করোনার প্রভাব
হতাশ চাকরিপ্রার্থীরা, আয়-উপার্জনের ভিন্ন পথ খুঁজছেন অনেকেই
- আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২১, ০৯:১২ AM , আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২১, ০৯:৪১ AM
২০১৯ সালে চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন সানজিদা ফারহানা বীথি। স্বপ্ন ছিলো ব্যাংকার হওয়ার। এজন্য বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদনও করেছিলেন তিনি। কিন্তু সর্বনাশা করোনা সেই স্বপ্নের পথে পুরোটাই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বীথি জানান, করোনায় সরকারি চাকরিতো দূরের কথা অনেক বেসরকারি কোম্পানি থেকেও কর্মীদের ছাটাই করার নজির দেখা গেছে। এ অবস্থায় ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে উপার্জনের ভিন্নপথ ভাবতে থাকি। একপর্যায়ে পেশা হিসেবে শুরু করি রান্নাবান্নার কাজ।
তিনি আরও বলেন, হোটেল ম্যানেজমেন্টেও কিছু কোর্স করেছি আমি যেগুলো আমাকে সামনে আগাতে সাহায্য করেছে। কোর্স করায় আমি কুকিং ব্যবসা শুরু করতে পেরেছি।প্রথমে আমি অনলাইনে একটি পেজ খুলে সেখানে বিভিন্ন সিগনেচার ডিস নিয়ে 'অনলাইন ফুড বিজনেস' শুরু করি। ধীরে ধীরে আমার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। চাকরির আশায় বসে থাকলে হয়তো জীবনটা অনর্থক হয়েই থাকতো। জীবনে তাই শুধু একক স্বপ্ন নিয়ে পড়ে থাকা উচিত না। আমার এখন স্বপ্ন আমার কুকিং ব্যবসাকে আরও অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বীথির মতো উচ্চশিক্ষা শেষ করা দেশের অনেক শিক্ষার্থীরা বিপর্যয় কিংবা সংকট এড়াতে উদ্যোক্তা হতে চাইলেও নানান প্রতিবন্ধকতা যেন পিছু ছাড়ছেনা। কারণ অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। এসব পরিবারে সন্তানের প্রতি একটি বিশেষ চাহিদা থাকে বাবা-মায়ের। সন্তান যেন দ্রুত লেখাপড়া শেষে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরতে পারে। কিন্তু করোনায় সরকারি চাকরি হয়ে উঠছে 'সোনার হরিণ'।দ্বিগুণ হারে বাড়ছে বেকারত্ব।
চাকরি না পেয়ে হতাশা, মানসিক অবসাদ , পারিবারিক ও সামাজিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আবার আত্নঘাতী হয়ে উঠছে। করোনায় চাকরির বাজারের এমন সংকট ভুগিয়ে তুলছে লাখ লাখ তরুণকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারি চাকরির বাজারে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। সরকারি চাকরির এমন সংকট তরুণদের হতাশ করে তুলছে। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষা শেষে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী সরকারি চাকরির প্রত্যাশা করে। কিন্তু চাকরির বাজারে এমন অন্ধকার দুঃসময় বেকারত্ব সমস্যা দ্বিগুণ করে তুলছে। তরুণদের যে কর্মসংস্থানের সংকট বা বেকারত্ব বাড়ছে এক্ষেত্রে সঠিক প্রণোদনার মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেইসাথে দেশের বেসরকারি শিল্পপতিদের তরুণদের বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে৷ বেকারত্ব সমস্যা যদি আরো প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে হতাশায় তরুণদের আত্নহত্যা, মাদকাসক্তিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকবে যা সমাজ ও দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজে পড়া অনার্স ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শেখ রাফায়েত বলেন, আমি এখনো অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র অথচ আমার স্নাতক শেষ হওয়ার কথা ছিল আরও অনেক আগে। করোনায় সব থমকে আছে।অন্যদিকে সময় যত গড়াচ্ছে ততই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। কারন স্নাতক শেষ না হওয়ায় এই মুহুর্তে কোন চাকরির পরীক্ষাও দিতে পারছিনা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এমতাবস্থায় আমি সহ আমার পরিবার খুবই অসহায়। পরিবার আমার উপর ভরসায় আছে,আর আমি সরকারের উপর।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী শারমিন আখতার রিমা বলেন, সরকারি চাকরির জন্য বয়স পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু করোনায় কারণে এখনো স্নাতক পাস করতে পারিনি ।ফলে দিন দিন হতাশা বাড়ছেই কারণ উপার্জনের পথ তৈরি না হওয়ায় পরিবারের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে পড়াশোনার স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতিও আগের মতো নেই।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে পড়ুয়া শিক্ষার্থী রিয়াজ উদ্দিন রাসেল বলেন, অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষার জন্য আবেদন ফরম পূরণ করেছিলাম কিন্তু একমাত্র ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো চাকরির পরীক্ষাই দিতে পারিনি। অনিশ্চয়তা ও হতাশায় সরকারি চাকরির আশা ছেড়ে তাই ব্যবসা শুরু করেছি। কারণ যেখানে চাকরির পরীক্ষাই দিতে পারছি না সেখানে চাকরি হওয়াতো পরের বিষয়।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী করোনার আগে বেকারত্বের সংখ্যা ২৭ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আবার যখন শ্রমশক্তি জরিপ করবে, তখনই জানা যাবে বেকারত্ব নিয়ে নয়া তথ্য। তবে সরকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২৭ লাখই থাকবে। কিন্তু করোনাকালে পাল্টে গেছে বেকারত্বের চিত্রপট। উচ্চশিক্ষিত তরুণ বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে বেকারত্ব বৃদ্ধির ভয়াবহ রূপ।
বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) হিসেবে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। করোনা মহামারীতে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, এই তরুণদের সবাই পূর্ণকালীন কাজে নিয়োজিত থাকলে বাংলাদেশে করোনাকালে বেকারের সংখ্যা হতো অন্তত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার জন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনাকালে চাকরির সংকট তরুণদের হতাশ করে তুলছে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকরি প্রত্যাশি লাখ লাখ তরুণ চাকরি না পেয়ে হতাশা, মানসিক চাপ এবং গ্লানিতে ভুগছেন। তরুণদের যে কর্মসংস্থানের সংকট বা বেকারত্ব বাড়ছে এক্ষেত্রে প্রণোদনার মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সরকার চাইলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ যেসব সম্পদ রয়েছে সেগুলোকে মাথায় রেখে সেটা ভিত্তিক বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, দেশের তরুণদের মেধাশক্তির যেন অপচয় না ঘটে সেজন্য তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে যারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী তাদের সাহায্য করতে পারলে বেকারত্ব সমস্যা কিছুটা দূর হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশের বেসরকারি শিল্পপতিদেরও তরুণদের বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে৷ সরকার কর্তৃক তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে তরুণদের কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্য। দেশের জনসংখ্যার সিংহভাগই তরুণ। তরুণদের কর্মমুখী স্রোতে আনার জন্য সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।