সনদ-ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৯ বছর লড়েও শূন্য হাতে চলে গেলেন জিল হোসেন

জিল হোসেন
জিল হোসেন  © সংগৃহীত

স্নাতকের সনদ আর ক্ষতিপূরণের জন্য দীর্ঘ ৪৯ বছর লড়েও মামলার শেষ দেখে যেতে পারলেন না সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের জিল হোসেন। ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সাথে নিজের স্নাতক সনদ আর ক্ষতি পূরণের জন্য লড়ছেন তিনি।

ক্লাসমেটরা তখন বড় বড় পদে চাকরি করছিলেন। তবে চাকরির সুযোগ না থাকলেও সেই বয়সেই নতুন আরেক লড়াই শুরু করেন জিল হোসেন।

জীবনের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা তো আর পোষাবার মতো নয়। তাই যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভুলে জিলের জীবন বিপন্ন হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যাল) বিরুদ্ধে একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করেন তিনি।

এই মামলায় ২০০৮ সালে নিম্ন আদালত থেকে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের রায়ও পান জিল। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির করা আপিল ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও আপিলের শুনানিই শুরু হয়নি। তার আগেই গত সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) না ফেরার দেশে চলে গেলেন জিল হোসেন।

জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাকৃবির স্নাতকের পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কিন্তু ভুল করে মাত্র দশমিক ৫ নম্বর যুক্ত না করায় অকৃতকার্য হন জিল। এই ফল পুনর্বিবেচনার জন্য অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে তিনি আবেদন করলেও কোনো কাজ হয়নি। পরে প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে মামলা করেন।

এই মামলায় ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এবং ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে জিলকে অকৃতকার্য করানোকে বেআইনি ঘোষণা করে আদালত।

এখানেই জিল হোসেনের মামলার পরিসমাপ্তি টানা যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য ছিল তার। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জজ আদালতে এবং পরে হাইকোর্টে আপিল করে বসে। হাইকোর্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠায়।

এবারও জিল হোসেনের পক্ষে আসে আদালতের রায়। ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে তার পরীক্ষার ফল প্রকাশের নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে রায়ও মানেনি। রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জেলা জজ আদালত ও পরে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। তবে ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ফল প্রকাশে আগের সিদ্ধান্তকেই বহাল রাখে হাইকোর্ট।

রায় তুলে ধরে ১৯৮৬ সালে আবেদন করলে পাস মার্ক দিয়ে জিলকে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর সার্টিফিকেট দেয় বিশ্ববিদ্যালয়।

এ পর্যায়ে ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে জিল হোসেন অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পর কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। এতে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর রায় দেয় ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে ২০০৯ সালে এই নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয়।

সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই আপিল মামলাটি শুনানির জন্য এখন পর্যন্ত ১৭৪ বার আদালতের কার্যতালিকায় এসেছে। মামলাটি সর্বশেষ ২০২০ সালের ১২ মার্চ বিচারপতি মামনুন রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য ছিল। কিন্তু করোনার কারণে থেমে যায় সব। আদালতের কার্যক্রম সচল হওয়ার পর ওই বেঞ্চের এখতিয়ারে পরিবর্তন এসেছে।

নতুন বেঞ্চে মামলাটি আবার উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানান জিল হোসেনের আইনজীবী। এখন মামলাটির শুনানি শুরু হতে ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যেতে পারে। ততদিন বেঁচে থাকতে পারলেন না ক্লান্ত জিল হোসেন। গত সোমবার দুপুরে বগুড়ার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি।

এ মামলা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম বলেন, ‘এটা অনেক পুরোনো মামলা। বারবার কোর্টের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় শুনানি হয়নি।’

জিল হোসেনের অসুস্থতার কারণে মামলাটি দেখভাল করেন তার ছোট ছেলে কিরণ খন্দকার। তিনি বলেন, মামলা চালাতে গিয়ে জমিজমা যা ছিল, প্রায় সবই বিক্রি করেছেন বাবা। ১৯৯৭ সালে মার্কশিট পাওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। এর সঙ্গে আরও ৩৫ হাজার টাকা যুক্ত করে তিনি ক্ষতিপূরণের মামলাটি করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টে মামলা চালানোর মতো সামর্থ্য আর ছিল না। এ জন্য দারস্থ হন সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে। এই কমিটি ২০১৮ সালে বিনা ফিতে মামলা পরিচালনার জন্য একজন আইনজীবী দেন।

তার আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের ফাস্ট আপিলের ক্ষেত্রে আপিলকারী পক্ষকে আগে শুনানি শুরু করতে হয়। কিন্তু শুনানির জন্য উঠলে আপিলকারী পক্ষ বারবার সময় নেয়, অথবা অনুপস্থিত থাকে। আপিল করার পর ১২ বছর চলে গেলেও তাদের অসহযোগিতার কারণে শুনানি হয়নি।

মামলা পরিচালনায় লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও। বারবার হেরে গেলেও আইনি লড়াইয়ে তারা এখনও অনড়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান স্বীকার করেন, জিল হোসেনের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

উপাচার্য বলেন, জিল হোসেন আমাদের ৬ ব্যাচ সিনিয়র। তিনি তখন পাস করে গেলে এখন চাকরিতে অনেক বড় পর্যায়ে থাকতেন। কিন্তু সামান্য নম্বরের জন্য ফেল করানোয় তার জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার শিক্ষকরাই সমাধান করতে পারতেন। তার প্রতি গভীর সমবেদনা। বিষয়টি যেহেতু বিচারাধীন, বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগেই তো তিনি চলে গেলেন ওপারে।


সর্বশেষ সংবাদ