—এই দু’য়ের মাঝে ভেসে থাকা দ্বীপ ভোলার মনপুরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরন্ত সম্ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ দ্বীপ যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি। এখানে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অপূর্ব সুযোগ আছে। হরিণ, বানর আর সাগরপাড়ের অবারিত সৌন্দর্য প্রতিবছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। কিন্তু পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগ অবকাঠামোর নাজুক বাস্তবতা, সঙ্গে দস্যুতার ভীতিকর থাবা সব মিলিয়ে দ্বীপবাসীর জীবন যেন প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আর দুর্ভোগের নামান্তর।

প্রায় তিনশ বছর আগে জেগে ওঠা এ দ্বীপ একসময় পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল। পরে এক জেলে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে তাঁর নামানুসারে দ্বীপের নাম হয় ‘মনপুরা’। ১৯৮৩ সালে দ্বীপটি উপজেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে পাঁচটি ইউনিয়নে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস।

তবে এতো মানুষের জীবনপ্রবাহ কেবল নৌযাননির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন সকাল ১০টায় মনপুরা থেকে তজুমুদ্দিনের উদ্দেশে সি-ট্রাক ছেড়ে যায়, আবার বেলা ৩টায় তজুমুদ্দিন থেকে ফেরে। ঢাকা-মনপুরা-হাতিয়া রুটে নিয়মিত এমভি ফারহান ও এমভি তাসরিফ লঞ্চ চলাচল করে। কিন্তু একটু খারাপ আবহাওয়া হলেই সব রুট বন্ধ হয়ে দ্বীপ পুরোপুরি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট মাছ ধরার ট্রলারে যাতায়াত করতে হয় স্থানীয়দের।

মনপুরায় একটি আধুনিক ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও জনবল সংকটে তা কার্যত অকার্যকর। বছরে এক-দুজন চিকিৎসক দিয়ে পুরো উপজেলা চালানো হয়। ল্যাব না থাকায় রোগ নির্ণয়ও সম্ভব হয় না; ফলে রোগীদের মেঘনার উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে ভোলা জেলা হাসপাতালে যেতে হয়। অনেক সময় নৌযাত্রায় প্রাণ হারান রোগীরা।

অবহেলিত স্বাস্থ্যসেবার কারণে দ্বীপবাসীর বড় অংশ আজও ঝুঁকছেন তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁক ও ভণ্ড চিকিৎসকের কাছে। চরাঞ্চলে অবস্থা আরও ভয়াবহ। উপজেলা সদরে দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ মেলে জেনারেটরের মাধ্যমে। বাকি সময় দ্বীপ অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে। গ্রামাঞ্চলে কিছু মানুষ সোলার প্যানেলের ওপর নির্ভরশীল, তবে খারাপ আবহাওয়ায় টানা দুই-তিন দিন বাতিও জ্বলে না। যদিও দ্বীপে ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মিনি সোলার গ্রিড স্থাপন করা হয়েছে, তা পুরো চাহিদা মেটাতে অপ্রতুল। বিদ্যুৎ না থাকায় কলকারখানা গড়ে ওঠেনি, ফলে কর্মসংস্থানের পথও রুদ্ধ।

মৎস্য শিকার ও কৃষিকাজ দ্বীপবাসীর প্রধান জীবিকা। কিন্তু এ কাজে স্বাধীনতা নেই। মেঘনায় মাছ ধরতে হলে স্থানীয় দস্যু বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। এমনকি দস্যুদের কাছ থেকে ‘টোকেন’ সংগ্রহ না করলে জাল, মাছ সব লুট করে নেওয়া হয়। চাঁদা না দিলে জেলেদের হামলার শিকার হতে হয়, অনেককে অপহরণ করে হাতিয়ার গভীর বনে আটকে রাখা হয়। পরে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে মুক্তিপণ দিলে ছাড়া মেলে।

কৃষিকাজেও দস্যুদের কবল। চরাঞ্চলে ধান চাষ করতে হলে প্রতি দাগে এক মণ ধান দিতে হয়। নির্দিষ্ট চাহিদা অনুযায়ী না দিলে কৃষককে অপহরণের শিকার হতে হয়।

মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান কবির জানান, ‘জেলে বা আড়তদাররা হামলার বিষয়টি থানায় আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় না। আমরা খবর পেলে অবশ্যই অভিযান চালাই।’

মনপুরার ইতিহাস ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভরা। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে গোর্কির আঘাতে দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ মারা যান। এর পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ট্রলারডুবির ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। যথেষ্ট আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় আজও ঝুঁকির মধ্যে বাসিন্দাদের জীবনযাপন করতে হয়।

প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে ভরপুর মনপুরায় আছে বিশাল সমুদ্রসৈকত, হরিণের ঝাঁক ও বানরের দল। একই স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার আকর্ষণ পর্যটকদের টানে। তবে থাকার জায়গা ও মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটন খাত বিকশিত হয়নি। ফলে সম্ভাবনার দ্বারও এখনও অর্ধেক খোলা।

মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে মিনি গ্রিড চালু আছে, সাবমেরিন কেবল দিয়েও বিদ্যুৎ আনার উদ্যোগ চলছে। স্বাস্থ্যসেবায়ও উন্নয়নকাজ চলছে।’

তবে বাস্তবতা হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার হওয়া সত্ত্বেও দস্যুতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে আজও বন্দি মনপুরার মানুষ। উন্নয়ন যদি টেকসইভাবে বাস্তবায়ন হয়, তবে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ একদিন দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