সেক্টরভিত্তিক দক্ষ গ্রাজুয়েট না থাকায় বাড়ছে বেকারত্বের ফাঁদ

গ্রাজুয়েট থাকলেও নেই দক্ষতা
গ্রাজুয়েট থাকলেও নেই দক্ষতা  © ছবি সম্পাদনায়: আমান উল্যাহ আলভী

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন। কিন্তু সরকারি বেসরকারি উচ্চশিক্ষালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারি গ্রাজুয়েটদের সংখ্যার সাথে থাকে না বাজারে তৈরি হওয়া কর্মসংস্থানের আনুপাতিক সমন্বয়। ফলে প্রতি বছরই নতুন করে বাড়ছে বেকারত্বের হার। আবার স্ট্রাটেজিক কর্মী সাপ্লাইয়ে সেক্টরভিত্তিক দক্ষ কর্মীর বড় সংকট রয়েছে।

কিন্তু বছর প্রতি কত গ্রাজুয়েট স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে? কোন সেক্টরে সংখ্যা কত? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ সংক্রান্ত তথ্য আংশিক থাকলেও সরকারি বিভিন্ন উচ্চশিক্ষালয়ের কোনো তথ্য নেই উচ্চশিক্ষার তদারক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কাছে। এমনকি প্রতি বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক গ্রাজুয়েট তৈরির হারেরও কোনো তথ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। প্রতি বছর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করলেও সেখানেও বিষয়গুলোর উল্লেখ থাকে না। ফলে কর্মক্ষেত্রের চাহিদা পূরণে থেকে যাচ্ছে বড় দুর্বলতা।

সেক্টরভিত্তিক দক্ষ জনবল না থাকায় বাড়ছে বেকারত্ব

২০২২ সালে প্রকাশিত ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ডিগ্রিভিত্তিক শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৪২ লক্ষ ৭ হাজার ৮০০। এর মধ্যে স্নাতক সম্মান ও স্নাতক পাস মিলিয়ে ৩৮ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪ জনের তথ্য পাওয়া যায়। তবে কোন সাবজেক্ট থেকে কত শিক্ষার্থী বের হচ্ছেন এবং প্রতি বছর জব মার্কেটে কত গ্রাজুয়েট প্রবেশ করছে— এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।

‘আমাদের জানতে হবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিচ্ছেন তারা কোথায় যাচ্ছেন? পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনার থাকাটা জরুরি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং পরিসংখ্যান না থাকায় একদিকে আমরা মানসম্মত গ্রাজুয়েট পাচ্ছি না, একইসাথে সেক্টরভিত্তিক কর্মীর সংকটও পূরণ হচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মী সাপ্লাইয়ে কোন জায়গায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে সেটাও নির্ণয় করতে পারছি না— অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, আহ্বায়ক, শিক্ষা অধিকার সংসদ

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের পরিচালক ড. ফেরদৌস জামানের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর কত শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন এই তথ্য ইউজিসি এর আগে প্রকাশ করেনি। সেক্টরভিত্তিক কোনো তথ্যও নেই। আমরা পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে কাজ করবো।’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান জানান, ‘এ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে মন্তব্য করতে পারব।’

আরও পড়ুন: পদোন্নতিতে ‘ইতিহাসের সেরা’ অনিয়ম ইউজিসিতে

ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২ সালে ১১০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার ৯৮ জন। ২০২২ সালে ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭২ হাজার ৪০৬ জন। কিন্তু কোন সাবজেক্ট থেকে কত শিক্ষার্থী ডিগ্রি নিয়েছেন এ বিষয়েও নেই কোনো তথ্য। ফলে সেক্টরভিত্তিক কত গ্রাজুয়েট প্রতি বছর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন সে বিষয়ে অন্ধকার কাটছে না।

সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় কী ধরণের জটিলতা তৈরি হচ্ছে— এ প্রসঙ্গে কথা বলেন শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ; যিনি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মোনাশ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রফেসরিয়াল ফেলো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে অধ্যাপক নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় ঘাটতি হল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং পরিসংখ্যান না থাকা। প্রায় সব দেশেই এডুকেশন প্লানিং খুব শক্তিশালী। আমরা এখনও এসব বিষয়ে অনেক পিছিয়ে। বিজনেস কমিউনিটির বড় একটা অভিযোগ হলো, যে-সব সেক্টরে কর্মীর প্রয়োজন সেখানে পর্যাপ্ত কর্মী আসছে না। স্ট্র্যাটেজিক সেক্টরে প্রচুর কর্মীর সংকট রয়েছে। আবার যে-সব গ্রাজুয়েটরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন তাদের পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই, থাকলেও সেটা মানসম্মত নয়।’

অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, আহ্বায়ক, শিক্ষা অধিকার সংসদ

