বইমেলায় নির্জনের সামাজিক উপন্যাস ‘আশ্রয়’
- মুনযির এম সা’দ, প্রদায়ক
- প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:০৮ PM , আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৫৩ PM
তরুণ কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্জনের সমাজের বাস্তব-গল্প নির্ভর উপন্যাস ‘আশ্রয়’র মোড়ক উন্মোচন হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। জাগৃতি প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করেছে। উপন্যাসটি লেখকের দীর্ঘদিনের সাধনার ফসল। সামাজিক অসাম্যের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই উপন্যাসে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীরা শর্ত-মাফিক সম্পত্তি ভোগ করতে পারে কিন্তু বিক্রি করতে পারে না। তার ছেলে বা ভাই বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয় পারেন। স্বামী মারা গেলে তার কোনো ছেলে না থাকলে যদি মেয়ে থাকে, তাহলে স্বামীর জমি ভোগ করতে পারবে; বিক্রি করতে পারবে না কিংবা মালিক হতে পারবে না। কর্তৃত্ব করবে তার দেবর বা অন্য কোনো পুরুষ। এক্ষেত্রে একজন নারীর আশ্রয় কোথায়?
ডিভোর্স হওয়ার পর সমাজে আশ্রয় নিতে নারীকে কতটা দুঃসময় পার করতে হয় তা তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। আশ্রয়প্রার্থী নারীর ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তিনি কতটা শোষিত, বঞ্চিত বা লাঞ্ছিত হচ্ছে সমাজ তথা কাছের মানুষের কাছে, তা-ই তুলে ধরেছেন লেখক।
‘আশ্রয়’ উপন্যাসে বাবা হারা একজন নারীর বিয়ের পর স্বামী মারা যায়। নারীটির দেবর তার স্বামীর সম্পত্তির ভাগীদার হয়। ওই নারীর শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। মেয়েকে নিয়ে যুদ্ধ করে বাঁচার লড়াই শুরু হয় তার। এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গ্রামীণ পটভূমিকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটি।
মালা নামে এক নারীর বাস্তব গল্পকে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন লেখক। তার মেয়ে পূজার বেড়ে ওঠা, বাল্যবিবাহের চেষ্টা, কীভাবে মা ও মেয়েকে তাড়ানো যায় তা নিয়ে থাকে বিস্তৃত পরিকল্পনা। তাদের সুখ-দুঃখ ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। সবশেষে সফল হওয়ার গল্প জানিয়েছেন তিনি। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় পূজা। বন্ধুদের মুখে উঠে আসে অনেক বিষয়। সতীদাহ প্রথা বাতিল ও বিধবা নারীর বিয়ের আইন পাস হয়েছে অনেক আগে। ভারত ও নেপালে হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার আইন পাস হয়েছে। আমাদের দেশে হচ্ছে না কেন? গলদটা কোথায়? সমাধান কী?
সেই সাথে লেখক এখানে মুসলিম নারীর চরিত্র আলেয়াকেও হাজির করেছেন। বিয়ের পর স্বামীর জমিজমা যমুনায় বিলীন হয়ে যায়। সে আশ্রয় চায় বাবার কাছে। মুসলিম নারী আইনে জমি পাওয়ার অধিকার আছে তার। ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জমি পায় সেই নারী। ভবঘুরে স্বামী সারাদিন তাস খেলায় ব্যস্ত থাকে। ঋণ করে জুয়া খেলে।
আলেয়া ধানের চাতালে কাজ করে। সে আয় দিয়েই চলে সংসার। কর্মী মেয়েদের সমাজে ভিন্ন চোখে দেখে। তারা যেন ভিনগ্রহের কেউ! নারীটি চোখ-মুখ বুজে সংসার কামড়ে থাকে। তবে ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে হাতাহাতি হয়। এক পর্যায়ে স্বামী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে; বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।
আলেয়াকে ঘরের ভিটা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। আলেয়ার আশ্রয় ভাইয়ের বাড়িতে হয় না। ভাই নমনীয় থাকলেও ভাবী বেজার। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এমন নারীর আশ্রয় হবে কোথায়?
ধানের চাতালের মেয়েরা বা গ্রামের অনেক মানুষ লেখাপড়া জানে না। তবে ইন্টারনেট, ইমো বা মেসেঞ্জার বোঝে। ইমোটিকনের মাধ্যমে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে। তাদেরও গ্রুপ আছে। কথা হয় একত্রে। ধানের চাতালেও রয়েছে ওয়াইফাই সুবিধা। কখন ধানের চাতালে আসতে হবে, ইমোতে কথা বলে জেনে নেয় তারা। গ্রামে কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে, তা এ উপন্যাস পড়ে জানা যাবে।
ভিক্ষুকরা আগে পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তি করত। এখন নেটের দায়ে করে। মুরব্বি দেখলে মানুষ সম্মান করত। এখন ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। শিক্ষালয়ে উপস্থিত থেকেও ফেসবুকের লাইক-কমেন্টে বেশি সরব। ধর্মীয় গ্রন্থের বদলে মানুষ এখন স্মার্টফোন নিয়ে প্রার্থনালয়ে যায়। মোরগ বা আজানের ডাকে ঘুম ভাঙত; এখন ভাঙে মোবাইলের ডাকে। গ্রামে কেউ পানিতে ডুবে গেলে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা থাকত। এখন ছবি বা ভিডিও তোলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এমন অনেক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।
বইটিতে ভূমিকা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘আশ্রয়’ উপন্যাসের পটভূমি নারীর বেঁচে থাকার দুস্তর পথের অভিযাত্রা। গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। অনেক বিষয় নিয়ে নির্জনের উপন্যাস সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে।
কথাসাহিত্যিক নোমান বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, উপন্যাস লেখার জন্য যে ধৈর্য, সাধনা আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন, সাম্প্রতিক সময়ের তরুণ লেখকদের মধ্যে তার কিছুটা অভাব দেখা যায়। যে কজন তরুণ উপন্যাস-সাধনার পথে যাত্রা করেছেন, ফরিদুল ইসলাম নির্জন তাদের একজন। নির্জনের ‘আশ্রয়’ উপন্যাসটি পড়েছি। তিনি যথেষ্ট ধৈর্য ধরেই কাহিনীর মালা গেঁথেছেন। ‘আশ্রয়’ উপন্যাসটির কাহিনী ঝুলে যায়নি। পাঠক একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পারবেন না। বর্তমান সময়ের বিদ্যমান নানা সামাজিক সংকটকে তিনি এ উপন্যাসে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন।
ফরিদুল ইসলাম নির্জন বলেন, লেখক হিসেবে আমার কিছু দায়বদ্ধ আছে। সে দায়বদ্ধতা থেকে আমার এই ‘আশ্রয়’ উপন্যাস। আশা করি, সমাজ পরিবর্তনে উপন্যাসটি অনেক সহায়ক হবে।
উল্লেখ্য, এবার ‘আশ্রয়’ উপন্যাসটি ঢাকার বইমেলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বইমেলাতেও প্রকাশ পেয়েছে।