প্রত্যন্ত ভোলার ধাত্রী তানিয়া যেভাবে জাতিসংঘের হিরো

আমরা সাধারণত টিভি সিনেমায় নায়ক দেখি। যাঁদের জনসাধারণের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দেখা যায়। বাস্তব জীবনের তেমনই এক নায়ক হলেন তানিয়া আক্তার। পেশায় একজন মিডওয়াইফ। মানুষের সেবা করার জন্য তিনি এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন। বিশ্ব মানবিক দিবস উপলক্ষে মানবিক কাজে অনুপ্রেরণা জোগাতে জাতিসংঘ তাদের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এদের প্রত্যেকেই মানবিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করে জাতিসংঘ।

তানিয়া আক্তার এখন দায়িত্ব পালন করেছেন কুমিল্লা সদরের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ২০১৮ সালে সরকারি মিডওয়াইফ হিসেবে যোগ দিয়েছেন। নিয়োগের পর প্রথম কর্মস্থল ছিল ভোলায়। করোনাকালেও ছিলেন সে দ্বীপ জেলায়। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে সেবা দিচ্ছেন প্রসূতি মায়েদের।

যে সেবা করার আগ্রহ তানিয়ার ছোটবেলা থেকেই, তা-ই হয়তো ধাত্রীবিদ্যা পড়তে উৎসাহ জোগায় তাঁকে। তানিয়া বলেন, ‘যদিও এই পেশা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যায় দেশে ডিপ্লোমা ডিগ্রি পড়া শুরু হলে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হই ঢাকা নার্সিং কলেজে। ধীরে ধীরে জানলাম ধাত্রী কে, কী তার কাজ।’

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন তানিয়া। ২০১৬ সালে কুতুবদিয়ায় এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। মাতৃমৃত্যু রোধে নিরাপদ মাতৃত্বের যে দায়িত্ব তানিয়ার কাঁধে, সেটা তাঁরও স্বপ্ন। তাই তো বইয়ের বিদ্যা আর মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তাঁকে আনল উখিয়ায়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর সেটা। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল তখনো থামেনি। উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শুরু করলেন দায়িত্ব পালন। দিনরাত সেবা দিলেন শরণার্থী মায়েদের। তানিয়া বলেন, ‘সুস্থ নবজাতককে কোলে তুলে নিয়ে মা যে হাসি দেন, তা অপার্থিব। সেটাই আমার প্রাপ্তি। একজন মিডওয়াইফের জীবনে এর চেয়ে আনন্দের মুহূর্ত আর কিছু হয় না।’

সেই প্রাপ্তির পরশ পেতেই করোনাকালেও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মায়েরা যখন হাসপাতালে আসাটাকে ঝুঁকি মনে করছেন, তখন মুঠোফোনে পরামর্শসেবা দিচ্ছেন তানিয়া আক্তার। তার এই সেবাপ্রবণ মনকে সম্মান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক সংস্থা (ইউএনওসিএইচএ)। সংস্থার ওয়েবসাইটে তিনি বাস্তবের একজন নায়ক।

তানিয়ার পেশাগত জীবনের মোড় বদলানোর বছরটি ছিল ২০১৬। সেই বছর তিনি ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ‘উইম্যান ডেলিভার ২০১৬’ শীর্ষক সম্মেলনের জন্য নির্বাচিত হন। একজন ধাত্রী হিসেবে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে নিজের প্রত্যয়ের কথা বলেছিলেন সেই সম্মেলনে।

সেই প্রত্যয়ে তানিয়ার কুতুবদিয়ায় যাওয়া। তবে বঙ্গোপসাগরের বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে পা ফেলেই বুঝলেন বাস্তবতা বড় কঠিন। সে কথা তানিয়ার মুখে শুনি, ‘গিয়ে দেখি, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রটি রীতিমতো ভূতের বাড়ি। কেউ সেখানে কাজ করতে চাইতেন না বলে বন্ধ দীর্ঘদিন।’ রীতিমতো ভয়ই পেলেন। প্রথম কর্মক্ষেত্র। কাজের অভিজ্ঞতাও কম। কীভাবে কাজ করবেন, সেসব নিয়েই ভাবছিলেন।

রিসার্চ ট্রেইনিং ম্যানেজমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে সেখানে যান তানিয়া। ওদিকে ঢাকায় রেখে গেছেন মা-বাবা আর ছোট দুই ভাইকে। শহরে বেড়ে ওঠা মানুষের কাছে বিদ্যুৎহীন প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করার কষ্টও ছিল। তানিয়া অবশ্য মনের ভেতর পুষে রাখা স্বপ্নকে সারথি করেছেন। সে স্বপ্নই তাঁকে পথ দেখাল।

পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকের সঙ্গে তিনি নিজেও ছুটলেন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। নিজ বাড়িতে অদক্ষ ধাইদের হাতে প্রসব করানোর ঝুঁকি আর নিজের দায়িত্ব ও সেবা সম্পর্কে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে এলাকাবাসীকে বোঝালেন। প্রথম প্রথম সাড়া না পেলেও, মাস গড়াতে অনেক নারী আগ্রহ নিয়ে হাজির হলেন। তানিয়া নিজেও বাড়ি বাড়ি গেলেন। এই নারীদের কাছেই একসময় হয়ে উঠলেন ‘মা’, কারও–বা ‘বোন’।

তানিয়া বলেন, আমাদের কাজই হচ্ছে মা ও শিশুদের নিয়ে। আমাদের সরকার তৈরি করেছে, যাতে আমরা দেশে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করি এবং দেশে একটি মানসম্পন্ন সেবা প্রদান করি। আমাদের যে অর্জন, সেটা আমরা কাজের মাধ্যমেই পেয়ে যাই। আমরা মিডওয়াইফরা যখন মানসম্পন্ন সেবা দেই এবং সেটা পেয়ে মায়েরা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা যখন হাসিমুখে বাড়ি যায় ও আমাদের জন্য দোয়া করে তখনই কিন্তু আমরা আমাদের অর্জনের স্বীকৃতি পেয়ে যাই।

তারপরও আমি যে স্বীকৃতি পেয়েছি, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি সত্যি আনন্দিত। আমি এতদিন ধরে মিডওয়াইফ হিসেবে যে কাজগুলো করে আসছি, এই স্বীকৃতি আমার জন্য একটি অনুপ্রেরণা যাতে সামনে আরও ভালো কাজ করতে পারি।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!