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আমাদের জানতে হবে যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিচ্ছেন তারা কোথায় যাচ্ছেন? পাশাপাশি আমাদের শিক্ষা নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনার থাকাটা জরুরি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং পরিসংখ্যান না থাকায় একদিকে আমরা মানসম্মত গ্রাজুয়েট পাচ্ছি না, একইসাথে সেক্টরভিত্তিক কর্মীর সংকটও পূরণ হচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মী সাপ্লাইয়ে কোন জায়গায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে সেটাও নির্ণয় করতে পারছি না। কাজেই প্রতি বছরের সমীক্ষায় কত সংখ্যক গ্রাজুয়েট বাজারে আসছে এই পরিসংখ্যান এবং কর্মক্ষেত্রে তৈরি হওয়া কর্মীর চাহিদা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকাটা সমেয়ের দাবি।’

বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকধারীদের সংখ্যা কম হওয়ার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে
বাংলাদেশে বর্তমানে কত সংখ্যক বেকার রয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী— ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায় থেকে স্নাতক  ডিগ্রিধারী বেকারদের সংখ্যা ছিল নয় লাখ ছয় হাজার। এক বছর আগে এই সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৯৯ হাজার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুসারে, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার এক বছর আগে ১২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে বেড়ে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

আরও পড়ুন: ‘স্বতন্ত্র পরিচয়ে’ সাত কলেজ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে?

সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া ৩৯৭ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারের গতিপ্রকৃতিতে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে গত বছর ভর্তি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ১০ লাখ। এটি মোট শিক্ষার্থীর ৬৮ শতাংশ। বাকি ৩২ শতাংশ ১১৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন।

শ্বেতপত্রে বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান, ২৪ শতাংশ বাণিজ্য ও ১২ শতাংশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) নিয়ে পড়ছেন। ফলে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকধারীদের সংখ্যা কম হওয়ার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ছে।

কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পায়, তাকে আর বেকার হিসেবে ধরা হয় না। আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজপ্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তি বেকার হিসেবে ধরা হবে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা। মূলত এই সংজ্ঞার কারণেই বাংলাদেশে বেকার কম।

কারিগরি সেক্টরে চাহিদার তুলনায় জনবল নেই

সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের তালিকায় উপরে রয়েছে টেক্সটাইল, কারিগরি, এনজিও, সফটওয়্যার, পর্যটন, আইটি এবং ভারী শিল্প খাতের উৎপাদন সেক্টরের মতো খাতগুলো। যদিও এসব সেক্টরে যোগ্য জনবল কতটা তৈরি হচ্ছে? তৈরি হওয়া জনবলের দক্ষতা কতটা রয়েছে সেটা অজানা। এসব সেক্টরে যে ধরনের পেশাগত দক্ষতা চাওয়া হয়, বেশিরভাগ চাকরিপ্রার্থীর সে রকম দক্ষতা থাকে না। যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী না থাকায় এই সেক্টরগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে কাজ করেন। ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে বেরিয়ে যায়। অনেক সময় কর্মীর অভাবে ফাঁকা থাকছে পদগুলো। 

দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, এ বিষয়ে সঠিক কোনো বাস্তবিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। গত এক বছরে সেক্টরভিত্তিক কী পরিমাণ পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন সেক্টরে এর পরিমাণ কত? এমন একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় দেশের নেতৃস্থানীয় বেসরকারি ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট সাইট বিডিজবস.কম থেকে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের কাছে গত এক বছরে প্রায় ৮৫ হাজার চাকরির বিজ্ঞাপন এসেছে। প্রায় ১৮ হাজার কোম্পানির দেয়া এসব বিজ্ঞাপনে প্রায় ৪ লক্ষ পদের তথ্য আসে।

এসব চাকরির বিজ্ঞাপনের মধ্যে— সব থেকে বেশি ফাঁকা পদের বিজ্ঞাপন আসে ট্যুরিজম সেক্টর থেকে। এরপরেই রয়েছে আইটি সেক্টর। এছাড়াও এনজিও, ই কমার্স ও এফ কমার্স, গার্মেন্টস এবং ভারী শিল্প কারখানার মতো সেক্টরগুলোতে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসে।

সব থেকে বেশি ফাঁকা পদের বিজ্ঞাপন আসে ট্যুরিজম সেক্টর থেকে। এরপরেই রয়েছে আইটি সেক্টর। এছাড়াও এনজিও, ই কমার্স ও এফ কমার্স, গার্মেন্টস এবং ভারী শিল্প কারখানার মতো সেক্টরগুলোতে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসে।

সম্প্রতি বিআইডিএসের রিসার্চ পরিচালক এস এম জুলফিকার আলীর নেতৃত্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ বেকার, এছাড়াও সরকারি চাকরিতে আগ্রহী ৪৩দশমিক ১৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, শিক্ষার্থীরা যে-সব বিষয় থেকে পাস করেন, সেগুলোর মধ্যে সমাজবিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসা শিক্ষার শিক্ষার্থী বেশি। অর্থাৎ বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয় কম; স্নাতকে এর পরিমাণ ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবসায় শিক্ষা থেকে স্নাতক করেন। যার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।

বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘চাকরির ক্ষেত্রে সেক্টরভিত্তিক দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরির ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বাধা হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। প্রায় দুই হাজার কলেজ থেকে ৫ লাখের বেশি গ্রাজুয়েট আসছেন, যাদের ট্যাকনিক্যাল দক্ষতা খুবই কম। সমস্যাটা এখানে সব থেকে বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে ভালো করছে। তারা বিষয়ভিত্তিক দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরির দিকে নজর দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের চাহিদার আলোকে সেক্টরভিত্তিক গ্রাজুয়েট উৎপাদনে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে বাইরের থেকে প্রচুর লোক আসছেন। অনেকক্ষেত্রে পদগুলো খালি পড়ে থাকে। কাজেই এখানে পরিকল্পনা না থাকায় পুরো সেক্টরকে মাশুল দিতে হচ্ছে। কত গ্রাজুয়েট তৈরি হবে এটার সাথে বাজারে কী চাহিদা রয়েছে সেটার সম্পর্ক থাকা জরুরি।’

‘আমাদের দেশে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না এই হারটা কম দেখা গেছে। আবার মাইক্রো এন্ট্রাপ্রেনিউর যারা আছেন তাদেরকে সঠিক পরিসংখ্যানে নিয়ে আসা হচ্ছে না। অনেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে নিজ উদ্যোগে জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। কিন্তু সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উৎসাহ কিংবা সহযোগিতার অভাবে তাদের সফল হওয়ার পরিমাণ কম। এটা নিয়েও আমাদের কাজ করা প্রয়োজন— অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, অর্থনীতিবিদ ও উপ-উপাচার্য, ঢাবি

গ্রাজুয়েটদের প্রকৃত তথ্য ও সৃষ্ট কর্মসংস্থানের তালিকার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘সঠিক তথ্য না থাকলে জাতীয় পর্যায়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত যথাযথ হয় না। বছরে কত সংখ্যক গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা কি, কোন বিষয়ে কতসংখ্যক গ্রাজুয়েট তৈরি হচ্ছেন এই তথ্যগুলো সুনির্দিষ্টভাবে আসছে না। সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে যেটা প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন: গণঅভ্যুত্থানে আহতদের টিউশন ফি মওকুফ করছে না নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে ডিগ্রি অর্জন করতে যান, তাদের নিয়েও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমরা দেখি না। কিছু তথ্য আসলেও সেটা আংশিক বলেই মনে হয়। ফলে আমাদের বেকারত্বের হার নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যায়।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বেকার হিসেবে কাউকে নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেকার নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম (আইএলও) সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী— কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পায়, তাকে আর বেকার হিসেবে ধরা হয় না। আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজপ্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তি বেকার হিসেবে ধরা হবে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা। মূলত এই সংজ্ঞার কারণেই বাংলাদেশে বেকার কম।

আইএলও’র এই সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক সায়মা হক। তিনি বলেন, ‘বেকারত্বের সংজ্ঞা নিয়ে আমাদের আরও স্পষ্ট নীতি থাকতে হবে। কাদেরকে আমরা বেকার হিসেবে চিহ্নিত করব এটারও সমাধান হওয়া প্রয়োজন। উন্নত দেশে বেকারত্বের যে সংজ্ঞা গ্রহণ করা হয় আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে সেটার কার্যকারিতা খুব একটা থাকার কথা নয়। কারণ তাদের মুদ্রাস্ফীতি এবং কর্মঘণ্টা অনুযায়ী আয়ের পরিমাণের সাথে আমাদের তফাত রয়েছে৷ ফলে এই সংজ্ঞার আলোকে সঠিক তথ্য অজানা থেকে যায়।’

অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা, অর্থনীতিবিদ ও উপ-উপাচার্য, ঢাবি

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না এই হারটা কম দেখা গেছে। আবার মাইক্রো এন্ট্রাপ্রেনিউর যারা আছেন তাদেরকে সঠিক পরিসংখ্যানে নিয়ে আসা হচ্ছে না। অনেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে নিজ উদ্যোগে জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। কিন্তু সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উৎসাহ কিংবা সহযোগিতার অভাবে তাদের সফল হওয়ার পরিমাণ কম। এটা নিয়েও আমাদের কাজ করা প্রয়োজন।’

গ্রাজুয়েটদের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণের তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সেক্টর ভিত্তিক আমরা প্রতিবছর কত গ্রাজুয়েট পাচ্ছি, বিপরীতে জব মার্কেটে সেক্টরভিত্তিক আমাদের চাহিদা কত? এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন না হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক চিত্র স্থিতিশীল হয় না৷ যে-সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় সেখানেও বিভিন্ন ভুল থেকে যায়।’


সর্বশেষ সংবাদ