চারুকলায় কেন পড়বেন?

নূর-এ-জান্নাত মিম
নূর-এ-জান্নাত মিম   © সংগৃহীত

চারুকলা নিয়ে পড়া মানেই কি ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত? অনেকেই মনে করেন, চারুকলা মানেই শুধুই ছবি আঁকা, যার সঙ্গে বাস্তব জীবনের তেমন কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। চারুকলা কেবল রং-তুলি বা আঁকাআঁকির বিষয় নয়, এটি মানুষের চিন্তা, সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির গভীরতম প্রকাশ। এটি আমাদের চারপাশের বাস্তবতা, সমাজ ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে দেখার ও ব্যাখ্যা করার এক অসাধারণ উপায়।

অনেকের ধারণা, শুধুমাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বা অন্যান্য তথাকথিত মূলধারার পেশার সঙ্গেই স্থিতিশীল ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে সৃজনশীল পেশার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল যুগে গ্রাফিক্স ডিজাইন, অ্যানিমেশন, ফ্যাশন ডিজাইন, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চারুকলা পাস করা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই চারুকলা এখন শুধুমাত্র শিল্পচর্চার বিষয় নয়, বরং এটি এক বিস্তৃত পেশাগত ক্ষেত্রের দুয়ার খুলে দিয়েছে।

চারুকলায় পড়াশোনা করলে কেবল শিল্পী হওয়াই একমাত্র পথ নয়, বরং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে চাকরির অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে চারুকলা শিক্ষার্থীরা বিসিএস, ব্যাংক, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন।

অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে চারুকলা পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে। বিজ্ঞাপন সংস্থা, ডিজিটাল মার্কেটিং, পাবলিশিং হাউস, ফ্যাশন হাউস, টেক্সটাইল ডিজাইন, এনজিও, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, মিডিয়া ও বিনোদন শিল্পসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে চারুকলার দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের ডিজিটাল বিশ্বে গ্রাফিক ডিজাইনার, ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনার, ৩ডি আর্টিস্ট, গেম ডেভেলপার, অ্যানিমেটর, ইলাস্ট্রেটর, আর্ট ডিরেক্টর, কনসেপ্ট আর্টিস্টসহ নানা পেশায় চারুকলা পাস করা শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন।

চারুকলা কেবল চাকরির জন্য সীমাবদ্ধ নয়, এটি স্বাধীনভাবে কাজ করার অসাধারণ সুযোগ দেয়। একজন চারুকলা শিক্ষার্থী নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন। ফ্যাশন ডিজাইন, সিরামিক শিল্প, হস্তশিল্প, গহনা ডিজাইন, কারুশিল্প, ফটোগ্রাফি, ওয়েব ডিজাইন, ফ্রিল্যান্স ডিজাইনিং, ডিজিটাল আর্ট, স্টার্টআপ বিজনেস, আর্ট গ্যালারি পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করে বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।

শিল্প মানুষের মানসিক প্রশান্তি ও স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত কার্যকরী। এটি আমাদের মানসিক চাপ কমাতে, মনকে প্রশান্ত রাখতে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। শিল্পচর্চা মানুষের আবেগ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম, যা হতাশা, দুশ্চিন্তা এবং একাকিত্ব দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই চারুকলা শুধুমাত্র একটি শিক্ষার বিষয় নয়, এটি জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশের অন্যতম পথ।

শিল্প কেবল ব্যক্তি নয়, গোটা সমাজের পরিবর্তনের হাতিয়ার। চারুকলা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, বৈষম্য ও সংকটকে তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। এটি আমাদের জাতিগত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিল্পীদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সমাজের নানা দিক ফুটে ওঠে, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকে।

চারুকলা নিয়ে পড়াশোনা মানেই শুধু শিল্পী হওয়া নয়, বরং এটি জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার, সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার এক শক্তিশালী মাধ্যম। এটি একাধারে চাকরি, উদ্যোক্তা হওয়া, সামাজিক পরিবর্তন আনা এবং ব্যক্তিগত আত্মোন্নতির পথ তৈরি করে। তাই চারুকলা নিয়ে হতাশার কোনো সুযোগ নেই, বরং এটি অসংখ্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (চারুকলা)


সর্বশেষ সংবাদ